শিক্ষার পরশ পাথর শ্রীঅরবিন্দ

নাঈমুল হাসান হিমেল

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২৩

বর্তমান সময়ে একটি শিশু শিক্ষার শুরুতেই বাংলা আর আর ইংলিশ মিডিয়ামের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। ভোগার যথেষ্ট কারণও আছে। পাশের বাসার রহিম সাহেবের ছেলেটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। কী সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলে! আমার ছেলেকেও পড়তে হবে ইংলিশ মিডিয়ামে। অফিসের কলিগের মেয়েটা কী সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে বাংলায়!

 

জাতি হিসেবে আমরা আজও হুজুগে মাতাল নই কি? যখন বইয়ের ভারে কুঁজো হয়ে রাজ্যের বিরক্তি আর ক্লান্তি নিয়ে শিশুটি ক্লাসে ঢোকে, তখন বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখটি আনন্দে ঝলমল করে ওঠে, আহা! মাস শেষে শিশুর বাবার মোটা অংকের টাকা যে তার পকেটে আসা নিশ্চিত। শিশুটির বিরক্তি মাখা আক্রোশ লুকোনো মুখটি কি খুঁজি কখনও?

 

আমরা সহজকে জটিল করি আর অতীতের পরশ পাথরটিকে উপেক্ষা করে আস্তাকুঁড়ে ফেলি। ১৮৭২ সালে ভারতে জন্ম নেয়া শ্রীঅরবিন্দ তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সময়টা কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডে। দেশে এসে অধ্যাপনা করেছেন। করেছেন রাজনীতি। স্বাধীনতা আন্দোলনে রেখেছেন বড় ভূমিকা। জেল খেটেছেন দীর্ঘ এক বছর। তবে এখানে উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে, তিনি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সময় ছিলেন শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষ। সেই অভিজ্ঞতার ফলে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব শিক্ষাদর্শন।

 

শ্রীঅরবিন্দের কথায় কেন আসলাম? হুম, বলছি। তার শিক্ষাদর্শনে তিনি কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেননি। তিনি মনে করতেন, প্রেম, ভালবাসা, জ্ঞান, শক্তি, সৌন্দর্য এগুলোর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ বিকাশ ঘটে। এর মাধ্যমেই মানুষ সমগ্রতার ওপর প্রেমে আপ্লুত হয়। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়। শারীরিক সুস্থতা ও তুখোর জ্ঞানের অধিকারী হয়ে গড়ে ওঠে।

 

তিনি শিক্ষকদের বলেছিলেন, জোর করে শিক্ষার্থীকে শিখানো যায় না। তার নিজের মতো করেই শিখবে শিক্ষার্থী। শিক্ষকের কাজ হবে শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করা, উপযুক্ত সহায়তা করা। খবরদারি বা আদেশ দেয়া শিক্ষকের কাজ নয়। নির্দেশনা দেয়া এবং উপযুক্ত সহায়তা করাই শিক্ষকের প্রধান কাজ। শিক্ষার্থীর জ্ঞানের উৎস সন্ধ্যানে সহায়তা করা, অনুপ্রাণিত করা। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকে শিক্ষা প্রদানকার্য করতে হবে। শিক্ষার্থী কি ধরনের চাহিদা অনুভব করছে তার মনোভাবটাই বা কি, এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করেই শিক্ষকের শিক্ষাপদ্ধতি পরিচালনা করতে হবে। পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীকে জানার বিষয় থেকে আস্তে আস্তে অজানার দিকে ধাবিত করতে হবে। শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা কতটুকু তা জেনে শিক্ষকের শিক্ষা কার্যকর করতে হবে।

 

শ্রীঅরবিন্দ তার শিক্ষাধারার সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের স্বার্থক সমন্বয় সাধন করেন। তাই তার শিক্ষা পদ্ধতিকে আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে। তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার শিক্ষা দর্শনের বাস্তবরূপ। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৪৩ সালের কথা। পন্ডিচেরির একটি আশ্রমে গড়ে তোলা হয় সেই বিদ্যালয়, যা পরে Sir Aurobinda International Center of Education নামে আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। এই বিদ্যালয়ে একটি নীতি রয়েছে, যা মুক্ত অগ্রগতির নীতি নামে পরিচিত। এই নীতি অনুযায়ী শিক্ষার্থী তার ইচ্ছামতো বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে পারবে এই বিদ্যালয়ে। প্রথাগত শিক্ষার মতো বিজ্ঞান, কলা ইত্যাদি এই বিভাগে থাকবেনা। পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে শিক্ষার্থী। নিজেই তার পড়ার বিষয় নির্বাচন করবে এবং যখন ইচ্ছা তখন তা পরিবর্তন করতে পারবে। শ্রীঅরবিন্দ তার শিক্ষাদর্শনে এক একটি বিদ্যালয়কে এক একটি বৃহৎ পরীক্ষাগার হিসেবে গড়ে তুলতে বলেছেন।

 

উপরিউক্ত আলোচনাটিকে কাল্পনিক কোনো স্কুল ভেবে ভুল করবেন না। এটি আসলেই সত্যি। এমনই ছিল তার চিন্তাধারা। তার বিদ্যালয়। আমরা আমাদের শিক্ষাকে বারবার একটা ছোট গণ্ডিতে নির্দিষ্ট শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে আটকে ফেলি। আমরা ছাত্রবান্ধব হওয়ার চেয়ে শিক্ষকবান্ধব হওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দেই। সন্তানের পিতা-মাতার ইচ্ছাটাই সবার কাছে গুরুত্ববহ, কারণ অর্থ যে তারাই প্রদান করেন। শিশুর অসহায়ত্বের সুযোগ কি নিচ্ছি না আমরা? কিছু বুঝে ওঠার আগেই বড়দের ইচ্ছেটাকে কি চাপিয়ে দিচ্ছি না স্নিগ্ধ নতুন কোমল মনের শিশুর উপর? এর উত্তর কি হবে? এর উত্তর কে দেবে? কলি ফোটার আগেই তা শুকিয়ে যায়। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে হাতড়ে বেরানো বইয়ের বোঝায় নুয়ে পরা শিশুটির জন্য শ্রীঅরবিন্দের শিক্ষা দর্শন থেকে কি আমরা কিছুই শিখতে পারি না? কিছুই করার নেই আমাদের? স্বপ্নের শিক্ষাব্যবস্থাও আমাদের হবে একদিন। খুব বেশি দেরি নেই, আমাদের হাতেই হবে এ নতুনের শুরু। শিক্ষার পরশ পাথরগুলোকে খুঁজে খুঁজে কাজে লাগাব সেদিন। শিক্ষা হবে শিক্ষার্থীর জন্য স্বাধীন। আনন্দের এবং স্বপ্নের স্থান হবে বিদ্যালয়।