শিক্ষার্থী‌দের প্রতি‌নি‌ধি‌দের বাদ দি‌য়ে সেনাপ্রধানের বৈঠক কেন?

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০২৪

স‌ন্দেহ নেই, সোমবারের বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বেশ কিছু অপ্রী‌তিকর ঘটনা ঘ‌টে‌ছে। সেগু‌লো মো‌টেও কাম‌্য নয়। এ ধর‌নের অপ্রী‌তিকর ঘটনা চিরত‌রে বন্ধ করার জন‌্যই এবা‌রের আন্দোলন। কিন্তু সোমবারের ঘটনার দায় কার। বিজয় অর্জ‌নের পর বিজয় অর্জ‌নের যারা মূলশ‌ক্তি, সোমবারের আলোচনায় তা‌দের প্রতি‌নি‌ধি‌দেরকে ডাকা হয়‌নি। প্রথম অনিয়ম হ‌য়ে‌ছে সেটা, যা কো‌নোভা‌বেই কাম‌্য ছিল না। যারা সেখা‌নে গি‌য়ে‌ছি‌লেন, শিক্ষার্থী‌দের প্রতি‌নি‌ধি‌দের বাদ দি‌য়ে সাম‌রিক প্রধা‌নের স‌ঙ্গে তাঁ‌দের আলোচনায় বসা ঠিক হয়‌নি। ক’দিন আগেই আমি আন্দোলনরত শিক্ষার্থী‌দের উদ্দে‌শ্যে এক‌টি বার্তা দি‌য়ে ব‌লে‌ছিলাম, আন্দোলন যেন বেহাত না হ‌য়ে যায়। শিক্ষার্থী ও আন্দোলনরত জনতা যেন হঠাৎ ক‌রে আন্দোলন থা‌মি‌য়ে দি‌য়ে ঘ‌রে ফি‌রে না যায়। বিগত গণ আন্দোলনগু‌লির অভিজ্ঞতা থে‌কে তা ব‌লে‌ছিলাম।

বর্তমান আন্দোল‌নে সেনাবা‌হিনী ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা‌দের ভূ‌মিকার জন‌্য তা‌দের‌কে ধন‌্যবাদ জানাই। জা‌তির এক ক্রা‌ন্তিল‌গ্নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূ‌মিকা রে‌খে‌ছেন। সেনাপ্রধান‌কেও এখন পর্যন্ত তার ভূ‌মিকার জন‌্য ধন‌্যবাদ জানা‌তে হ‌বে। কিন্তু স‌বিন‌য়ে ওনা‌কে এবং অন‌্যদের‌কে বল‌ছি, আন্দোল‌নের মূলস্রোত কারা? কা‌দের কার‌ণে এক ভয়াবহ স্বৈরাচা‌রের হাত থে‌কে জা‌তি মু‌ক্তি পেল? সক‌লের আগে সোমবার যা‌দের আলোচনার জন‌্য আমন্ত্রণ জানা‌নোর দরকার ছিল, সবাই স্বীকার কর‌বেন, তারা হ‌লো শিক্ষার্থী প্রতি‌নি‌ধিরা। ইতিহাস ও রাজনীতির ছাত্র এবং শিক্ষক হি‌সে‌বে আমি ম‌নে ক‌রি, তা‌দের‌কে বাদ দি‌য়ে সোমবারের আলোচনায় বসা মস্তবড় ভুল হ‌য়ে‌ছিল। সে কার‌ণেই সোমবার সারা‌দে‌শে নানারকম অঘটন হ‌য়ে‌ছে।

সক‌লেই আমরা আন্দোলন চলাকা‌লেই জানতাম, আন্দোল‌নের বি‌রোধীপক্ষ ও হা‌সিনার সমর্থক এক‌টি গোষ্ঠী হিন্দু-মুসলমান বি‌রোধ লাগা‌তে চাইছে। বহুবার এই চক্র এ কাজ‌টি ক‌রে‌ছে। এই চক্রটি ভার‌তের সাধারণ জনগ‌ণের স‌ঙ্গে বাংলা‌দে‌শের সাধার‌ণে জনগ‌ণের সুসম্পর্ক চায় না। প‌শ্চিম বাংলার বাঙালির স‌ঙ্গে পূর্ব বাংলার বাঙালি‌দের সুসম্পর্ক তারা কখ‌নো চায়‌নি। বাংলা‌দে‌শের হিন্দু-মুস‌লমান‌দের ম‌ধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার জন‌্য এই চক্র ছ‌ত্রিশ বছর ধ‌রে এই ধর‌নের খেলা খেল‌ছে। হিন্দু সম্প্রদা‌য়ের পূজার প্রতিমা এই চক্র বহুবার ভে‌ঙে‌ছে বাংলা‌দে‌শের ‌হিন্দু-মুসলমান‌দের ম‌ধ্যে উত্তেজনা তৈ‌রির জন‌্য। হা‌সিনা সরকার নিজ স্বা‌র্থে, এসব খেলায় সমর্থন যু‌গি‌য়ে‌ছেন। তার শাস‌নে এসব ঘটনা বহুবার ঘ‌টে‌ছে।

লক্ষ‌্য কর‌বেন, এবা‌রের আন্দোলনকে নস‌্যাৎ করার জন‌্য এই চক্র শেষ পর্যন্ত সেই তাস‌টি খেল‌তে আরম্ভ ক‌রে। আন্দোলনকারীরা তা বুঝ‌তে পে‌রে বারবার ব‌লে‌ছিল, হিন্দু সম্প্রদা‌য়ের জানমাল রক্ষা কর‌তে হ‌বে। কিন্তু সোমবার বিকেল থে‌কে বহুক্ষে‌ত্রে ম‌ন্দির আক্রমণ হ‌য়ে‌ছে, স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে একদল সেটা‌কে আন্দোল‌নের ব‌্যর্থতা হি‌সে‌বে দেখা‌নোর চেষ্টা ক‌রে। তা অনেকে না বু‌ঝে ক‌রে‌ছেন, আন্দোলনকারীরা এই হামলা পছন্দ না ক‌রে বার্তা দি‌য়ে‌ছেন। আন্দোলনকারী‌দের‌কে ধন‌্যবাদ যে, তারা জনগ‌ণের নিরাপত্তার জন‌্য উদ্বিগ্ন। কিছু লোক অসৎ উদ্দে‌শ্যে এসব প্রচার কর‌ছে, আন্দোলন‌কে হেয় করার জন‌্য। কিন্তু তাঁ‌দের‌কে বল‌তে চাই, রা‌ষ্ট্রের দা‌য়ি‌ত্বে বা সরকা‌রের দা‌য়ি‌ত্বে সোমবার আন্দোলনকারীরা ছি‌ল না। সোমবার থে‌কে এখন পর্যন্ত এই দা‌য়ি‌ত্বে আছেন রাষ্ট্রপ‌তি ও সামরিক বা‌হিনীর প্রধান। এই দায় য‌দি কাউকে নি‌তে হয় ত‌বে তাঁ‌দের‌কেই নি‌তে হ‌বে। কিন্তু আমি ব‌্যক্তিগতভা‌বে এক‌টি চক্র ছাড়া আর কাউকে এখ‌নো দায়ী কর‌তে চাই না।

সক‌লের অবগ‌তির জন‌্য বল‌তে চাই, বিপ্লব বা আন্দোল‌নের পরপর এসব ঘটা নতুন কিছু নয়। ফরাসি বিপ্ল‌বে ঘ‌টে‌ছে, রুশ বিপ্ল‌বে ঘ‌টে‌ছে, বাংলা‌দে‌শের মু‌ক্তিযু‌দ্ধে চোদ্দ ডি‌সেম্বর থে‌কে এমন ঘটনা বহু‌দিন ঘ‌টে‌ছে। তখনকার পত্রপ‌ত্রিকা দে‌খেন, নাটক দে‌খেন। হা‌সিনা সরকা‌রের বিগত বছরগু‌লো‌তে‌ রে‌খে যাওয়া পা‌পের ফল আরো বহু‌দিন আমা‌দের ভোগ কর‌তে হ‌বে। নানা জায়গায়, নানা প‌দে তার ব‌সি‌য়ে দেওয়া লোকরা এখ‌নো আছে। তারা আন্দোলন নস‌্যাৎ করার চেষ্ট কর‌ছে এবং কর‌বে। হা‌সিনা দুর্নী‌তি ও গুণ্ডামিসহ অনিয়মের যে পাহাড় গ‌ড়ে তু‌লে‌ছে, সেখান থে‌কে মু‌ক্তি পে‌তে সময় লাগ‌বে। সেজন‌্য আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্র সংস্কা‌রের ডাক দি‌য়ে‌ছে। রাষ্ট্র সংস্কার রাতারা‌তি হয় না।

সঙ্কট আরও আছে, হা‌সিনার তৈ‌রি ক‌রে যাওয়া সঙ্কট। হা‌সিনা সরকার লুটপাট, অর্থপাচার ক‌রে যেভা‌বে অর্থনী‌তি‌কে ফাঁপা ক‌রে দি‌য়ে গে‌ছে তা থে‌কে উদ্ধার পে‌তে সময় লাগ‌বে। গণমাধ‌্যমগু‌লোর ভূ‌মিকা প্রশ্ন‌বোধক। সোমবার দুপুর পর্যন্ত তারা নি‌জে‌দের গণমাধ‌্যমে নানারকম মিথ‌্যাচার ক‌রে‌ছে আন্দোলন সম্প‌র্কে। গণমাধ‌্যমগু‌লো সবাই কি এই প‌রিবর্ত‌নের প‌ক্ষে? না, মো‌টেই নয়। কারণ তা‌দের লুটপা‌টের রাস্তা বন্ধ হ‌য়ে যা‌চ্ছে। সোমবার দুপু‌র পর্যন্ত তারা আন্দোলন সম্প‌র্কে মিথ‌্যাচার ক‌রে‌ছে। বহু‌দিন আরও ঘু‌রি‌য়ে ফি‌রি‌য়ে কর‌বে। ফ‌লে সকল‌কে কিছু‌দিন সব‌কিছু ম‌নো‌যোগ দি‌য়ে লক্ষ‌্য কর‌তে হ‌বে।

বি‌রো‌ধিতা যারা ক‌রে‌ছেন, এই আন্দোলন ক‌রে‌ছেন, তাঁ‌দের‌কে আমরা সমা‌লোচনা কর‌তে পা‌রি। চাইলে হত‌্যাকা‌ণ্ডের প‌ক্ষে থাকার জন‌্য ঘৃণা কর‌তে পা‌রি। কিন্তু তাঁ‌দের‌কে শারী‌রিকভা‌বে আক্রমণ কর‌তে পা‌রি না বা তাঁ‌দের ঘরবা‌ড়ি আক্রমণ কর‌তে পা‌রি না। অবশ‌্যই তাঁ‌দের‌কে ষড়যন্ত্র ক‌রে এই সরকা‌রের ক্ষ‌তি সাধন কর‌তে না দেয়ার জন‌্য নজর রাখ‌তে হ‌বে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক