শিলং, রবীন্দ্রনাথ ও আমরা তিনবন্ধু
শাহেদ কায়েসপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০২৪
পরশু সন্ধ্যায় কবিবন্ধু গৌতম গুহ রায় আর আমি জলপাইগুড়ি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেনে চেপে পরদিন শেষরাতে পৌঁছলাম আসাম রাজ্যের গৌহাটি। উঠলাম কবিবন্ধু প্রদীপ মজুমদারের ফ্ল্যাটে। ঘণ্টা তিনেক বিশ্রাম নিয়ে প্রদীপের আতিথেয়তায় রওয়ানা হলাম শিলং-চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে। চেরাপুঞ্জিতে দুর্দান্ত সব সময় কাটিয়ে পরদিন এলাম শিলং।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা‘ উপন্যাসের পটভূমি শিলং। তবে এই উপন্যাসটি তিনি শিলংয়ে বসে লেখেননি, লেখা শুরু করেছেন কলম্বয়, পুনর্লিখন করেন ব্যাঙ্গালোরে। শিলং ও চেরাপুঞ্জির পাহাড়জুড়ে রয়েছে ঝরনার সারি।
ঝরনা তোমার স্ফটিক জলের
স্বচ্ছ ধারা
তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে
সূর্য তারা।
তখন বৃষ্টি... আমরা তিন বন্ধু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির সেই বাড়ি ‘জিৎভূমি’ এলাম। কাছেই কিছুদূর হেঁটে গেলে ‘ব্রুকসাইট’ বাংলো। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সমস্তটা। শিলংয়ের পাহাড়ি পথের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সবুজের মেলা, লুকোচুরি খেলে পথচলা, মনের জমিনে ঝাঁপিয়ে পড়লো শেষের কবিতা...
বাড়ি ফিরেই নোটবই খুলে অমিত লিখল, পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামি করলে! দুজনকে দুই জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে আজ থেকে হয়তো এক রাস্তায় চালান করে দিলে।
দুজন মানে লাবণ্য আর অমিত। শিলংয়ে এই মেঘ, এই রোদ, হঠাৎ বৃষ্টি... মুহূর্তে রোদ্দুর ঢেকে ঝেঁপে বৃষ্টি আসাটা শিলংয়ের বৈশিষ্ট্য। বৃষ্টির আবহাওয়ায় ‘শেষের কবিতা’র নিবারণ চক্রবর্তী প্রথম আবৃত্তি করল, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
ফের আমরা দুজন— অমিত আর লাবণ্য। শিলং পাহাড়ে ওদের প্রথম দেখা। তারপরে প্রণয়, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ। ঠিক যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর মতো।
‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে ব্রুকসাইট বাংলোটিকেই কবি কল্পনা করেছিলেন যোগমায়ার বাড়ি আর জিৎভূমির বাড়িটিকে কল্পনা করেছিলেন অমিত রায়ের বাড়ি হিসেবে। এই বাংলোতেই রবীন্দ্রনাথ লেডি রানু মুখার্জী ও অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সময় কাটাতেন, সাহিত্য আড্ডা দিতেন।
এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রক্তকরবী নাটক, যোগাযোগ উপন্যাসের কয়েকটি অধ্যায় এবং শিলংয়ের চিঠি।
ব্রুকসাইট বাংলোয় এখন একটি ঘরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শোওয়ার খাট ও আয়না, অন্য ঘরে হাল ফ্যাশনের সোফা সেট। প্রতিটি ঘরে ফায়ার প্ল্যাস, আর ঢুকেই রবীন্দ্র প্রতিকৃতির পাশে শোভা পাচ্ছে ‘শেষের কবিতা’ বইটি।
মূল রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বাংলোয় ঢোকার রাস্তায় পাইন গাছের সারি ‘শেষের কবিতা’র শিলংকে মনে করিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবছি, শিলংয়ে না এলে রবীন্দ্রনাথ কী ‘শেষের কবিতা’ লিখতে পারতেন!
লেখক: কবি