শাহ সাজ্জাদের গল্প ‘কী তোমার পরিচয়’
প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০২৩
রমজান মাসে বেলা দুইটা থেকে ইফতারির আগমুহূর্ত পর্যন্ত লম্বা সময়। অফিস থেকে বাসায় ফিরে, আধঘণ্টার মধ্যে আমার এক কলিগ, সেলিমের বাসার উদ্দেশ্যে উত্তরায় রওনা হই। নীলিমা, আমার স্ত্রী ইফতারির আয়োজনে ব্যস্ত, আর আমার ছয় বছরের কন্যা সুষমা কোনও এক প্রতিবেশীর বাসায়, হয়তো। বউ বলতে পারে। যদিও আশপাশে আমার মেয়ের বয়সি তার কোনও বন্ধুবান্ধবী নাই, তবুও প্রতিবেশীরা তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমার মেয়ে অনেক কথা বলে। হয়তো এটাই একটা কারণ।
আমার মেয়ের খোশগল্পে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়। আমি আর আমার স্ত্রী বাসায় খুব কম কথা বলি। হয়তো এই শূন্যস্থান পূরণ করার দায়িত্ব নিয়েছে সুষমা। আর এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাসা থেকে বের হবার পথে বউ পাকা পেঁপে আনতে বলল। পেঁপে না বাসায় ছিল? প্রশ্নটা অবশ্য মনে মনে করেছিলাম। কারণ আমি জানি, যখন অবসর মুহূর্তে কোথাও বের হই তখন দিয়াশলাই থেকে শুরু করে ছোটখাটো নিত্য প্রয়োজনীয় কোনও না কোনও সংসারের সদাই আমার স্ত্রী আগাম আনিয়ে রাখে। আমাদের গুছানো সংসার।
সেলিম বাসায় ছিল না। অগত্যা ভাবির সাথে দুই একটা কথা বলে বের হয়ে আসি। মলিন মুখে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই মেয়েটাকে চোখে পড়লো। চাকরিজীবীদের ট্রেড মার্ক যেমন হটপট, ডায়রী, ফাইলপত্র ইত্যাদি সাথে আরও দুজন, যারা স্বভাবগতভাবে একটু দৃষ্টি আকর্ষণীয় আরচণে হৈ হল্লা করে এয়ারর্পোট বাস স্টপেজ থেকে উঠে বাস ড্রাইভারের আড়াআড়ি বসলো। মেয়েটির চেহারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, কিন্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো না। মেয়েটিকে দেখে ‘গোবরে পদ্মফুল’ উক্তিটা মাথায় আসলো, কিন্তু ঠিক হলো না। কারণ তার সাথের সঙ্গীরাও পদ্মফুল। আবার তাদের মধ্যে সে কোথাও একটু আলাদা। কেন জানি মনে হলো, এই সুশ্রী মেয়েটি হয়তো কঠিন কোনও বাস্তব মোকাবেলা করছে। ভালো করে লক্ষ্য করতে শুরু করলাম।
বাস ড্রাইভারের আড়াআড়ি বসে থাকায় আমি শুধু মেয়েটির মুখপার্শ্ব দেখতে পারছি। ভুরু বেশ টানা টানা। সব মেয়েরা যদি এরকম ভুরু নিয়ে জন্ম নিত তাহলে হয়ত ভুরু প্লাক শব্দটিই সৃষ্টি হতো না। চোখের পাপড়ি ঘন ও প্রসার। সরু নাক ও কিঞ্চিত মোটা ঠোঁট মিলে তার মুখের এক অপূর্ব সমন্বয়। আচ্ছা, মহিলাটা যখন হাসে তখন কি তার চেহারার বিকৃতি ঘটে? এমনটাও হয়।
কে তুমি? কি তোমার পরিচয়? কল্পনা করতে শুরু করলাম, যে কল্পনা বিয়ের আগেও করতাম। আমার স্ত্রী বলে, কলেজ জীবনে আমার মলিন মুখ নাকি তাকে খুব বিচলিত করতো। তার নাকি জানতে ইচ্ছা করতো কি আমার পরিচয়? কেন আমি এত দুঃখী! আমাদের পরিচয় পর্বের পর নীলিমা যখন জানলো শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন ঝুটঝামেলা ছাড়া আমার জীবনে তেমন কোনও কালবৈশাখীর ঝড় ওঠেনি, তখন সে নিজের জীবনের গল্প বলতে শুরু করলো। নীলিমার জীবন আমার জীবনের প্রতিফলন মাত্র। তবে এ সুবাদে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকত। আবার এদিকে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে অলৌকিক আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া গেল। যা সচরাচর মফস্বল শহরে বিদ্যমান। আমাদের দুই পরিবারের মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবী নীলিমার সাথে আমার সম্পর্কে খুব সন্তুষ্ট। বন্ধুরা বলতে লাগল, ভালো একটা মেয়েকে আমি ভালবেসেছি। আমার অস্বীকৃতি, হাসি ঠাট্টার তলে চাপা পড়লো। আমি নাকি ছোটবেলা থেকে লাজুক প্রকৃতির। ভালবাসার শেষ অধ্যায় বৈবাহিক জীবনে এসে ভালবাসা কি, তার অভিসন্দর্ভ বা অর্থ খুঁজে বের করার কোনও প্রয়োজন বোধ করলাম না। মলিন মুখে সংসার করতে থাকলাম। নীলিমার মুখও এখন মলিন। আমরা সুখেই আছি।
জ্যাম হওয়াতে আশপাশের যাত্রীর বিরক্তের ঝড় উঠল। মেয়েটির জগতে আমার উপস্থিতের কিছু একটা সংকেত থাকতে হয়। একবার ভাবলাম, ট্রাফিক জ্যামের উপকারিতা (উৎকর্য) তুলে ধরি। ধরাকে সরা জ্ঞান করা যাকে বলে, কারণ যেখানে এদেশের প্রেক্ষাপটে যদি চাকরি নিশ্চিত করার জন্য নকল আর ঘুষ প্রায় বৈধকরণ হতে যাচ্ছিল, আমি তো শুধু কাউকে কাছে পাওয়ার জন্য জ্যামকে স্বাগত জানাতে চাচ্ছি। এদিকে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সেলফোনটি বের করে সেলফোন নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। আর মন্ত্র পড়ে প্রহর গুনতে থাকলাম। এই মুহূর্তে যদি কেউ কল করত। সেলিমের কল আসার সম্ভাবনা শূন্য। অসীম ধৈর্য্যশীল সেলিম। আগামীকাল অফিসে দেখা হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তার মনে কোনও লেশমাত্র চিন্তাভাবনা আসবে না। মিসাল ঘুরে গেল, কোন ব্যাপার? আমাদের যাওয়া আসা এখন সুবিদিত পর্যায়, হয়তো এটা একটা কারণ। আচ্ছা, টেলিপ্যাথি যদি বাস্তব হতো, তাহলে আমার সবচেয়ের অপছন্দের মানুষ যেমন আমার মামা শ্বশুরকে দিয়ে হলেও কল করানো যেত। আমার মামা শ্বশুর সমাজের যোগ্য উত্তরসূরী ধনে মানে গুনে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সংসারে তিনি রস খুঁজে পান না। প্রায়ই তিনি পরিজন সমাবেশ করেন, এবং আমার সাথে শালা দুলাভাইয়ের সর্ম্পকের ন্যায় হাসি ঠাট্টা করেন। মামা শ্বশুর দাওয়াত দিলে আমাদের বাসায় কিছুটা ঈদের আমেজ আসে। নীলিমা আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাতের এই সুযোগ সহজে হাতছাড়া করতে চায় না। এদিকে আবার আমাকে ছাড়া সে কোথাও যাবেও না। হয়তো এটাই একটা কারণ। আমিও কোনও দিন নীলিমাকে এ ব্যাপারে কোনও কটুক্তি করিনি।
আচ্ছা, প্রায় সময়ই তো বাস কন্ডাক্টার দুই তিনবার করে ভাড়া চেয়ে থাকে। এটা ওদের এক ধরনের সিস্টেম বা অভ্যাস, যাতে যেসব যাত্রী বাজেট রক্ষার্থে ভাড়া না দেয়ার মতলব আঁটে, তাদের মধ্যে বেশ কিছুজন দ্বিতীয়বার ভাড়া চাইলে, লজ্জায় বা বিবেকের তাড়নায় নানা অজুহাতে ভাড়া দিয়ে দেয়। এতে কন্ডাক্টারদের লস মিনিমাইজ হয় বা করতে পারে। আমরা যারা সচরাচর ভাড়া দিয়ে থাকি, মোটামুটিভাবে সয়ে নিয়েছি। তবে কিছু চয়েসফুল বকাঝকা স্টকে থাকে যেটা আবার তাদেরও সয়ে গেছে। এটা একটা দুষ্টচক্র’ যার সমাধান হয়ত টিকিট সিস্টেম এ ছিল। কেন এদের টিকিট সিসটেম নাই তা বলতে পারব না। আজকে যাত্রী কম থাকায় বাস কন্ডাক্টারকে সিস্টেম চালু করতে হয়নি। বকাঝকা করে মহিলাটির দৃষ্টি আমার দিকে ভেরানো যেত। সামনের অনেক সিট ফাঁকা পড়ে ছিল। উঠে গিয়ে সামনে বসবো ভাবতে ভাবতে মেয়েটি হঠাৎ পাশে ফিরে মিষ্টি হাসি দিয়ে তার কলিগদের উদ্দেশ্য কি যেন বলল। অপূর্ব !!! ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো। এই যোগসূত্র অবশ্যই উপরের কোনও ইশারা।
মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। আমার মন বাসের জানালা দিয়ে গাড়িঘোড়া দালানকোঠা ছাড়িয়ে কোনও এক নদীতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। আশ্চর্য ব্যাপার, আমার ভগ্নমনস্কতার জগতে আমি যে রকম নানা নদীর তীরে বসে নদী উপভোগ করতাম, আজকে কেন জানি আমার এই জগৎ, আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমি দেখলাম, আমি নদীর উপরে পাখির ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর নদীর তীরে নীলিমা ও সুষমা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
ট্রাফিক জ্যাম ছাড়লো। মহাখালীতে বাস দাঁড়াতেই মেয়েটি আর তার সংগীরা উঠে দাঁড়ালো। আমার গন্তব্যও মহাখালী, খুশি হয়ে নামলাম। আর খুশি হয়ে গেলাম যখন দেখলাম মেয়েটির সাথের কলিগ দুইজন আলাদা রাস্তা ধরল। আমিও পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিস্তেজ হয়ে গেলাম। ঘুরে বাজারের দিকে রওয়ানা হই। পরিচিত দোকানদারকে একটা ভাল মিষ্টি পেঁপে দিতে বললাম । আর বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, পেঁপে মিষ্টি না হলে কিন্তু তোর ভাবি সব তরকারি পেঁপে দিয়ে পাকাবে। দোকানদার গদগদ হয়ে গেল আর বলল, স্যার, আপনে ভাবিকে খুব ভালবাসেন, তাই না?
আমি নির্বিকার তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। অবশেষে আস্তে করে বললাম, গাধা, তোর ভাবি যদি আমাকে সেটা মনে না করায়ে দিত, তাহলে আজ তোর এই পেঁপে বেচা হতো না...