শাহাদাত তৈয়বের কলাম ‘কওমিদের সীমাবদ্ধতা ও পশ্চাৎপদতা’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০২, ২০২১

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেদের পর্যালোচনা করতে সক্ষম হওয়া। কওমিদের নিজেদের কী কী সীমাবদ্ধতা আছে, এটা তারা কি সত্যিকার অর্থেই বিচার করতে আন্তরিক? কি মনে হয়? বলা হয়, তারাই একমাত্র সত্যিকার ইলমের চর্চা করেন। এখন সত্যিকার ইলম কোনটা এইটা বিতর্ক করার চাইতেও বড় প্রশ্ন হইল, উনাদের একটা লাইন আছে, সিলসিলা আছে সন্দেহ নাই, এই ইলমি সিলসিলাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সিলসিলার সর্বশেষ তারাক্কি বা ডেভেলপমেন্ট কি? আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।

দুনিয়ার আরসব ইসলামি ধারার শিক্ষা কাঠামোর প্রতিযোগিতার লাইনে এই কওমি ধারা বিশেষত বাঙলাদেশের কওমি ধারার অবস্থান এখন কোথায়? তারা কতদূর আগাইছে অন্যান্য ইসলামি ধারার শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায়? পঞ্চাশ বছরের একটা কালপর্ব ধরলে কওমি ধারা থেকে কয়টি গবেষণা বের হয়েছে, কয়টি উচ্চমাপের ইলমি কাজ হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক ইসলামি অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। যেমন দেওবন্দ, নদওয়া, আল আজহার, সিরিয়া, মাদিনা, উম্মুল কোররা তুরস্ক,, মালয়েশিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া।

এছাড়া পশ্চিমা দেশের ইসলামিক প্রতিষ্ঠান বা ফ্যাকাল্টি ও ইনস্টিটিউশানগুলোর কথা বাদই দিলাম। ফিকহ, উসুল, হাদিস, তাফসির, সিরাত, সিয়াসাহ (রাজনীতি), ইকতিসাদ (অর্থনীতি), সাকাফাহ (সংস্কৃতি) আদাব (সাহিত্য), কালাম-ফালসাফাহ (কালাম ও দর্শন) তারিখ (ইতিহাস) হানদাসাহ (প্রকৌশল) এমন অনেক বিষয়ে অনেক জায়গায় আজকের কনটেক্সটে অনেক কাজ হয়ে গেছে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়াগুলোতে। অনেক ইন্টেলেকচুয়াল রাইটিংস, ভালো মানের বিশ্লেষণমূলক বহু কাজ মিশর, তুর্কি, পাকিস্তান, এমন কি পাশের দেশের কওমিদের ইলমি কেবলা খোদ দেওবন্দে ও নদওয়ায় বের হচ্ছে।

কিন্তু বাঙলাদেশের কওমিতে কি হচ্ছে? তাদের নিজেদের একটা বইমেলা হইলে জাতি সেটা দেখতে পাইতো হয়তো। বাংলাবাজারে আমি যাই, ওখানে বিদেশি বেশকিছু মাকতাব দেখা যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশি কওমিদের পাঠের আগ্রহ যে বাড়ছে, এটা হয়ত তার আলামত। এটা অবশ্য ভালো একটা দিক। কিন্তু এরপাশে কওমিদের দেশীয় প্রকাশনাও রয়েছে সেগুলোতে নতুন কি আসছে যা আসলেই বিশ্বমানের? কয়টি আরবি কিতাব তারা লিখতে সক্ষম হয়েছে? কয়টি ইংরেজি কাজ করতে তারা সক্ষম হয়েছে, এসবই প্রশ্ন।

তারা যে জ্ঞান, ইলম এবং একটা জীবন যাপন করছে তার একটা দলিল থাকা দরকার। তারা যেটা ভাবছে, যেটা উৎপাদন করছে তার ভিত্তিতে ভাষাগত উৎপাদনের সমৃদ্ধি কোথায়? চিন্তাগুলোর সামাজিক নজির বা সাহিত্য কোথায়? কওমি মাদরাসায় যে ইলম চর্চা হয় সেটা যে ইসলামি জ্ঞান, তার সামাজিক উদযাপন কোথায়— এই উদযাপন যে ভাষায় করা লাগে সেই বাংলা মাতৃভাষা তো কওমিতে গত ত্রিশ বছর আগে প্রায় অদৃশ্য ছিল, এরপর সেখানে সৌভাগ্রক্রমে এরশাদ সরকারের আমলে একজন আলী হাসান আলী নদভীর আগমন হইছিল, যিনি মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টির উপর গুরুত্বারোপ ও নসিহত না করলে আজকে কি হইতো, ভাবা যায়?

ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, যেনবা তিনি না কইলে তারা বাঙলা ভাষায় এলম চর্চার বিষয়টা ভাবতেন না। আর এভাবেই রয়ে যেত কওমি অঙ্গন। যেন একটা নাইন ইলেভেন না হইলে মাদরাসাগুলোতে এই অদ্ভুত ডেভেলপমেন্ট হইত না। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর কওমি মাদরাসাগুলো বাঙলা ইংরেজি, গণিত, ইসলামি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি-ইতিহাস ধীরে ধীরে পাঠ্যভুক্ত হইতে থাকিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হইল, ইসলামের ইতিহাসই এসব মাদরাসায় পড়ানো হইত না। ১৯৯৮ সালে চৌধুরী মাদরাসায় হেদায়াতুন্নাহু পড়ার সময় তখন একজন হুজুর (তিনি সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকতা করতেন, তো তিনি নিজে কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে একটা ইতিহাসের বই পড়ানো শুরু করছিলেন) ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে একটা ছোট্ট বই পড়াইতেন বাংলা ভাষায়। এরপরের ক্লাসগুলোতে ইতিাহাসের কোনো বইই আর দেখিনি। না বাঙলা, না উর্দু না ফার্সি, না আরবি। নিজেদের ইতিহাসই নিজেরা পড়ছে না। এর চাইতে জঘন্য অপরাধ আর নাই।

প্রশ্ন হইল, ত্রিশ বছর আগে কওমি মাদরাসাগুলোতে কেন বাংলা উপেক্ষিত ছিল? তার মানে কয়কশো বছর বাংলা এই কওমিতে উপিক্ষিত ছিল? এর বিচার হওয়া উচিত। কেন বাংলা ভাষা এই মাদরাসাগুলোয় উপেক্ষিত ছিল, তার জবাব এখন কড়াগণ্ডায় এই কওমিদেরকে গুণতে হচ্ছে নিজের অজান্তে। সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক যেকোনো বিচারে তারা এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্য করে যাচ্ছে। কেউ হয়তো সেটা উপলব্ধি করছেন। আবার হয়তো অনেকে সেটা বুঝতেই পারছেন না। যাইহোক তার জবাব একদিন রোজ হাশরেও দিতে হবে। কারণ এটা স্রেফ অপরাধ। ভয়াবহ অপরাধ। জাস্ট পাপ। আপনি কলোনিয়াল রেজিস্ট্যান্স এর দোহাই দেবেন? এসব দোহাই দিয়া পার পাওয়া যাবে না। বিচার হইতেই হবে। আর এর সব থেকে বড় কাফফারা শুরু হতে পারে নিজেদের ইহতেছাব আত্মসমালোচনা করার মধ্য দিয়া।

আমি প্রায়ই শুনি, তারা মাদরাসার দরস তাদরিস আর ওয়াজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের এসব লেখালিখিতে সময় পান না। তো এই প্রশ্ন কি নিছকই অজুহাত নয়? যে ইসলাম তৈরি করেছিল বিশ্বব্যাপী প্রবল সভ্যতা তার জ্ঞানগত কাঠামো ও গতি প্রক্রিয়া লেখালিখি ছাড়া এমনি এমনি হয়ে গেছে? ঠিকাছে, লেখার কথা বাদ দিলে গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত চরিত্র কিংবা সমাজে প্রবল প্রতাপশালী ইসলামি ব্যক্তিত্ব কোথায়? অল্প কয়জনের কথা বাদ দিলে যেমন, ফখরে বাঙাল মাওলানা তাজ, শামছুল হক ফরিদপুরি রহ, মেখলের মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ, হাফেজ্জি হুজুর রহ, হারুন ইসলামাবাদী, মুফতি আমীনী রহ. এরকম ফিগার খুব কম। তা যদি ভারত পাকিস্তানের সাথে তুলনা করা যায়, তাতে শুধু হতাশ হতে হবে।

যাইহোক, তারা যে একেবারে লেখেন না তা নয়, লেখেন সেগুলো এই সমাজের পাঠকের কতেটা মাছলেহাত পয়দা করতে পারে আল্লাহ মালুম। দরসি কিতাব ছাড়া সমাজ ও জীবনঘনিষ্ট লেখা বিরল। কিছু মোটিভিশনাল লেখাপত্র দেখা যায়। এখন যারা লিখতে আসছেন তারা বড় একটা তরুণ কওমি। এটা অবশ্যই আশার জায়গা। কিন্তু আমার প্রশ্নটা আসলে বৃহত্তর কওমি শিক্ষায়তনে প্রতিযোগিতামূলক এমন কি কাজ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক বিবেচনায়? কওমি শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে প্রবলভাবে অনুপস্থিত গবেষণার বিষয়-আশয়। গবেষণা যে শিক্ষার একটা নিয়মতান্ত্রিক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ এমনকি উদ্দেশ্যও, সেটা তার শিক্ষার কাঠামোর মধ্যেই নাই। এগুলো তাদের নিরন্তর প্রশ্ন করে যেতে হবে। নিজেদের হাজার বছরের পুরানা সিলাসিলা পুজার জগদ্দল না ভাঙতে পারলে, আকাবির নামক আজব ফ্যান্টাসি পুজা (আক্ষরিক অর্থে আকাবির বিরোধী না, কিন্তু পুজা বিরোধী) না ভাঙতে পারলে এই সমাজে তারা কোনোভাবেই খাড়া হইতে পারবে না।

জ্ঞানচর্চা শুধু জ্ঞান বোঝায় না, আপনার নিজেকে এই সময়ে কতটা প্রতিনিধিত্বশীল করে তুলতে হবে, সেটা যেকোনো বিবেচনায় হোক না কেন, সেটার বেইজ জ্ঞানগত বা বোঝাবুঝির মালাকাহ ও মাহারাতের মধ্য দিয়াই তৈয়ার করে নিতে হয়। এর সাথে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে যেকোনো ধরনের নেতৃত্বের কথা বলেন তার অভিমুখ ওই জায়গটা থেকেই তৈরি করে নিতে হয়। কাজেই, নিজেদের আত্মসমালোচনার অপশনগুলো কি কি, সেগুলো চিহ্নিত করুন। সেগুলা উৎরানোর উদ্যোগ ও কোশেশও শুরু করে দিতে হবে।