ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শিশুদের ক্যান্সার নিরাময়ে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব শিশু ক্যান্সার দিবস ২০২৪। শিশু ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০২ সালে পৃথিবীর ৯০টি দেশের ১৭৮টি জাতীয় সংগঠনের সম্মিলিত চাইল্ড ক্যান্সার ইন্টারন্যাশনাল (সিসিআই) কর্তৃক এ দিবসটি পালন শুরু হয়। সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়াও এ দিবসটির অন্যতম লক্ষ্য হলো: মৃত্যুহার হ্রাস করা এবং ক্যান্সার সম্পর্কিত ব্যথা এবং এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা শিশুদের দুর্দশা কমানো।
মূলত জেনেটিক কারণেই শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও শিশুদের ক্যানসার রোগের প্রকোপ বাড়ছে দিনে দিনে। শিশুদেরও ক্যানসার হতে পারে, এই ধারণাটাই অনেক অভিভাবকের জন্য নির্মম সত্য হিসেবে প্রকাশ পায়। মায়ের পেটে ভ্রুণ অবস্থায় শিশুরা ক্যান্সার হবে এ ধরনের জিন নিয়ে তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেটা প্রকট আকার ধারণ করে। তবে আশার কথা হচ্ছে, শিশুদের বেশিরভাগ ক্যান্সারই নিরাময় হয় যদি সময়মতো, সঠিক উপায় অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করা হয়।
প্রতিবছর ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের সাধারণত ব্লাড ক্যান্সার বেশি হচ্ছে। তবে নসিকাগ্রন্থি, কিডনি ও চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর সংখ্যাও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেশিরভাগ শিশুর ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। শনাক্ত করা গেলে ও উন্নত চিকিৎসা পেলে ৭০ শতাংশ রোগী সেরে ওঠে। কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ রোগী উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পায়।
ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যান্সারের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর অন্তত চার লাখ শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় আক্রান্ত শিশুদের ৯০ শতাংশই চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। সংস্থাটির তথ্যমতে, বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু রয়েছে। ২০০৫ সালেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সচেতন না হলে ২০৩০ সালে এ হার দাঁড়াবে ১৩ শতাংশে।
প্রতিবছরই ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিশুদের সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার যেমন পালং শাক, ব্রুকলি, ডিমের কুসুম, মটরশুটি, কলিজা, মুরগীর মাংস, কচুশাক, কলা, মিষ্টিআলু, কমলা, শালগম, দুধ, বাঁধাকপি, বরবটি, কাঠবাদাম মতো ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। আর সুনির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জেনিটিক্যাল কারণ, ভাইরাস, খাবারে টক্সিনের উপস্থিতি, ক্যামিকেলস, পরিবেশগত সমস্যায় শিশুদের ক্যান্সার হয়।
আশার কথা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে বেশিরভাগ শিশুরই হোমিওপ্যাথিতে ভালো হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শিশুদের ক্যান্সার মোকাবিলায় সবার আগে সচেতনতা বাড়াতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নসিকাগ্রন্থি নামের যে ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে সেটিও ভালো হয়। তারপরই রয়েছে চোখের ক্যান্সার। যদি প্রাথমিক অবস্থায় এটা ধরা পরে এবং চিকিৎসা করানো যায় তাহলে চোখ ফেলে দিতে হলেও তিনি সুস্থ হয়ে যান। কেবলমাত্র যদি হাড়ের ক্যান্সারে কোনও শিশু আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে তার সুস্থ হবার সম্ভাবনা একটু কম। কারণ হাড়ের ক্যান্সার ছড়িয়ে যায় খুব দ্রুত।
বড়দের যেসব ক্যান্সার হয় সেসব ক্যান্সার শিশুদের হয় না। বাংলাদেশে এখন ক্যান্সারের চিকিৎসা পর্যাপ্ত রয়েছে। তাই শিশুদের ক্যান্সার হলে পরিবারকে ভেঙে না পরে দ্রুত তার চিকিৎসা করাতে হবে সঠিক উপায়ে, তাহলেই তাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
শিশুর ক্যানসারের লক্ষণ
নাক থেকে রক্ত পড়া: শিশুর নাকের সম্মুখভাগে সূক্ষ্ম রক্তনালি থেকে রক্তপাত হতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি কমে যায়। কিন্তু যদি না কমে, বরং ঘন ঘন রক্তপাত হতে থাকে, তাহলে সচেতন হতে হবে।
ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া: শিশুর শরীরের কোথাও কেটে গেলে খেয়াল রাখুন, ক্ষত সারতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছে কিনা। সময় বেশি লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া: ব্যায়াম বা ওজন হ্রাসের কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া যদি শিশুর ওজন কমে যেতে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
চোখের মণি সাদা হয়ে যাওয়া: চোখের মণি সাদা হয়ে যাওয়া। এটি চোখের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ।
শ্বাসকষ্ট: শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া কিংবা ছোট ছোট শ্বাস নেওয়া শিশুর ক্যানসারের ঝুঁকির অন্যতম উপসর্গ।
ঘন ঘন জ্বর: অকারণ ঘন ঘন জ্বর শিশুর লিউকেমিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
চাকা বা মাংসপিণ্ড: পেটের যে কোনো পাশে চাকা বা টিউমার অনুভূত হলে কিডনির ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে।
মাথাব্যথা: শিশুর অস্বাভাবিক মাথাব্যথা মস্তিষ্কের ক্যানসারের লক্ষণ।
অচেতন হওয়া: তীব্র জ্বর বা যথাযথ কারণ ছাড়া শিশু যদি হুটহাট অচেতন হতে থাকে, তাহলে তা ব্রেন টিউমারের উপসর্গ হতে পারে।
হাড়ে ব্যথা: কোনো আঘাত ছাড়াই হাড়ে তীব্র ব্যথা, খুঁড়িয়ে হাঁটা প্রভৃতি লক্ষণগুলো হাড়ের ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
দুর্বলতা: অতিরিক্ত শারীরিক দুর্বলতা শিশুদের লিম্ফোমা নামক ক্যানসারের সাধারণ লক্ষণ।
শিশুর ক্যানসারের কারণ
শিশুর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বংশগত কারণকেই প্রধান মনে করা হয়। এছাড়া নিম্নোক্ত কারণগুলোও রয়েছে—
বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ।
অভিভাবকের ধূমপানের অভ্যাস।
গর্ভকালে মায়ের ভুল খাদ্যাভ্যাস।
শিশুর অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান হার্পিস ও এইচআইভি ভাইরাসও শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
শিশুরা সাধারণত যে ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
জন্ম থেকে প্রথম পাঁচ বছর: নিউরোব্লাস্টোমা, উইল্মস টিউমার, রেটিনেব্লাস্টোমা, লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, গ্লায়োমা এবং অন্যান্য মস্তিষ্কর টিউমার।
পাঁচ থেকে দশ বছর: লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, গ্লায়োমা, সারকোমা (হাড়, মাংসের), জনন কোষের ক্যানসার।
দশ বছরের ঊর্ধ্বে: লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, হজকিন্স ডিজিজ, অষ্টিওসারকোমা, ইউইং সারকোমা, অন্যান্য টিসু সারকোমা, জনন কোষের ক্যানসার। আর চোখের ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সার, স্নায়ু ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার ও ব্রেইন ক্যান্সার। এছাড়া ব্লাড ক্যান্সার ও হাড়ের ক্যান্সারও হতে পারে।
শিশুদের চোখের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হলো চোখের মণি সাদা হয়ে যাওয়া, যা রাতে বিড়ালের চোখের মতো দেখা যায়।
কিডনিতে ক্যান্সার হলে পেটের যে কোনো পাশে একটি চাকা বা টিউমার অনুভূত হয়। এটি বেশি বড় হলে পেট ফুলে যায়।
স্নায়ু ক্যান্সার হলে স্থানটি ফুলে যাবে ও ব্যথা অনুভূত হবে। এই ক্যান্সার ঘাড়ে, প্যারান্যাজাল সাইনাসে বা পেটে হয়ে থাকে।
লিভার ক্যান্সার হলে পেটের ডানদিকে পাঁজরের নিচে ফুলে যাবে ও ব্যথা হবে।
ব্রেইন ক্যান্সার হলে মাথাব্যথা, হাঁটাচলায় অসুবিধা, বমি হওয়া, দূর্বল হয়ে পড়া, জ্বর হওয়া, বিনা কারণে রক্ত পড়াসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
হাড়ের ক্যান্সার হলে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানটি ফুলে যাবে ও ব্যথা হবে। আর ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ শিশু লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। লিউকেমিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রায়ই জ্বর, ক্লান্তি, ম্লানতা, ত্বকে র্যাস, ঘাড়ের গ্রন্থিগুলোর ফোলাভাব সহ ত্বকের ফুসকুড়ি ইত্যাদি। কারো কারো কোনও লক্ষণ নাও থাকতে পারে। পরে রক্ত পরীক্ষায় লিউকেমিয়া ধরা পড়ে।
লিউকেমিয়া সন্দেহ হলে তবে তা দ্রুত পরীক্ষা করা দরকার। যা লিউকেমিয়া নির্ধারণের পাশাপাশি লিউকিমিয়ার ধরণের বিষয়টিও নিশ্চিত করবে। শিশুদের মধ্যে সাধারণত লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া এবং মাইলয়েড লিউকেমিয়া হয়। এসব রোগ সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকে ১৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। রোগ নির্ণয়ের জন্য বিস্তারিত বিবরণসহ বংশগত কোনো কারণ আছে কিনা, তা জানতে হবে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে তাহলে ৮০ শতাংশ শিশুর ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব।
পরিশেষে বলতে চাই,বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। তবে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়লেই শিশু ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে, সঠিক চিকিৎসা পেলে ক্যান্সার থেকে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সারের মূল কারণ জিনগত পরিবর্তন। এছাড়া ভেজাল খাদ্য, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ুদূষণ ও বিকিরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে।
আর ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ বংশগত সূত্রে জিন মারফত আক্রান্ত হয়। বাকি প্রায় ৯৫ শতাংশ কিন্তু জন্ম পরবর্তীকালে পারিপার্শ্বিক কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষতিকরণ রাসায়নিক নানা খাবার, ফলমূল এবং পানি ও বাতাসবাহিত ভাইরাস ক্যান্সারের পথ প্রশস্থ করে। জিনগত ছাড়াও প্রতিদিন শিশুরা যে খাবার খাচ্ছে বা শ্বাস নিচ্ছে তা থেকেও শরীরে ক্যান্সারের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। মেয়েদের গর্ভাবস্থায় লাইফ স্টাইল ও খাদ্যাভ্যাসের কারণেও শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
আর ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেককেই প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ অতিরিক্ত চিনি, লবণ ও চর্বি বিশেষ করে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, কোমল পানীয় পান, অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম, দূষণজনিত সমস্যা, ও অত্যধিক মদ্যপান অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ক্যান্সোরের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জিনগত ক্যান্সার ছাড়াও নগরায়নের পরোক্ষ প্রভাবে শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের ঘটনা বাড়ছে।
ভাইরাস, দূষণ আর বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি ক্যান্সারের মূল কারণ। অধিক মাত্রায় অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও উন্নয়ন শিশুদের শরীরে ক্যান্সারের জন্ম দিচ্ছে। তাই ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বড় নয়, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারা হলো অন্যতম সমস্যা। শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা এখনও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সচেতনতা ও প্রচার-প্রচারণার অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, দেশের চিকিৎসকরা আস্থা অর্জন করতে পারলে সে লক্ষে পোঁছা যাবে। আর সুস্থ ও ক্যান্সারমুক্ত প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব নগরায়নকে প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক