শিক্ষকের মর্যাদা: প্রসঙ্গ প্রসঙ্গান্তর

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২৪

শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। বিশেষ করে গড়পরতা মানুষের আর্থিক সক্ষমতা যখন বাড়ছে তখন এ প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল উত্থানের এই ক্রান্তিলগ্নে সামাজিক যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে বিচিত্র অনুষঙ্গে শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলোচনার এই পটভূমিতে যাওয়ার পূর্বে আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে যে, শিক্ষক কাকে বলে, আর তার পরিপূর্ণ অবয়বটি-বা কেমন।

শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সঙ্গে সমাজের অনেক লোক জড়িত। অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধিবিধান অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রমের আওতায় শিখন-শেখানো কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন যারা তাদের আমরা শিক্ষক বলি। আর এর বাইরে ঘরে ঘরে মা-বাবা ছেলে-মেয়েদের পড়ান। এক সময় গৃহশিক্ষক থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে গৃহকর্তার ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। কোচিং সেন্টারগুলোতে শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কর্মযজ্ঞের বিষয়টি বিপুল আলোচিত-সমালোচিত। এ ছাড়া ঘরে এসে শিক্ষকগণ পড়িয়ে যান- এই প্রথাও সমাজে বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে। প্রতিষ্ঠানের বাইরে এই ধরনের শিক্ষা-কার্যক্রমকে বলা হয় homeschooling। প্রশ্ন হলো, এরা সবাই কি শিক্ষক? এই প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ ও যৌক্তিক সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

দুই.
প্রথমেই স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, গৃহশিক্ষকতার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা শিক্ষক নন। সেটা বাড়িতেই হোক অথবা কোনো কোচিং সেন্টারে হোক। মা-বাবা, গৃহশিক্ষক, কোচিং শিক্ষক কিংবা বাড়িতে এসে প্রাইভেট পড়িয়ে যান,  এমন কেউই শিক্ষক নন। কেননা, এই শিক্ষকতার সঙ্গে শিক্ষাতত্ত্বের pedagogy, শিক্ষাক্রমের curriculum, সহ-পাঠ্যক্রমিক শিক্ষাক্রম ও নিয়মিত পাঠ্যক্রম বর্হিভূত কার্যক্রমের co-curricular and extra curricula activities মূল্যায়ন পদ্ধতির assessment strategy, শিখন-শেখানো পদ্ধতির teaching-learning approach এবং পেশাদারিত্বের professionalism কোনো সম্পর্ক নেই।

ফলাফলভিত্তিক শিক্ষায় result based education প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে ভালো ফলাফল করানোর একটি প্রচেষ্টা বহুবছর ধরে সমাজে প্রচলিত আছে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। অধিকন্তু মুখস্থ করানো, বারবার চর্চা করানো, বারবার লেখানো, শিক্ষার্থীকে পড়ার টেবিলমুখো করা ইত্যাকার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করানো হয় শুধু ভালো ফলাফলের চিন্তা মাথায় রেখে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে এই পাঠদানের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এরা শিক্ষক নন। সুতরাং শিক্ষক হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আইন ও বিধিবিধান দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন এবং যিনি সরকার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিধার্রিত একটি বেতন স্কেলের আওতায় শিক্ষকতা করেন।

অর্থাৎ আর দশটি সরকারি-বেসরকারি চাকরির মতো একজন শিক্ষককেও চাকরি সংক্রান্ত সকল বিধি-বিধান ও আইনকানুনের আওতায় পরিচালিত হতে হয়। এবং এরাই হলেন শিক্ষক।

তিন.
শিক্ষকতার পেশা অন্য  যে কোনো চাকরি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা এই চাকরির সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের শিখনের learning সম্পর্ক এবং শিক্ষার্থীরা কেমন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে তারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শিক্ষকতার পেশার সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেক শিক্ষার্থী এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব এবং প্রত্যেকেরই শিখনচাহিদা ভিন্ন এবং প্রত্যেকের মনের গড়ন ও প্রবণতাও ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের এই সকল ভিন্নতাকে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয় শিক্ষকে এবং সে অনুযায়ী তাদের শিখন-শেখানো কার্যক্রম teaching-learning পরিচালনা করতে হয়। এই জন্য শিক্ষকতাকে বলা হয় সর্বোচ্চ জটিল পেশা।

চার.
অনেকে মনে করেন, শিক্ষকতা সহজ-সরল ও নির্ভার একটি পেশা। অন্যান্য চাকরিতে প্রচুর ঝামেলা থাকে। ব্যক্তিকে সেখানে বিচিত্র হিসাব-নিকাশ, নানা ধরনের মেরুকরণ, প্রতিষ্ঠানের ভেতরের অনেক রাজনীতি সামাল দিয়ে টিকে থাকতে হয়। কিন্তু শিক্ষকতায় সে ধরনের কোনো ঝক্কি নেই। একদিক থেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এই ধারণা অমূলক নয়। অন্যান্য চাকরির মতো প্রতিষ্ঠা-কেন্দ্রিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঝামেলা শিক্ষকতায় তেমন নেই। কিন্তু শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করার জন্য একজন শিক্ষককে শিশুমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান থাকতে হয় এবং সেই জ্ঞান তাকে প্রতি মুহূর্তে ব্যবহার করতে হয়। ব্যক্তি শিক্ষার্থীর মনের গড়ন বুঝতে কোনো শিক্ষক যদি ভুল করেন তা হলে শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি সাধিত হবে, তার আর কোনো নিরাময় থাকবে না।

শিশুর মনের এই গড়ন ভিত্তিহীন নয়। এর সঙ্গে স্থান ও কালের সম্পর্ক আছে; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সম্পর্ক আছে; ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের সম্পর্ক আছে। একজন শিক্ষককে শুধু ভালো পড়াতে পারলেই চলে না, তাকে শিক্ষার্থীর এই পরিচয়ও বিবেচনায় রাখতে হয়। একজন শিক্ষককে স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ আত্মস্থ করতে হয় এবং সময়জ্ঞান থাকতে হয়। স্থনীয় বা স্কুলভিত্তিক শিক্ষাক্রম আমাদের দেশে না থাকলেও সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় এবং সেই শিক্ষক্রমে সবদিক থেকেই সময়ের সকল আবেদন ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষাক্রমে স্থান ও সময়ের পটভূমিতে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য নাগরিক ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল নির্দেশনা থাকে। সেই নির্দেশনা সর্বজনীন। অর্থাৎ ব্যক্তি-শিক্ষকের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা কোনো আদর্শের অনুকূলে তা হয় না।

সুতরাং কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কোনো পরিচয় তুলে ধরতে চান, তাহলে তিনি ভুল করবেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

এক সময় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হতো। যেমন গণিত পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকত যে, তিনজন নারী যে কাজ একদিনে করতে পারেন একজন পুরুষ সে কাজ... ইত্যাদি। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের চিত্রে, ছবিতে, প্রচ্ছদে পুরুষদের উত্তমর্ণ এবং নারীদের অধমর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। কিন্তু মাত্র দুই থেকে তিন দশকের ব্যবধানে সাধারণ মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ কেন্দ্রিক এই বৈষম্যমূলক ধারণা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। আর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছে লিঙ্গসমতার আদর্শে। এই সমতার ভাবনা শিক্ষাক্রমে ও পাঠ্যপুস্তকে থাকলেই চলবে না, শিক্ষকের চিন্তার গড়নে ও বিশ্বাসের মধ্যেও এই ভাবনা থাকতে হবে। অন্যথায় কোনো না কোনোভাবে নারী সংক্রান্ত তার প্রথাগত ও বদ্ধমূল ধারণারই প্রতিফলন ঘটবে তার বক্তব্যে। এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবে।

তারা বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষ হতে পারবে না। কথাগুলো এই জন্য বলা যে, শিক্ষকতার পেশা অন্যান্য পেশা থেকে শুধু আলাদাই নয়, অনেক বেশি জটিল ও স্পর্শকাতর।

পাঁচ.
শিক্ষকতার পেশার মর্যাদার প্রশ্ন বেতন আর পদোন্নতির সঙ্গে তেমন সম্পর্কিত নয়। কিন্তু আমরা বহুদিন ধরে শুনে আসছি যে, বেতন বৈষম্য থাকায় এবং পদোন্নতি না থাকায় সমাজে শিক্ষকদের তেমন কোনো মর্যাদা নেই। এ নিয়ে সব স্তরের শিক্ষকদের মধ্যেই কিছু না কিছু ক্ষোভ আছে। এবং সেই ক্ষোভের বহিপ্রকাশ আমরা প্রয়াসই দেখতে পাই। বেতন, পদোন্নতি এবং আরও বিচিত্র বঞ্চনা নিয়ে শিক্ষকদের এই ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো বিরোধ নেই; বরং আমি মনে করি, আর দশটি পেশা থেকে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বেশি হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর ২৫ নম্বর অধ্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এখানে প্রথমেই স্বীকার করা হয়েছে:

প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে (শিক্ষকদের) শিক্ষকতায় আগ্রহী এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয় গভীরভাবে বিবেচনাপূর্বক পুনর্বিন্যাস করা হবে যাতে তারা যথাযথ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন। একইভাবে শিক্ষকদের অধিকারের সঙ্গে তাদের দায়িত্বের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। শিক্ষকদেরকে (শিক্ষকদের) দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পাঠদানসহ তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হবে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ১১টি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে, বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে কিংবা পদোন্নতির সঙ্গে শিক্ষকদের মর্যাদার সম্পর্ক কতটুকু এ নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।

আমার বিশ্বাস, ব্যক্তি মানুষকে নিজের মর্যাদার জায়গা নিজেকেই তৈরি করতে হয়। সব পেশার মানুষের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। কিন্তু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, অধিকাংশ পেশায় বেতনাদি, পদপদবি, ক্ষমতা ইত্যাদি মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা হিসেবে, ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে কিংবা বিত্তশালি বলে সাময়িকভাবে মানুষ এদের সম্মান করে। এবং এরাও নিজেদের বেশ সম্মানিত মনে করেন। শিক্ষকদের এভাবে মর্যাদাবান হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের মর্যাদার প্রশ্নটি জড়িত দুটি বিষয়ের উপর। একটি হলো তারা শিক্ষক হিসেবে কেমন এবং দ্বিতীয়টি হলো তারা মানুষ হিসেবে কেমন।

ছয়.
একজন শিক্ষককে প্রথমেই ভালো শিক্ষক হতে হবে।  একসময় মনে করা হতো যে, একজন ভালো শিক্ষক মানে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী গুরুগম্ভির একজন মানুষ। শিক্ষার্থীরা কী বুঝল বা না বুঝল তাকে কিছুমাত্র বিবেচনায় না নিয়ে তিনি মনের আনন্দে বক্তৃতা দিবেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে রেখে ক্লাসের কাজ শেষ করবেন। শিখন-শেখানোর এই সনাতন পদ্ধতি এখনো বর্তমান আছে। এই পদ্ধতিতে যারা শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা কোনো অবস্থাতেই ভালো শিক্ষক নন। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) একটি চমৎকার কথা বলেছেন, the teacher teaches John Latin. মানে, শিক্ষককে শুধু ল্যাটিন জানলেই হবে না, তাকে  `জন’-কেও জানতে হবে। জনের সম্পর্কে জ্ঞান থাকা মানে হচ্ছে তার মনের গড়ন, প্রকৃতি, ক্ষমতা, তার আবেগ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা ইত্যাকার বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে শিক্ষকের পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা অপরিহার্য।

খুব ছোট একটি বাক্যের মধ্যে অ্যাডাম আধুনিক শিক্ষামনস্তত্ত্বের পুরো জগৎটিকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এক পরিমাপকে সকল শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব individual personality হিসেবে বিবেচনা করতে হয় এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র শিখনচাহিদাকে সন্তুষ্ঠ করতে হয়। শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করার যুগও শেষ হয়েছে। কেননা শিক্ষাবিজ্ঞানীগণ স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত ও সুনাগরিক করে তোলো যায় না। উপরন্তু এ ধরনের শাস্তি তার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয় ।

সুতরাং একজন ভালো শিক্ষক অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন যে, তার ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী যেন তার আচরণে বিব্রত না হয়, অপমানিত না হয়, মনোকষ্ট না পায়। বরং তার ক্লাসটি সকল শিক্ষার্থীর জন্য হবে আনন্দদায়ক। ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষকের নির্দেশনা মতো কথা বলবে, কাজ করবে, আঁকবে, দেখবে, পড়বে। অর্থাৎ শিক্ষকের কাজ হলো ক্লাসে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তিনি কোনো অবস্থাতেই বিবেচনায় রাখবেন না যে, কোন শিক্ষার্থীর ধর্মীয় পরিচয় কী, কোন শিক্ষার্থীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান কী, কোন শিক্ষার্থী দেখতে কেমন, কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী। তিনি শুধু বিবেচনায় রাখবেন যে, সকল শিক্ষার্থী তার ছাত্র বা ছাত্রী। এমন কি শিক্ষার্থীর লৈঙ্গিক পরিচও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তিনি সকলকে সমান চোখে দেখবেন এবং শিখনচাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী  শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। শিক্ষককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তার মনোযোগ ও স্নেহ থেকে কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিত না হয়। তিনি যেন কিছুতেই বৈষম্যমূলক আচরণ না করেন। ক্লাসরুমে তিনি এমন একটি বন্ধুর পরিবেশ তৈরি করবেন যেখানে সকল শিক্ষার্থী নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করবে।
একজন শিক্ষক সর্বদাই আশাবাদী মানুষ। তার চিন্তায়, কর্মে ও কথায় এবং তার সামগ্রিক জীবনাচরণে একজন আশাবাদী মানুষের পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদেরও তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। সুতরাং তার দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনের প্রতি কৌতূহল ও মমত্ববোধ তৈরি করা। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন তার অফুরন্ত সামর্থ্যরে সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, অফুরন্ত সম্ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে-  শিক্ষক তার সেই সম্ভাবনার দরজা-জানালাগুলো খুলে দেবেন। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে চিন্তার চর্চা করতে শেখাবেন আর সৃষ্টিশীল ভাবনার বিকাশ ঘটানোর পথ করে দেবেন। এই ভাবে তিনি মর্যাদাবান মানুষ হয়ে উঠবেন।

সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ভালো হবে, এমনটা আশা করা নিশ্চয় যৌক্তিক নয়, বাস্তবও নয়।  মেধার দিক থেকে কিছু শিক্ষার্থী দুর্বল slow learner, বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী মাঝারি mediocre learner এবং কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তম first learner। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ সময় সবচেয়ে বেশি যত্ন নেওয়া হয় উত্তম শিক্ষার্থীদের প্রতি। এটা অনেকাংশে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। আর দুর্বল শিক্ষার্থীরা শুধু অবহেলিতই থাকে না, তারা নানাভাবে লাঞ্ছিতও হয়। পরিবার-পরিজনেরে মধ্যে যেমন তারা অত্যাচারিত হয় তেমনি স্কুলেও তারা শিক্ষকদের মনোযোগ ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। এমন কি তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়। বিষয়টি যেন এমন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো না করতে পারলে মানবজীবন বৃথা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যারা শিক্ষার্থীদের বিবেচনা করেন, তারা কখনই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ, সম্মানের পাত্র- শিক্ষকগণ কিছুতেই তা বুঝতে চান না। বরং তারা শিক্ষার্থীদের  নানাভাবে লাঞ্ছিত করেন, অপমান করেন, মানসিক ও শারীরিক শাস্তি দিয়ে অস্তিত্বহীন করে তোলেন।

এ বিষয়ে একজন লেখক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শৈশবের একটি ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ ঘটনা তুলে ধরেছেন। ক্লাসে অংক ভুল হওয়ায় এই পরিস্থিতি  তৈরি হয়েছিল। স্যার আবার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হাত পাত।
প্রচণ্ড ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম কিছু বোঝার আগেই ভয়ে আমার হাত এগিয়ে গেল। ঠিক তখন আমার নিজের উপর এত লজ্জা আর ঘেন্না হল যে বলার মত নয়। মনে হল আমি এত নীচ জঘন্য একটা প্রাণী, আমি বেঁচে আছি কেন? মানুষকে ধ্বংস করে দিতে হলে তাকে মনে হয় অপমান করতে হয়-৷ সবারই সামনে করতে হয়। শুধু ব্যথা নয় তার সাথে সম্পূর্ণ নূতন একটা অনুভূতি যেটার সঙ্গে আমি পরিচিত নই। অনুভূতিটার নাম অপমান, আমার চার পাঁচ বছরের ছোট জীবনটিতে এর আগে কেউ অপমান করেনি।

লেখকের এই শিক্ষক নিশ্চয় বেঁচে নেই। এক জীবনে লেখক কি এই শিক্ষককে কখনো সম্মান করতে পেরেছেন? নিশ্চয় পারেননি। এবং এ ধরনের শিক্ষক কখনই মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের কাছে তারা ঘৃণার পাত্র। শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সম্মানের স্থান হলো তাদের শিক্ষার্থী। সেই শিক্ষার্থীরাই যদি তাদের ঘৃণা করে তা হলে সমাজের আর কোথাও তাদের মর্যাদা পাওয়ার  সুযোগ নেই। সুতরাং শিক্ষকগণ যদি মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হতে চান, তাহলে প্রথমেই মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মনোজগতের দিকে।

আবার অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। তাদের এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূলে আছে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের মমত্ববোধ। তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাদের বিবেচনায় রাখেন এবং শিক্ষার্থীদের সকল সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে প্রশংসা করেন। তারা সব ধরনের শিক্ষার্থীকে ক্লাসে অংশগ্রহণ করার পরিবেশ তৈরি করেন। এবং ক্লাসরুমটিকে আনন্দঘন করে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রণিত হয় এবং আনন্দের সঙ্গে শিখন-শেখানো কর্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার শক্তি লাভ করে। ফলে এই ধরনের শিক্ষকগণ সর্বদা সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন।

শিক্ষক বিপুল পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কিন্তু তিনি সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। তিনি কিছুতেই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। তাকে অবশ্যই শিক্ষার লক্ষ্য aims of education, শিক্ষার বিষয়বস্তু subject matter of education, শিক্ষার পদ্ধতি methods of teaching এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি assessment strategy সম্পর্কে  পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। তাহলে তিনি চমৎকারভাবে একটি ফলপ্রসু শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন এবং সকল শিক্ষার্থী উপকৃত হবে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুতির কথা একেবারেই ভুলে বসে আছেন। তারা মনে করেন, শিক্ষকতার জন্য কিছুই করতে হয় না। ফলে তারা শিক্ষক ছাড়া আর সবই হন অথবা কিছুই হন না। অনেকে মাতাব্বর হন, মোড়ল হন, পলিটিশিয়ান হন, ব্যাবসায়ী হন, কৃষক হন, চাকরিজীবী হন কিন্তু কিছুতেই শিক্ষক হতে পারেন না এবং কোনো রকম মর্যাদার আসনও লাভ করেন না। অথচ এরা সারাক্ষণ বলে বেড়ান যে, শিক্ষকদের কোনো মর্যাদা নেই এবং শিক্ষকতা হলো একটি বাজে পেশা।

অমর্ত্য সেন তাঁর জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি নামক গ্রন্থে commodity fetishism বা পণ্যমোহবদ্ধতা বলে একটি অভিধা ব্যবহার করেছেন। এই অভিধাটি তিনি নিয়েছেন কালমর্কস-এর দর্শন থেকে। এর মানে হলো ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পণ্যের প্রতি মানুষের লোভাতুরতা যা অনেক সময় অসুস্থতার পর্যায়ে উপনীত হয়। একবিংশ শতকে এসে আমরা লক্ষ করছি যে, পণ্যের কাছে এখন মানবিক মূল্যবোধগুলো পরাস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকও এখন পণ্যমোহাবদ্ধ হয়ে উঠেছেন। ফলে কতভাবে টাকা উপার্জন করা যায় এবং আর দশজন অশিক্ষক মানুষের মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যায় তার চেষ্টায় তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে তারা শিক্ষকের মর্যাদার আসন থেকে নেমে আর দশজন মানুষের কাতারে কিংবা তারও নিচে নেমে গেছেন। তাদের এই পণ্যমোহবদ্ধতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। একটি সেবার পেশাকে তারা ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে তাদের সময় কিনে নিচ্ছে এবং সেই কিনে নেওয়া সময় যথাযথভাবে দেওয়ার জন্য শিক্ষকগণ দৌড়ের উপর থাকছেন-  কোচিং থেকে দৌড় দিচ্ছেন ক্লাসে আর ক্লাস থেকে দৌড় দিচ্ছেন কোচিং-এ, কিংবা নানা রকম কন্সালটেন্সি, নানা রকম পদপদবি বাগিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকছেন। এই জীবন সম্মানের হতে পারে না-  না শিক্ষার্থীদের কাছে, না সমাজের অন্য সদস্যদের কাছে।

অথচ কথা ছিল, তাদের দরজা সকল শিক্ষার্থীর জন্য সব সময় খোলা থাকবে এবং সন্তান-সন্ততির মতো তারা শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো রকম আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন না। তারা সংসার চালাবেন বেতনের টাকা দিয়ে-  তাতে যত সমস্যাই হোক না কেন। এবং পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে, নিষ্ঠায়, সততায় ও ন্যায়পরায়ণতায় তিনি হবেন আদর্শস্থানীয়। শিক্ষকের ঘর আসবাবপত্র ও নানা রকম পণ্যে ঠাসা থাকবে না। তার ঘরে থাকবে বই আর বই। তা হলেই তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে এবং সমাজের কাছে সম্মানীত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, সম্মানীত হতে পারতেন। এবং এই পথে আমাদের সম্মান আমাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ