শিক্ষাবিদ মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার আজ মৃত্যুদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০২৪

শিক্ষাবিদ ও রসায়নবিদ মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মাড়গ্রামে তার জন্ম।

তার পিতা খোন্দকার আব্দুল মুকিত পির বংশের সন্তান এবং নিজেও পির হওয়ায় কুদরাত-এ-খুদাকে পির বানানোর জন্য ভর্তি করে দেন। খুদার যখন কলকাতায় পড়াশোনা করছেন তখন একদিন এক মামা তাদের বাড়িতে আসেন। তিনি খুদাকে বাংলা বর্ণমালার বই দেন।

বিকেলেবেলা খুদাকে খেলতে দেখে মামা বইটি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে বালক খুদা সব মুখস্ত বলে দেন। বালকের প্রতিভা দেখে তিনি তাকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে মাড়গ্রাম এমই স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন।

পরবর্তীতে খুদা চলে আসেন কলিকাতা উডবার্ন এমই স্কুলে এবং কলকাতা মাদ্রাসায়। কলকাতা মাদ্রাসা থেকে তিনি ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি ১৯২৫ সালে রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএসসি পাশ করেন।

এরপর সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ডক্টরেট করার জন্য। সেখানে তিনি স্যার জেএফ থর্পের অধীনে থিসিস করেন। প্রফেসর থর্প কুদরত এ খুদাকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে দেন। ফলে তিনি চার বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ কাজ করেন।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে Stainless Configuration of Multiplanmet Ring বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৯ সালে রসায়নে ডক্টর অব সায়েন্স (ডিএসসি) ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর দেশে ফিরে এলে প্রথমদিকে তার কোনো চাকরি জোটেনি। আড়াই বছর বেকার ছিলেন তিনি। সেসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে গবেষণা থিসিস লেখেন তিনি।

কুদরাত-এ-খুদা ১৯৩১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি এ কলেজে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাকে ইসলামিয়া কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ড. কুদরাত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং জনশিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব নেন (১৯৪৭-১৯৪৯)। এরপর তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োজিত হন (১৯৫০-১৯৫৩)। ১৯৫৩-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারসমূহের পরিচালক ছিলেন।

অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে গড়ে তোলেন বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার। বাংলাদেশের দেশীয় শিল্পের বিকাশ হয় তার হাত দিয়ে। ১৯৬৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য যে শিক্ষাকমিশন গঠন করা হয় ড. কুদরাত-এ-খুদা তার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণীত হয়।

পাটকাঠি থেকে মণ্ড তৈরি করে সেই মণ্ড থেকে অতি উন্নতমানের দৃঢ় তক্তা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পারটেক্স কাঠ কুদরাত-এ-খুদার বিশেষ অবদান। সমুদ্রের পানি থেকে লবণ চাষিরা যে পদ্ধতিতে লবণ সংগ্রহ করে তা থেকে শুধুমাত্র খাবার লবণ (NaCl) সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে NaCl ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ও স্বল্পমাত্রায় ব্রোমিন থাকে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসব রাসায়নিক প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এসব বাংলাদেশে আমদানি করা হতো। কুদরাত-এ-খুদাই প্রথম হিসাব করে দেখান, বড় কোনো কারখানায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লবণ আহরণ করা হলে, সে কারখানা যদি এক লাখ টন লবণ উৎপাদন করে, তবে সেখানে তার পাশাপাশি বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে দশ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড, দশ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও সেই অনুপাতে পটাশিয়াম ক্লোরাইড উৎপন্ন হবে।

ড. কুদরাত-এ-খুদা স্টেরিও রসায়ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীতে তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বনৌষধি, গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, লবণ, কাঠকয়লা, মৃত্তিকা ও অনান্য খনিজ পদার্থ। বিজ্ঞানী হিসাবে তার ও তার সহকর্মীদের ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৯টি পাটসংক্রান্ত। এর মধ্যে পাট ও পাটকাঠি থেকে রেয়ন, পাটকাঠি থেকে কাগজ এবং রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য।

তার লেখা বইগুলো হচ্ছে, বিজ্ঞানের সরস কাহিনি, বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনি, বিজ্ঞানের সূচনা, জৈব-রসায়ন (চার খণ্ড), পূর্ব-পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, পরমাণু পরিচিতি, বিজ্ঞানের পহেলা কথা, যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প, বিচিত্র বিজ্ঞান, পবিত্র কোরআনের পূতকথা এবং অঙ্গারি জওয়ারা।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব বইয়ের মধ্যে দু’একটি বই ছাড়া বর্তমানে আর কোনো বই বাজারে পাওয়া যায় না। প্রকাশকরাও তার বই প্রকাশের ব্যাপারে তেমন আগ্রহবোধ করেন না।

১৯৭৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পান। এছাড়া তমঘা-ই-পাকিস্তান, সিতারা-ই-ইমতিয়াজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।