শারমীন সুলতানার গদ্য ‘মহুয়ার ঘ্রাণ পাঠের পর’
প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২২
সৃজনশীল মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, নিজেকে বারবার অতিক্রম করা। সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে নতুন করে আবিষ্কার করেন তিনি। নিজেকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সত্যিকারের লেখক।
বর্তমান সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। সম্প্রতি বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত তার উপন্যাস `মহুয়ার ঘ্রাণ` পড়ে শেষ করলাম। তার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হলো, একেবারে শিকড় থেকে গল্পগুলো তুলে এনে তিনি বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলেন। তার ভাষার বৈচিত্র্য, শব্দের ঝংকার পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে টানে। তিনি মিথলজি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমসাময়িক ঘটনার এমন এক মেলবন্ধন তৈরি করেন, তা সমকালীন কথাসাহিত্যে একেবারেই ব্যতিক্রম।
`মহুয়ার ঘ্রাণ` উপন্যাসে দেখতে পাই, অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী সৈয়দ শিশির একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। চব্বিশ বছর পর দেশে ফেরে সে। গ্রামে বেড়াতে গেলে মনে পড়ে বাবার কথা, মার কথা, দাদা দাদির কথা। সে ছোটবেলায় হাঁড়িচাচা পাখি দেখেছিল। বহুবছর পর গ্রামে ফিরে হাঁড়িচাচা বা কুটুমুপাখির সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। একটিবার সে পাখিটিকে দেখতে চায়। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেও। পাল্টে গেছে গ্রাম। উজাড় হয়ে গেছে গাছপালা। পাখিদের অভয়ারণ্য আর নেই। নষ্ট হয়ে গেছে উন্নয়নের কারণে।
শিশির চলে যায় পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়িতে। যাওয়ার আগে ভ্রমণপিপাসু বাবাকে স্বপ্নে দেখে। বাবা তাকে বলে দেশটাকে ঘুরে দেখতে। বাবার ইচ্ছে পূরণ করতেই সে পাহাড়ি দুর্গম জনপদে যায়। তখনই বিশ্বজুড়ে শুরু হয় করোনা মহামারি। বাংলাদেশেও আসে করোনা। হরতাল ও লকডাউনে শিশির আটকা পড়ে সাজেক ভ্যালিতে। তার সঙ্গে ট্রেনে সহযাত্রী ছিল তুষার মজুমদার, যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এথনোগ্রাফীয় গবেষণার জন্য গেছে পাহাড়ে। তার সাথে শিশিরের বন্ধুত্ব হয়।
স্বকৃত নোমান যথার্থভাবে তুলে এনেছেন চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখো, লুসাইসহ সেখানকার বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠীকে। শিশির, যে প্রযুক্তি নারী আর মদ ছাড়া কিছুই বোঝে না, সেও কোথায় যেন আটকে পড়ল। সে প্রেম নয়, নারীর দেহকেই প্রাধান্য দিত সবসময়। তাই বয়স চল্লিশ পেরোলেও বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেও প্রেমের জালে আটকে পড়ল?
উপন্যসটি দেখতে পাই, বাস্তববাদী শিশির মাঝে মাঝেই মুখোমুখি হয় পরাবাস্ততার ধুম্রজালে। ট্রেনে যখন চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করে তখন সে দেখা পায় এক বদ্ধ পাগলের, যে তাকে নিষেধ করে সিল্ক সিটি ট্রেনে উঠতে। পরে শিশির পত্রিকার খবর পড়ে জানতে পারে ওই ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক হতাহত হয়। এ বিষয়টাকে বাস্তববাদী শিশির কেমন নিয়েছিলেন তার বর্ণনা পাইনি উপন্যাসে। লেখক মিথলজির সাথে বাস্তব ঘটনার এমন সুন্দর মেল বন্ধন তৈরি করেছেন, মনে হবে যেন লেখক নিজেই এর প্রত্যক্ষদ্রষ্টা।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শিশিরের বান্ধবী কেরোলাইন। তার সঙ্গে শিশির দীর্ঘদিন ধরে লিভ টুগেদার করছেন। বাংলাদেশে এসেও তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করত। কিন্তু যেদিন জানতে পারে সে প্রেগনেন্ট, ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিতে পারেনি শিশির। পরে জানতে পারে এ প্রেগনেন্সির দায় তার নয়। নারীর প্রতি কি শিশিরের বিতৃষ্ণা জেগেছিল? তাহলে কেন সে মদ খেয়ে ভুলে থাকতে চান অতীত?
মহুয়ার ঘ্রাণ উপন্যাসটির গভীরে ডুব দিলে জানা যাবে শান্তি কেবল সুদূর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে নয়, পাহাড়ি জনপদের বিচ্ছিন্ন গ্রাম কুমারাতেও আছে। একদিকে করোনার জন্য সারাদেশে লকডাউন, অপরদিকে আদিবাসী জনপদে চলছে হরতাল। শিশির ও তুষার দুর্গম পাহাড়ের মাঝে হেঁটে রওয়ানা হয় অন্য একটি জনপদে। সেখানকার মানুষ, বন্যপ্রাণী, সভ্যতার ছোঁয়া না লাগা মানুষেরা কীভাবে আপন করে নিয়ে হয়ে যায় আপনার চেয়েও আপন। সেই গ্রামে নেই ইলেক্ট্রিসিটি, নেই মোবাইল ইন্টারনেট। বাংলাদেশের ভেতরে এমনও জনপদ থাকতে পারে এটা ছিল শিশিরের একেবারই অজানা। তারপরও সে কীসের যেন এক মায়াজালে আটকে পড়ে সেখানে।
আর হাজারও পাখপাখালির মাঝে শিশির খুঁজে ফেরে ছোট্ট বেলায় দেখা হাঁড়িচাচা নামের সেই কুটুমপাখিকে। বনবাদাড়ে কত পাখি দেখছে সে, অথচ দেখা মেলেনি সেই কাঙ্ক্ষিত পাখিটির। `মহুয়ার ঘ্রাণ` নামকরণের সার্থকতা খুঁজতে গেলে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি পড়ে শেষ পর্যন্ত গেলে পাঠক অনায়াসেই নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেবে। সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় বিধিমালা সবকিছু তার উপন্যাসকে অনন্য করে তুলেছে।
শিশির ও তুষার যখন ঘুরতে ঘুরতে কুমারা গ্রামে এসে প্রবেশ করে, সেখানে দেখা পায় পতিন্দ্রবাবু নামের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষকে। তার বাংলোবাড়িতে আশ্রয় নেয় শিশির ও তুষার। কথিত আছে, এই গ্রামে বহিরাগত কেউ যেতে পারে না। যদি কেউ ভুল করে চলেই যায় তাহলে সেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। কিন্তু তারা গিয়ে দেখলেন এই গ্রামের ভিন্নরূপ। সেখানে সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিলে মিশে বসবাস করে। শান্তিপ্রিয় মানুষেরা কেউ কারো সাথে কখনও কোন বিবাদে জড়ায় না। আর যদিও ছোটখাটো কোনো ঝগড়া বিবাদ হয় তাহলে পতিন্দ্রবাবুর নেতৃত্বে সব মিটমাট হয়ে যায়।
আর ওখানেই মাথুই নামের এক তরুণীর সাক্ষাৎ পান শিশির। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা শিশির হয়ে যান এক অন্য মানুষ। যিনি নারীকে দেখেছে ভোগের সামগ্রী হিসেবে। কিন্তু সেই শিশির বলে, ‘মাথুই প্রেম কী আমি জানতাম না, তুমি আমাকে শিখিয়েছ। প্রেমের কারণেই জীবন এত সুন্দর প্রেমের কারণেই মানুষ বেঁচে থাকে। তুমি আমাকে পূর্ণ করেছে মাথুই। আমি তলিয়ে গেছি তোমার প্রেমে।’
মাথুই যেন মহুয়া ফুলের মতোই মাদকতাপূর্ণ। যার জন্ম দুর্গম পাহাড়ে। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি যদিও ইতিহাস ঐতিহ্য ও সমসাময়িক রাজনৈতিক আবহ স্থান পেয়েছে। লেখক প্রেমকে এনেছেন এক অন্যরকম মাদকতা দিয়ে। বখে যাওয়া মানুষের জীবন শুধুমাত্র প্রেমেই পরিপূর্ণ করে দিতে পারে। প্রেমেরও সুক্ষ্মতায় এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করেছেন এ উপন্যাসে।
শিশির ও তুষার এক জায়গায় দুটি লাশ গহীন অরণ্যে পড়ে থাকতে দেখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বর্ণনায় পাওয়া যায়নি এই দুটি লাশ কার ছিল। তবে কি দুজন কাঠ ব্যবসায়ী যে অপহৃত হয়েছিল তাদের? শেষ পর্যন্ত লেখক ফিরে এসেছিলেন তার নিজ আবাসস্থলে। কিন্তু ভুলতে কি পেরেছিলেন মাথুইকে? শেষ দৃশ্যে লক্ষ্য করা যায় বিচ্ছেদের প্রগাঢ় বিষাদে কালো হয়ে গেল শিশিরের মুখ। কালবৈশাখীর প্রাক্কালের আকাশের মতো। যেন এক্ষুনি ঝড় উঠবে।
শিশির কি পারতো না মাথুইকে সারা জীবনের জন্য সঙ্গী করে নিয়ে যেতে? এ প্রশ্নটা পাঠকের মনে ঘুরপাক খাবে। এমনই কি হয় মানুষের জীবন? হয়তো কেউই পারে না মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। তবুও মন এক লাগামহীন ঘোড়া। সে জানে না কখন কোথায় চলে যায় শিকড় ছেড়ে। বাস্তবতাকে নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনি। কিন্তু বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি উপন্যাসটিকে এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন। বাস্তব প্রেমের আখ্যানের ভেতর দিয়ে এই উপন্যাসে জীবনের সুক্ষ্ম অনুভূতি অনুরণিত হয়েছে। চরিত্রগুলো বাস্তবতার ঘাত প্রতিঘাতে বেড়ে উঠেছে। রূপকথার চরিত্রগুলোও পার্থিব সংসারের মধ্যে স্বপ্নের আবহ তৈরি করেছে।
স্বকৃত নোমার ‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ উপন্যাসটিতে এক শাশ্বত প্রেমের এক নিটোল পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। নিঃসন্দেহে একটি ভালো উপন্যাস ‘মহুয়ার ঘ্রাণ’।