শিক্ষাব্যবস্থা ও মৌলবাদ

গৌরব গুপ্ত

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০১৯

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। দক্ষিণ কলকাতার সরকারি ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের অঙ্কের ক্লাস চলছিল। উদয় বাবু অঙ্ক ক্লাস নিচ্ছিলেন। ভগ্নাংশ শেখানো হচ্ছিল। পাঠ্যপুস্তকে ওই অঙ্কের প্রস্তাবিত পদ্ধতি দেয়া ছিল, স্যার সেভাবে বুঝিয়েও দিচ্ছিলেন। তো, যে কোনো কারণে প্রস্তাবিত পদ্ধতির বদলে কিছু ভিন্ন এবং স্বকীয় উপায়ে উক্ত অঙ্কের সমাধান করেছি। কিছুটা উৎসাহ নিয়ে স্যারকে দেখিয়েছি। উনি খাতাটা এক ঝলক দেখেই আমার দিকে সামান্য দৃকপাত করে বললেন, ‘গাধা মার্কা।’ এবং খাতাখানা ছুঁড়ে দিলেন। আমিও ক্লাসের অতিসাধারণ ছাত্র। কাজেই নিজেকে নির্বোধ ভাবতে কোনো সমস্যা হয়নি।

ক্লাস শেষ হওয়ার কিছু আগে স্যার আমাকে কাছে ডাকলেন এবং খাতা নিয়ে তার কাছে হাজির হতে হুকুম করলেন। তো বাধ্য ছাত্রের মতো হাজির হলাম। এবার বাস্তবিক অঙ্কটা খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি অবাক, বললেন উত্তর তো ঠিকই আছে। পদ্ধতি আলাদা হলো কিভাবে? এবার স্বগোতুক্তি, ‘গাধাটার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে।’

এবার ফিরে আসি হালের কাহিনিতে। বর্তমানে পদার্থবিদ্যার গবেষণা ছাত্র এবং কলেজে অতিথি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। পেশাগত প্রয়োজনে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের সাথে পরিচিত। বর্তমানের পাঠ্যক্রমানুসারে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আপেক্ষিকতাবাদ, কণা পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি অতি উচ্চাঙ্গের পদার্থবিজ্ঞান দ্বাদশ শ্রেণিতে ছাত্ররা পড়ছে। এত কেবল পদার্থবিদ্যা বাকি অন্য বিজ্ঞান বিষয়ে অনুরূপ পাঠ্যক্রম চালু হয়ে গিয়েছে।

বিজ্ঞানের দর্শনে প্রাথমিক শর্ত হলো, যে কোনো প্রস্তাবকে অন্ধভাবে স্বীকার না করে তাকে প্রশ্ন করা! বিজ্ঞান সেভাবেই নতুন দিগন্তে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়েছে। অথচ বর্তমানের পাঠ্যক্রম ছাত্রদের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়কে কিছু গাণিতিক সূত্রের সমষ্টিতে পরিণত করেছে। কারণ, অতিউচ্চাঙ্গের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বীয় জ্ঞানকে আত্তীকৃত করার উপযুক্ত পরিণতি হয়তো কোনো উচ্চমাধ্যমিক পাঠরত ছাত্রেরই সঠিক অর্থে নেই। এই পরিস্থিতিতে, শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের উপর দ্বিমুখী প্রভাব ফেলছে। একদল ছাত্রছাত্রী যারা বিষয়ের গভীরে গিয়ে পড়াশুনায় স্বকীয়তার ছাপ রাখতে চায়, তাদের কাছে বিজ্ঞান কেবলমাত্র প্রহেলিকাময় ও দুর্বোধ্য ঠেকছে। কারণ উক্ত বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে পরীক্ষায় পাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে।

অপরদিকে, একদল ছাত্র যারা উপযুক্ত নম্বর পেয়ে পাশ করতে চায় তারা প্রায় সমস্ত সূত্রের গাণিতিক রূপের সাথে পরিচিত হয়ে তার তত্ত্বগত গুরুত্বকে অস্বীকার করছে। ফলত, উপযুক্ত বিজ্ঞান গবেষক বা বিজ্ঞানকর্মীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তথায়, বিজ্ঞান শিক্ষাকে স্রেফ উন্নত ভবিষ্যতের আহ্বান রূপে গণ্য করছে ছাত্রছাত্রীরা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, পরীক্ষাপত্র মূল্যায়নকালে নির্দিষ্ট ফরমান জারি হচ্ছে, যে ছাত্রী বা ছাত্র ওই ফরমান অনুযায়ী উত্তর লিখবে সে উপযুক্ত নম্বর পাবে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন বিজ্ঞান শিক্ষায়, তথা যে কোনো শিক্ষার ক্ষেত্রে এত বিধিনিষেধ! বর্তমান নীতি প্রণেতারা কেনই বা শিক্ষাকে এত আমলাতান্ত্রিকতায় ঠেলে দিচ্ছেন? যে আশঙ্কা উঁকি দেয় তা হলো, স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল চিন্তার যে অবকাশ জিজ্ঞাসু মনে স্বাভাবিক ভাবে আবির্ভূত হয় তাকে প্রথার বেড়াজালে বেঁধে ফেলার এ এক clinical প্রচেষ্টা।

আজ থেকে বিশ বছর আগে, এই প্রচেষ্টা সামাজিকতায় কিছুটা প্রচ্ছন্ন আকারে ছিল। তবে ছিলই। কিন্তু আজ এই প্রচেষ্টা সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেছে। সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা ব্যবস্থা আদতে `আজ্ঞাবহ দাস` এ পরিণত করেছে। মোটামুটি যা পরিস্থিতি, `ভাল ছাত্র বা ছাত্রী` হিসাবে বর্তমান ব্যবস্থা তাকেই স্বীকৃতি দেবে যে এই ব্যবস্থাকে প্রশ্ন বিনে, সবচেয়ে বাধ্যভাবে মেনে নেবে। চিন্তার জগতে মৌলবাদ বা ফ্যাসিজিম প্রায় ইস্কুল থেকে দৃঢ় ভাবে আরোপিত হচ্ছে। শিক্ষার দর্শনগত ভিত্তিকে ভ্রান্তি অভিমুখী করে দেয়া বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গভীর সঙ্কট এবং চক্রান্ত।