শাহাদাৎ হোসেনের কবিতা ‘কারবালা’
পুনর্মুদ্রণ
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রেডিও ব্যক্তিত্ব শাহাদাৎ হোসেনের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৫৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৮৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার অন্তর্গত পন্ডিতপোল গ্রামে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘কারবালা’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
দীর্ঘ রাত্রি অবসান
নিশীথের ঘনকৃষ্ণ রেখা-নেকাব
সরে যায় খুনরাঙা অরুণের আসন্ন আভাস।
নিখিলের তন্দ্রাতুর নিমীল নয়ন
খুলে যায় খঞ্জর-ঝঝনে।
আতংক-কম্পনে
সপ্রকাশ দিগন্ত প্রান্তর।
এ যে রে মরণ-পন্থে মদিনার যাত্রী-রাহীদল ।
কুফার মঞ্জেল কোথা— কোথা এ প্রান্তর ?
ধু-ধু-ধু-ধু-বালুস্থান
কারবালার অন্তহীন অনির্দেশ বিপুল প্রসার
অরাতির চক্রব্যুহে ঘেরা
লক্ষ্যহারা কাফেলার মৃত্যুময় সংকটের দুস্তর পাথার।
একান্তে জীবনধারা বাহিনী ফোরাত
ঘেরি তারে রচিয়াছে দুর্ভেদ প্রাচীর
দামেস্কের দাগাবাজ দাজ্জালের দল।
অলক্ষ্যে নিয়তি হাসে অট্ট ক্রুর হাসি,
জটাবন্ধে আজরাইল হাঁকে মহামার
খান্দানে-রসূল আজি জেহাদের সেরা শহীদান
তাজা খুনে লাল হবে কারবালার বালু-বিয়াবান।
দামামার ডামাডোলে মৃত্যুর মাতম
খঞ্জরে চিকুর-জ্বালা হানে জঙ্গী রক্ত-মাতোয়াল,
বিষাক্ত শায়কে হানে শক্তিশেল ক্ষিপ্র তীরন্দাজ।
হানাহানি মহামার
রক্তগঙ্গা একাকার
ভলু-তীর অসি-বর্মে মারণ-সংঘাত।
উচ্ছখল কলরোলে, হুংকার গর্জন
দিগন্ত-দুনিয়া দোলে শূন্য চৌচির
পাংশুনীল দিনকর।
সিয়া আসমান
অন্ধকার জ্যোতিলোক—আসন্ন প্রলয় ।
বাড়ে বেলা–
দণ্ড পল প্রহরের জ্বলন্ত জ্বালায়।
আকাশের কেন্দ্ৰপীঠে বহ্নি-গোলা ঝলে
জ্যোতিষ্কমণ্ডল পুড়ে শূন্য ছারখার
নিম্নে বালু-স্ফুলিঙ্গের প্রান্তর-পাথারে
হাবিয়ার অগ্নি-জ্বালা জ্বলে,
বহ্নি সিমুম-ঝন্ঝায়
মৃত্যুময়ী পিপাসার প্রাণান্ত দাহনে
জবে-করা কবুতর-পারী।
আছাড়িপিছাড়ি লুটে খিমার জিন্দানে
সর্বহারা মদিনার রিক্ত রাহীদল।
মাতমের মহারোলে
কণ্ঠে কণ্ঠে আহাজারি করুণার কাতর ক্রন্দন
পতিহারা সতী কাঁদে, পুত্রহারা মাতা,
কাঁদে শিশু, বৃদ্ধ পিতা,
কারুণ্যের প্রতিচ্ছবি কাঁদে সহোদরা
অশান্ত কান্নার রোলে কেঁদে ওঠে সারা মরুস্তান—
দিগন্ত – জাহান।
সপ্তস্তর আকাশের মূলে।
আল্লার আরশ কাঁদে
ফেরেশতার চোখে ঝরে কাদনের স্রোতস্বিনী ধারা।
হুংকারি জাগিল শের ক্ষিপ্ত মহাকাল
বিষক্ষতে দুঃসহ জ্বালায়,
রুদ্রকণ্ঠে হাঁকিল হোসেন
হায়দারে-কারার আলী-মোর্তজার কেশরী-সন্তান!
ব্যোম-পৃথী আতংকে শিহরি।
বলুন্তান কাপে বিয়াবান
দিক্ হস্তী দিগন্তে লুকায়
মহাত্রাস ত্রাহি ত্রাহি রোলে
এস্রাফিল বিষাণ ফুকারে
কেয়ামত সম্মুখে ঘনায়।
তরঙ্গ-তুফান-দোলা রক্তের হাম্মামে।
স্নান করি জাগে রুদ্র মদিনার কালান্ত শার্দুল
ছিন্নশির কবন্ধের তুঙ্গ পিরামিডে
দেখা দিল দুলদুল্-বাহনে।
শিরে শুভ্র আমামার তাজ
করে জুলফিকার
শ্বেত অশ্ব—বোরাকের সিংহ-আসোয়ার
জ্বজ্যোতি মধ্যাহ্ন তপন
দেখা দিল কার্বালার উদয়-শিখরে ।
মহামার জাগিল আবার,
দু’ধারী খঞ্জর চলে
দুর্নিবার নাঙ্গা হাতিয়ার।
খণ্ডে খণ্ডে লুটে শির, কবন্ধ লুটায়,
ঝন্ঝাবাতে উন্মুল বিটপী।
খুনের পিচকারি ছোটে রাঙিয়া আকাশ
মুহূর্তে আবির-লাল জ্যোতিষ্ফলা ভাস্কর-মণ্ডল।
প্রাচীর ধ্বসিয়া পড়ে ফোরাতের কূলে,
মুক্তপথ—তুরঙ্গমে ছোটে আসোয়ার।
সম্মুখে জীবন-ধারা যুগান্ত বাহিনী।
নীল স্বচ্ছ দূর-বিসর্পিনী,
নিথর তরঙ্গে বহে কূলে-কূলে-ভরা।
মৃত্যুময়ী পিপাসার দুর্বার জ্বলনে।
মুহূর্তের আত্ম-বিস্মরণ—
গষে শুষিয়া লবে সমগ্র ফোরাত ।
অঞ্জলি ভরিল জলে
আচম্বিতে জেগে ওঠে হারানো সম্বিৎ
মরণের পূর্ণপাত্র নিঃশেষে করেছে পান
মহাত্রাস ত্রাহি ত্রাহি রোলে
এস্রাফিল বিষাণ ফুকারে
কেয়ামত সম্মুখে ঘনায়।
তরঙ্গ-তুফান-দোলা রক্তের হাম্মামে।
স্নান করি জাগে রুদ্র মদিনার কালান্ত শার্দুল
ছিন্নশির কবন্ধের তুঙ্গ পিরামিডে
দেখা দিল দুলদুল্-বাহনে।
শিরে শুভ্র আমামার তাজ
করে জুলফিকার
শ্বেত অশ্ব—বোরাকের সিংহ-আসোয়ার
জ্বজ্যোতি মধ্যাহ্ন তপন
দেখা দিল কার্বালার উদয়-শিখরে ।
মহামার জাগিল আবার,
দু’ধারী খঞ্জর চলে
দুর্নিবার নাঙ্গা হাতিয়ার।
খণ্ডে খণ্ডে লুটে শির, কবন্ধ লুটায়,
ঝন্ঝাবাতে উন্মুল বিটপী।
খুনের পিচকারি ছোটে রাঙিয়া আকাশ
মুহূর্তে আবির-লাল জ্যোতিষ্ফলা ভাস্কর-মণ্ডল।
প্রাচীর ধ্বসিয়া পড়ে ফোরাতের কূলে,
মুক্তপথ—তুরঙ্গমে ছোটে আসোয়ার।
সম্মুখে জীবন-ধারা যুগান্ত বাহিনী।
নীল স্বচ্ছ দূর-বিসর্পিনী,
নিথর তরঙ্গে বহে কূলে-কূলে-ভরা।
মৃত্যুময়ী পিপাসার দুর্বার জ্বলনে।
মুহূর্তের আত্ম-বিস্মরণ—
গষে শুষিয়া লবে সমগ্র ফোরাত ।
অঞ্জলি ভরিল জলে
আচম্বিতে জেগে ওঠে হারানো সম্বিৎ
মরণের পূর্ণপাত্র নিঃশেষে করেছে পান
শূন্য-ব্যোম-বায়ুস্তরে করুণার আকুল ক্রন্দন
কাঁদে জিন, হুর-পরী কাঁদে মিকাইল
আকাশের অন্তরালে শিঙা-হাতে কাঁদে এস্রাফিল
দিগন্ত জাহান ভরি কান্না-উতরোলে
রোনাজারি ভিন্ন হায়! হায়!
নূরনবী মোস্তফার নয়নের মণি নিভে যায় ।
সে-কান্নার চিরন্তন করুণার রোলে
আজিও গুমরি ফিরে নিখিলের শূন্য
বিয়াবানে।
অনন্তের প্রান্তর-পাথারে
বৃথায় খুঁজিয়া মরে মদিনার সিংহ-শহীদেরে !
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত শাহাদাৎ হোসেনের কবিতা সংকলন থেকে