শামীমা জামানের গল্প ‘সোনার পুতুল’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৩
বাড়িটার ভেতর একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে।
উৎসব বৈকি! এ বাড়ির একজন আজ অন্য দেশে যাচ্ছে। তার সাজ-সরঞ্জাম তদারকি, বিদায়ের সামাজিক নিয়ম-কানুন-যাত্রাপথের আনুসঙ্গিক এসব নিয়ে দারুণ ব্যস্ত বাড়ির লোকজন। বিদায় জানাতে বাড়িটাতে কৌতূহলি পড়শিদের ভিড়। তাদেরকে সামাল দিতে মোতালেব মিয়া ছুটোছুটি করছেন এদিক-সেদিক। খানিকবাদে ডেকোরেটর থেকে প্লাস্টিকের সাদা চেয়ারও জুটে গেল গোটাকয়েক। তিনি হাতে করে সবাইকে চেয়ার দেখিয়ে বসার ইঙ্গিত করছেন। বেশিরভাগই হাত উঁচিয়ে না-সূচক ইশারা করছে। তারা এখানে বসতে আসেনি। তবু মোতালেব মিয়া অতিথিদের খেদমতেই ব্যস্ত। এই বাসাটা তার ভাগনির বাসা। তার চলোফরায় তাকে এ বাড়ির বাসিন্দা মনে হলেও তিনি এ বাড়িতে এসেছেন আজ বছর পাঁচেক পর। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা যেখানেই যায় সেখানেই একটা নেতৃত্ব নিয়ে ফেলে। যেন তাকে ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব হতো না। ঘরের মধ্যে বড় খাটের মাঝখানে যে নারী মূর্তিটি আধশোয়া হয়ে আছে তার নাম রেহনুমা। বয়স তেত্রিশ হলেও তেইশ বলে চালিয়ে দেয়া যায়। নিজের যত্নটা সে জীবন ভর একটু বেশিই করেছে। তার একটা চকচকে প্রমাণ তার চেহারাতে বেশ ভালোমতোই আছে। চাকরির তুমুল ব্যস্ততার ফাঁকেও যে সামান্য সময়টুকু সে পেয়েছে তা সে আর কাউকেই দেয়নি, নিজের জন্যই ব্যয় করেছে। হোক সেটা সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্রে কিংবা পিচ্ছিল টাইলসে মোড়া অভিজাত শপিংমলে। তার সময়ের হকদার আরো যে দুজন মানুষ তার একজন তার স্বামী মোরসালিন। অন্যজন একমাত্র কন্যা অবন্তিকা। মোরসালিনের সময়টা তার ব্যবসাবাণিজ্য, বন্ধু-বান্ধবজুড়ে থাকলেও পাঁচ বছরের ছোট্ট অবন্তিকার পৃথিবী যাকে ঘিরে যাপিত হয় সে ওই ময়লা তেলচিটচিটে কাপড় পরিহিতা বরিশাইল্যা বুয়া।
আফা আমনে টিভি দ্যাহেন। মোর পাকঘরে কাম আছে।
না বুয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। অবন্তিকা জানে, বুয়া তার পাশে এসে বসলে তার শরীর থেকে একটা কটু গন্ধ ভেসে আসে। যে গন্ধটা কিছুটা মশলার গন্ধের মতো। তারপরও অবন্তিকা বুয়াকে কাছে পেতে চায়। বুয়া ছাড়া তার কে আছে। সেও যদি তাকে ছেড়ে সারাক্ষণই রান্নাঘরে থাকে তখন ওর খুব রাগ হয়।
রেহনুমার চোখ স্থির। তবে সে চোখ দিয়ে বাস্তবের কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। তার চোয়ালটা ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে। সে দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে আছে। কোনো কথা নেই। তার চারপাশ ঘিরে একটা মহিলাঙ্গন। তাদের ইতিউতি কথায় ঘরটা গমগম করছে। রিবন্ডিং করা চুলের এক মহিলা নিচু স্বরে বললো, আচ্ছা, আজকাল না ক্যান্সার ভালো হয়?
পার্পেল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা মহিলা জবাব দেয়, হয়। কিন্তু তা প্রথম দিকে ধরা পড়লে। ভাবিরা তো টেরই পায়নি।
ইয়াল্লা! টের পায়নি মানে, বলেন কী... আরো কিছু ভেতরের কথা বের করার উৎসাহ থেকে বললো তলোয়ারের মতো প্লাক করা ভ্রূর মহিলাটি।
টের পাবে কি। ভাবি তো দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটান। মাঝে মধ্যেই নাকি মেয়ের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। কিন্তু কে জানতো বলেন মেয়ের শরীরে এত বড় ব্যাধি বাসা বেঁধেছে! হড়হড় করে বলে গেল ম্যাজেন্ডা-ফিরোজা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মহিলাটি।
এবার গলার স্বর নিচু করে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো রিবন্ডিং চুলের মহিলা, যত যাই বলেন, চাকরি করলে মেয়েদের আর সংসার-সন্তান দেখা হয় না। বিশেষ করে ব্যাংকের মতো চাকরি। ভাবেন তো সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে আবার রাত আটটা বেজে যায় বাসায় ঢুকতে ঢুকতে। এইটুকু সময় বাসায় না থেকে অফিসে খাট-পালঙ্ক নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা উচিত। আহারে বাচ্চাটা!
হ্যাঁরে ভাই, সবারই একদিন যেতে হবে। একটু বয়স্ক একজন মহিলা মাথায় ওড়না দিতে দিতে হতাশা উক্তি করেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও নিজেদের মাথায় ওড়না ঠিকভাবে আছে কিনা তা হাত দিয়ে দেখে সতর্ক হয়।
মোতোলবকে এখন দেখা গেল একটা ট্রে হাতে। ট্রের মধ্যে কতক সিঙাড়া আর বাকরখানি। সে ঘুরে ঘুরে সবার সামনে ট্রেটা ধরছে। কমবয়সী কয়েকজন ছেলেমেয়েকে দেখা গেল সিঙাড়া তুলে নিতে। সে রেহনুমার কাছে আসলো। মা একটু পানি খা, খা মা। খাওয়ার ওপর কোনো রাগ করতে নেই। ক’দিন না খেয়ে থাকবি বল, পারবি থাকতে পারবি না। যে গেছে সে তো গেছেই। সব ভুলে যা। শক্ত হ মা।
রেহনুমা তার কথা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। তার দিনটা আজ কেয়ামতের চেয়েও কঠিন। বিষাদ। এর চেয়ে বিষাদময় আর কোনো দিন নাই। নিজেকে তার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মা। সারাদিন অফিসের ধকল শেষে সব সময় সে চাইত একটু প্রশান্তি। আর এ প্রশান্তির জন্য গা বেয়ে ওঠা দুরন্ত অবন্তিকাকে সে কতই না ধমক দিয়েছে। আহারে! আমার সোনার পুতুল! তোকে তো ভালো করে একটু কোলেও নিতে পারলাম না। ও মাবুদ কি পাপ করছিলাম আমি। না, এ কথাগুলো রেহনুমা সশব্দে বলতে পারে না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও প্রাণ খুলে সে কাঁদতে পারে না। ঘরের সামনে-ভেতরে সে চোখ দিয়ে একবার মোরসালিনকে খুঁজলো। বাসার নিচের ফাঁকা জায়গাটায় সাদা কাপড়ে বেষ্টনি দেয়া হয়েছে। সেখানে দুজন ছাতার কাপড়ের মতো কালো রঙের বোরকায় আবৃত মহিলা। তাদের পেশা মাইয়্যাতের গোসল দেয়া। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে তারা তাদের কাজ সম্পন্ন করছে। তাদের ঘিরে ঘন জটলাটা। কারো কারো মুখে সুর করে উচ্চারিত হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু...। সবাই একবার একবার করে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে আবার ফিরে আসছে। ঘন জটলার মধ্যে চোখের কোণ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে কেউ। ঘরের ভেতরের হু হু কান্নার রোল ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে। দু` একজনের গ্রামীণ বিলাপ ভেসে আসছে মাঝে মধ্যে।
মোতালেব মিয়া আবোরা রেহনুমার কাছে আসলো। ধরা গলা তার, মাগো গোসল শেষ হইছে। শেষ দেখা দেইখা যাও একটিবার। আর পারবা না দেখতে।
রেহনুমার টলমলে অর্ধমৃত শরীরটা ধরাধরি করে নিয়ে গেল দু’জন মহিলা। ভিড়ের মাঝে তার ঝাপসা-ভেজা ক্লান্ত চোখ দুটো মোরসালিনকে খোঁজে। সে যেন আজ তার দেহের একাংশ। তাকে ছাড়া তার পা একচুলও নড়তে চাইছে না। তার শক্তিহীন দেহটাকে সে মোরসালিনের কাঁধে সঁপে দিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। তার কি বিশ্রাম নেয়া হবে আর? মাটি খুঁড়ে যারা বিছানা পাতছে তার জন্যও একটি বিছানা পাতা হোক। সে ঘুমাবে। আর কোনোদিন জেগে উঠবে না।
মোরসালিন মাথায় দু`হাত দিয়ে বসে বসে শিশুদের মতো কাঁদছে। সফেদ কোলবালিশের মতো সরু, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কষ্টের মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা একটুখানি সরালো কেউ। একনজর সেদিকে তাকিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিলো রেহনুমা।