শামীমা জামানের গল্প ‘সংগীতশিল্পী তাহসানের ইনবক্স প্রেম’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
প্রায় দিন-সাতেক পর নিজের আইডিতে লগইন করে রাইসা হতবাক। অজস্র নোটিফিকেশনস আর নতুন বন্ধুদের এডের জন্য নয়। সে নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। তাহসান তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। ভাবা যায় গায়ক তাহসান! ও এম জি! খবরটা ফারিয়া ফকিরনীটাকে জানাতে হয়। যদিও নিউজ ফিডেই ফারিয়া দেখতে পাবে রাইসা আর তাহসান এখন থেকে বন্ধু। শয়তানটা তো তখন জ্বলবে।
রাইসা তাহসানের ইনবক্সে যেয়ে লেখে, থ্যাংকস ফর এড মি। দুরু দুরু বুক কাঁপে রাইসার। তাহসান মেসেজটা দেখেছে। এখন সে রাইসাকে টাইপ করছে। ও এম জি। সে রিপ্লাই দিচ্ছে! সে লিখেছে, মোস্ট ওয়েলকাম। রাইসা এখন কী করবে! এখানেই থেমে যাবে? না কিছু খাতির জমানোর চেষ্টা করবে? তাতে আবার বিরক্ত হবে না তো? সে লিখল, আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান।
ধন্যবাদ। জেনে খুশি হলাম।
এখন তো তার পালা। এখন সে কি লেখে? একটা স্মাইল ইমো সেন্ড করলো সে।
আপনি খুব সুন্দর। রাইসাকে অবাক করে দিয়ে তাহসান লিখলো।
রাইসার বুকের বাঁ পাশে ড্রাম বেজে যায়। সে লেখে, আমাকে আপনি বলার দরকার নাই। আমি অনেক ছোট।
কী পড়ো তুমি? তাহসান জানতে চায়।
একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করছি।
ভেরি গুড। কোথায় ওটা?
‘ধানমণ্ডি সাতাশ নাম্বারে। একটা শিসা বার আছে না, ওটার কাছে।’ রাইসা নিজের সেল নম্বরটা দিয়ে লেখে, এটা আমার নাম্বার। আপনার নাম্বারটা দেয়া যাবে প্লিজ।
এপর্যায়ে এসে তাহসান উধাও। নিশ্চই কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাইসাও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিউজ ফিড পরিক্রমণ করে। ইস, প্রথমেই ফারিয়া ফকিন্নির একগাদা ছবি। আরে, এ তো তার আরো অনেক ফ্রেন্ড ওর পাশে। কোথায় এরা? গ্লোরিয়া জিনস গুলশান। আজব তো! তাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করলো না। এক্ষুনি শয়তানটাকে আনফ্রেন্ড করবো। মনে মনে ভাবে সে। উহ্, এত সব অচেনা মানুষ নিউজ ফিডে ভেসে যায়। এরা কারা? এদের সে কবে কী কারণে এড করছিল, কে জানে! এদের জ্বালায় চেনা মানুষদের খুঁজেই পাওয়া যায় না। কীসব স্ট্যাটাস! এত কবি এই দেশে জন্ম নিছে ক্যান? আর প্রতিদিন তাদের এত কবিতা প্রসব করতে হবে ক্যান? আরে এটা কী ছবি! চলে গেল। বড় করে দেখে পিকটা। আটসাট হিজাবে উঁচু উটের পিঠের মতো মাথার মেয়ে, মুখভর্তি চড়া মেকআপ, নো প্রবলেম বাট শি ইজ পাউটিং! ও এম জি! এগুলোর মাথায় কী শিট ভর্তি?
পর্দা করছিস ভালো কথা। ঠোটে আবার সেক্স অ্যাপিল ফুটিয়ে তোলা কেন? আরেকজন দেখো, ক্ষ্যাত একটা ছবি দিয়ে লিখছে, আমাকে কেমন লাগছে? তার নিচে কমেন্ট আসছে, ফেরারী সুমন লিখেছে, আয় তোর...(অশ্লীল), ভণ্ড পথিক লিখেছে, তোমার প্রাইস কত? আবার দেখি ফারিয়া। লাল রঙের লিপস্টিক লাগিয়ে ডোনাল্ড ডাক ঠোঁটে। একদিনে কয়টা পোস্ট দেয়। বাহ্, এই ছবিটা সুন্দর আসছে তো ওর। দাঁড়াও সেও এখনি সেলফি তুলে পিক আপলোড করবে।
ল্যাপটপ খোলা রেখে সেলফোন নিয়ে রাইসা বাথরুমে যায়। ফোর স্টেপ লোয়ার চুলগুলোকে সামনে কাঁধের একপাশে মেলে দেয়। মাথাটাকে একশো আশি ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়ে ধরে। ভুরু জোড়া পিরামিডের মতো টান টান করে ঠোঁট দুটোকে হাঁসের মতো আহ্লাদি ভঙ্গি করে, যেন সবাইকে চুমু দিচ্ছে। বেশ কয়েকটা পিক তুলে আপলোড দিতে এসে দেখে, বড় বোন মাইশা এসে তার নিউজ ফিড ঘাটছে। ‘এসব কী রে?’ মাইশা কর্কশ গলায় বলে।
রাইসা স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে, কিম কারদাশিয়ান ন্যাংটো হয়ে বসে আছে। খানিক বাদে সানি লিওন তার মেদবহুল বাহু আর ক্লিভেজ খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ‘এসব ফালতু পেজে কেন তোর লাইক দেয়া?’ শুরু হয়ে গেল মাইশার মাস্টারি ক্লাস। ‘আমিও এফবি ব্যবহার করি। তাই বলে এমন কোনো বাজে পেজে লাইক দেয়া বা ফ্রেন্ডলিস্টে এমন কোনো অরুচিকর লোকজন নেই যাদের পোস্ট দেখে আমি বিব্রত হবো। এত অচেনা মানুষ তোর ফ্রেন্ডলিস্টে কেন? বিশেষ করে এত ছেলেরা কেন? এদের তুই চিনিস? বাই এনি চান্স, তুই এদের সাথে চ্যাটে বসিস না তো? বিপদে পড়ে যাবি কিন্তু। আর তোর এত ছবি পাবলিক পোস্টে দেয়া কেন? ওনলি ফ্রেন্ডে দিতে পারিস না। ফেসবুক যে এখন মুচি ম্যাথর গরু ছাগলে ভরে গেছে, তা বুঝিস না? আর গ্যাস ছাড়লে, হাঁচি-কাশি দিলেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে হবে কেন?’
মাইশার লেকচার আরো লম্বা হওয়ার আগেই রাইসা বলে, তুমি একটু বেশি সেকেলে। এত পুতুপুতু করে লাইফ চলে না। মনটাকে একটু উদার করো। এত সংকীর্ণ মন নিয়ে এখনকার পৃথিবীতে চলা যায় না। জীবনে সুখ পাবা না, বুঝলে?
মাইশা থ বনে যায় তার এগারো বছরের ছোট বোনের কথায়। একে সে কোলে করে বড় করলেও লোকে এখন পিঠাপিঠিই ভাবে দেখলে ওদের। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির উত্তাল রঙিন জীবনে রাইসা ঘরে থাকে না তেমন। চেষ্টা করে রাত ৯টার মধ্যে বাসায় আসতে। আর বাসায় এলেই আম্মু-আব্বুর চেয়ে তার এই খাড়ুস বোনটাই জ্বালায় বেশি। ডিজগাস্টিং উম্যান। রাগে গজগজ করতে করতে সে ডিনার টেবিলে যায়। রাব্বিকে একটা ফোন দিতে হবে। সে রাব্বিকে পাত্তা দেয় না বলে কি সে ফারিয়া শাকচুন্নীর সঙ্গে মুখে মুখ লাগিয়ে পিক দেবে ফেসবুকে? সব শালা লুজার। চরম লুজার।
দুই.
কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় তিনটে বেজে যায় জেবুন্নেসার। বাসায় ঢুকে খুব ইচ্ছে হয় খানিক ঘুমিয়ে নেয়। কিন্তু সে উপায় নেই। ছুটা বুয়াটাকে এই সময়েই সে সময় বেঁধে দিয়েছে। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে বুয়াও চলে আসে। তাকে ঠিক বুয়ার মতো মনে হয় না। সতের-আঠারো বছরের মেয়ে। পোশাক আশাকে দারুণ স্মার্ট গোছের। কথাও বলে প্রায় শুদ্ধ করেই। সে ঘরের কাজগুলো করতে থাকতেই জেবুন্নেসা রান্না বসিয়ে দেয়। এ সময় তার ছেলে শেহজাদ বাসায় থাকে না। সে অবশ্যি আজকাল কমই বাসায় থাকে। তার বাসার কাছেই সাতাশ নাম্বারে তার ইউনিভার্সিটি। বুয়া চলে গেলে তাই একরকম নিঃসঙ্গতায়ই চেপে বসে জেবুন্নেসাকে। তার স্বামী আশফাক বেঁচে থাকতেই মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়। লন্ডনে স্বামী সন্তান নিয়ে মেয়ে তার সুখেই আছে।
বিকেলে জেবুন্নেসা এক মগ কফি নিয়ে সাধারণত ফেসবুকে ঢোকে। ছেলে তাকে ফেসবুক খুলে দিয়েছে বটে, কিন্তু সে নিজের আইডিতে তাকে অ্যাড করেনি কেন, কে জানে! প্রথম প্রথম সে এফবি খুললে অপার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। ওমা, এ দেখি পুরো পৃথিবীর সব মানুষের মেলা বসেছে এক হাটে। তার স্কুল জীবনের, কলেজ জীবনের বন্ধু-বান্ধবী থেকে শুরু করে রাস্তায় মোড়ের সবজিঅলা, কে নেই সেখানে! ওই যে তাদের গ্রামের কিনু চোরা, যে একবার তার বাবার বাড়ি থেকে বদনা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল; সেও দেখি হাসি হাসি মুখ করে গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিষ্কার ঝকঝকে ঘাসের ওপর। পিছনে তার পরিপাটি গাছপালায় ঘেরা বরফে ঢাকা সুদৃশ্য বাড়ি। ক্যাপসানে লেখা, এনজয়িং স্নোফল। তাদের স্কুলের বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে খ্যাত বন্ধুটি, যার ঠোঁটের দুটি কোণ সারা বছর ফাড়া থাকত নিত্যকার অপুষ্টিতে। তাকে দেখা যায় টাইট জিনসের ওপর লেদার জ্যাকেট গায়ে ম্যানহাটানের রাস্তায় শপিংয়ে ব্যস্ত। সবাই কত সুখে শান্তিতে আছে। আর সেই শুধু পড়ে আছে একা। বিশাল এই বাড়িটাতে।
শেহজাদের ফিরতে ফিরতে দশটা এগারোটা বেজে যায়। সুনসান বাড়িটাতে তখন পিনপতন ভয়াল নীরবতা বিরাজ করত, যদিনা জেবুন্নেসা ভারতীয় চ্যানেলে সিরিয়াল চালিয়ে না রাখতো। মহিলাদের কুট ক্যাচালে গাঁজাখুরে গল্পগুলোতে সময়টা বেশ টানটান উত্তেজনায় ভরপুর থাকে। ওদের সুখ-দুঃখের সেও যেন এক ভাগীদার হয়ে গেছে। মহুল কি তার স্বামী রোদ্দুরের প্রেমে পড়বে? রূপকথার পেটে আসলে কার সন্তান? সন্ন্যাসী রাজা কি বেঁচে ফিরে আসবে? এসব তার না জানলে চলে না। ওরা তার একরকম আত্মীয়-স্বজনের মতো হয়ে গেছে। আর আত্মীয়রাই কি আজকাল আর আপন আছে? কে তার খোঁজ নেয়! সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত। স্বামী না থাকা মেয়েমানুষের আত্মীয় কী সমাজ, কারো কাছে আর মূল্য থাকে না! বছরের দুটো ঈদে এত্ত এত্ত রান্না করে নষ্ট হয়। ফোন করে ডেকে ডেকে জোর করে আর ক’জনকে খাওয়ানো যায়? পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করবে— ও মা, সেদিন দেখে মহিলা এই বুড়ো বয়সে আঁটোসাঁটো একটা স্লিভ্লেস গেঞ্জি পরে থলথলে হাত দিয়ে খুন্তি ধরে কড়াইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই বয়সে কী একটু সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে ইচ্ছে হয় না। কবরে তো এক পা চলেই গেছে। আর তার সঙ্গে মানসিকতায়ও যায় না তার। তার কোন শাড়িটা কত দামের, কোন শোপিসটা কোন দেশ থেকে আনা, ছেলে এবার ডায়মন্ডের সেট পাঠিয়েছে, ন্যানদোসের পেরি পেরি চিকেনটা কি অসাম— এসব ছাড়া কখনো বলতে শোনা যায় না রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসগুলো না লিখলেও পারতেন কিংবা আপনি কি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বোঝেন?
কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওভেনে গরম করে এনে আবার এফ বিতে ঢুকে যায় জেবুন্নেসা। এই জেনারেশনের মেয়েগুলোকে দেখলে তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। সবাই গেট আপে ফিল্মের নায়িকাদের মতো। না, ঠিক নায়িকা বলা যাবে না। অনেকটা পর্নোস্টারদের মতো। ক্লিভেজ বের করে ঠোঁট দুটোকে জানোয়ারের পাছার মতো চোখা করে ছবি আপলোড করে। যেন তারা বলতে চায়, আমি অস্থির, আমি আর পারছি না। পুরুষ তুমি এসে আমায় উদ্ধার করো। এদের দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে পশুর মতো দিনরাত ওই আদিম কর্মটি ছাড়া নারীর জন্য আর কোনো কাজ রাখা হয়নি। আর ছেলেগুলোও। কী ডেসপারেট, কি সাংঘতিক মানসিকতার! একে অপরকে কমেন্ট করছে একেবারে কাপড় খুলে গালিগালাজ দিয়ে। এরা আবার ভদ্রঘরের! রিকশাঅলা ট্রাক ড্রাইভার না। এইতো দেখো কী অসভ্য একটি ছবি! ন্যুড একটি ভাস্কর্যে নারীটির স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে হাত রেখে কী বিকৃত উল্লাস করছে ছেলেগুলো। ইস, কী ছোট ছেলেগুলো! তার শেহজাদের বয়সীই হবে। এদের মা-বাবা কি এসব দেখে না? খোঁজ রাখে না ছেলে কি করছে না করছে?
তিন.
সিসাবার থেকে বাসায় ফিরেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয় রাইসা। এমন বিশ্রী একটা ব্যাপার ঘটবে, সে ভাবতেই পারেনি। ফারিয়া এমন একটা বাজে ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু খানি সিসার টান মেরে তারা সবাই একটু নাচছিল। মনটা কী দারুণ ঝরঝরে উড়াল পাখির মতো ডানা মেলছিল কেবল। আরো কয়েক টান দিতে সে ডিভানে এসে বসেছিল। ছেলেটা হ্যাংলার মতো তার পাশে এসে বসলো । বেশ ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে সে তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত চালাবে! কী জঘন্য কুৎসিত মেন্টালিটি। রাইসাও হাঁদা মেয়েদের মতো চুপ করে বসে থাকেনি। তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বদমাশটার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। সবাই এক দৃষ্টিতে রাইসার দিকে তাকিয়েছিল। ...দ্যাখ কেমন লাগে। বাপের জন্মের মতো ইভটিজিং ছুইটা যাইব। যত্তসব নোংরা পোলাপান!
মেজাজ রাইসার খুব খারাপ হয়ে আছে। আসার সময় সে ফারিয়াকে পর্যন্ত না বলে চলে আসছে। রাগে তার নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। সাধারণত মেজাজ খারাপ থাকলে সে ফ্রিজে হানা দেয়। কেক, পুডিং মিষ্টি যা থাকে সব গপাগপ সাবাড় করে আর মুহূর্তেই তার মেজাজটা নেমে যায়। কিন্তু আজ তা করা যাবে না। সাত দিনের ক্রাশ ডায়েটের আজ তৃতীয় দিন চলছে। প্রথম দিন শুধু ফল। আর দ্বিতীয় দিন সবজির পর আজ তার ফল আর সবজি দুটোই একসঙ্গে খাওয়ার দিন। এই ডায়েটটা ফলো করলে সাত দিনে পাঁচ কেজি ওজন কমানো যাবে। ফারিয়ার চেয়ে তখন তাকে আরো বেশি সেক্সি লাগবে দেখতে। কিন্তু রাগ আর ডায়েটের পরিণামে তার অলরেডি হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। এখন মাথাটাও ভোঁ ভোঁ করছে রাইসার। একটু পরেই সেলফোনটা বেজে ওঠে। ফারিয়া। `হ্যালো কি অবস্থা? এইটা তুই কি করলি দোস্ত। এইটা কোনো কাজ করলি তুই? কি করছিলো ছেলেটা আমাকে খুলে বলতি। আর যাই করুক, তুই তাকে চড় মারবি সবার সামনে!’ রাইসার মেজাজ আরো খারাপ হয়। ‘যা করছি বেশ করছি। এমন লুইচ্চা পোলাপানের সঙ্গে এমনই করতে হয়।`
‘ও আচ্ছা, তাই নাকি? তোমার মেন্টালিটি এত লোয়ার হইল কবে থেকে। তুমি সিসাবার আসবা সিসা খাবা, বিয়ার খাবা আর কোনো পোলা তোমার পাশে বসলে তুমি সতী-সাবিত্রী হয়ে যাবা। তা তো হবে না দোস্ত। তুমি বরং এক কাজ করো, ওই যে রাস্তায় দেখ না ঝাঁকে ঝাঁক হিজাবঅলী হেঁটে যায়, তুমিও না ওদের মতো হিজাব ধরে নামাজ-রোজা শুরু করে দাও, বুঝলা।’
তুই জানিস ও আমার সঙ্গে কি করছে?
ওয়াটেবার, আমি জানতে চাই না। তুমি যে রিঅ্যাক্টটা করছ, এইটা মানা যায় না। তুমি এইভাবে মানুষের সঙ্গে মানায় চলতে না পারলে তোমার অনেক বিপদ আছে। ওকে দোস্ত, আমি রাখছি। ওই পোলায় আমারে ফোন দিসে।
রাইসা হতবাক। এই তার জানেমান বন্ধু ফারিয়া! সে দুম করে বিছানায় উপুড় হয়ে ল্যাপটপ খোলে। বাদ এইসব চিন্তা। এফবিতে ঢুকে মনটা ভালো করা যাক। নিউজ ফিডে এসেই তাহসানকে পেয়ে গেল। সে স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘তোমায় আমি ছাড়ব না সুন্দরী।’ মাত্র ছয় মিনিট আগে! ওহ্ নাইস, সে এখনও আছে। রাইসা ইনবক্সে হানা দেয়। কাকে ছাড়বেন না আপনি? কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণ দেখে রাইসা আবার নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশি এক অচেনা মডেল প্রায় উলঙ্গ হয়ে ফেসবুকে পিক আপলোড করছে। সেই কথাই একটি অন লাইন পত্রিকা লিখেছে। ফেসবুক থেকে বের হয়ে আসবে এমন সময় ইনবক্সে লাল রঙের ওয়ান ভেসে উঠলো। চিঠি খুলে দেখে তাহসান রিপ্লাই করছে। একটা গানের কথা ওটা। আর কিছু না। তুমি কেমন আছ?
রাইসা ব্যস্ত হয়ে কীবোর্ডে আঙুল চালায়। ভালো, আপনি কি করছেন?
আমার একটা মিষ্টি ফ্যানের সঙ্গে চ্যাটে আছি।
ও আচ্ছা, আরো অনেকের সঙ্গেই বুঝি একসঙ্গে চ্যাট করছেন?
একদম না সোনা।
রাইসার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ বাড়ি দিলো কেউ। তার মানে আরো অনেকের মতো তাহসানেরও তাকে ভালো লেগেছে। রাইসা একটি স্মাইল ইমো দিল। ওপাশ থেকে লাভ ইমো এলো। রাইসা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার স্বপ্নের মানুষটি তাকে পছন্দ করেছে। ওয়াও। কী আনন্দ! এখন তাহসান সিঙ্গেল। মিথিলা শাকচুন্নীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। সবাই কেন যে ওদের দুজনকে একসাথেই দেখতে চায়! কেন বাবা, নতুন কাউকে একটু চান্স দিলে কী সমস্যা? সে দেখতে মিথিলার চেয়ে অনেক কিউট। ফারিয়াকে বলবে নাকি ফোন করে? একদম না। শয়তানটা হিংসায় জ্বলে পুড়বে। রাইসা লিখল, একটা কথা বলব? খুব ভয় করছে।
না না। ভয়ের কী আছে! আমি বাঘ ভালুক নই, তাহসান।
আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। মানে একটা সেলফি তুলতে চাই।
ও এই কথা। এত লজ্জা কেন। ঠিক আছে এসো। তবে একা। কাউকে জা্নাবে না। বোঝোই তো আমি পাবলিক ফিগার।
ওকে ভাইয়া, আমি কাউকে বলব না। আমি কোথায় আসব এড্রেসটা যদি দেন।
নিশ্চই, দাঁড়াও দু মিনিট।
রাইসার সারা দেহে এক অপার্থিব সাফল্যের আনন্দ খেলে গেল। খানিক বাদে তাহসান এড্রেস জানায়।
কবে আসবো ভাইয়া?
কাল বিকেলে ফ্রি থাকব। তখন আসতে পার। কিন্তু ওই যে বললাম, কাউকে বলবে না।
ওকে ভাইয়া, ঠিকাসে।
ওকে বাই। দেখা হবে।
পরদিন রাইসার কোনো কাজই ঠিকমতো হয় না। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে সে কিছুই খেতে পারে না। একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগানিয়া টেনশনে তার স্নায়ুগুলো চঞ্চলা হয়ে ওঠে। মনে পড়লেই তার মন আনন্দে ভরে যাচ্ছে। আর যখন সে তাহসানের সঙ্গে তার পিকটা আপলোড করবে, ফারিয়া ফকিন্নির শরীর জ্বলে যাবে হিংসায়। ওহ্, ভাবতে কী ভালোই না লাগছে! দুই ঘণ্টা আগে সে সাতাশ নাম্বারে সবচেয়ে অভিজাত পার্লারটিতে যায়। এমনি ফকিরনীর মতো সে তাহসানের সামনে যাবে নাকি? সারাক্ষণ মেকআপে ঢাকা সুন্দর সুন্দর মুখের সামনে থাকতে থাকতে তার এই মেকআপহীন চেহারা তো তাহসানের কাছে কাজের বুয়াদের মতো লাগবে। সো পার্লার মাস্ট। ঘণ্টাখানেক দম বন্ধ করে বসে থেকে মুখে কেজিখানেক ময়দার প্রলেপে নিজেকে সে ‘অপরূপা’ করতে সক্ষম হয়। ওহ্, দারুণ! আয়নায় নিজেকে সে চিনতে পারে না। তাকে তো মিথিলা ও মীমের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। তাহসানের যে তাকে ভালো লেগেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। না হলে এত বড় স্টার কাজ ফেলে শুধু তাকে সময় দেয়ার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? ওয়াও! সে যে এত্ত লাকি ভাবতেও পারেনি। ইনবক্সের ঠিকানাটা খুঁজে পেতে রাইসার বিকেল গড়িয়ে গেল।
একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। সাতাশ নাম্বারে তার ভার্সিটি হওয়ায় সে লালমাটিয়ার এই অলিগলিও বেশ ভালোই চেনে। কিন্তু এইখানে যে তাহসানের গানের কাজ হয়, সে জানতো না। নাকি তার নিজের বাসা এটা? তার বাসা না উত্তরা? কী জানি! বাসাটা অ্যাপার্টমেন্ট নয়, তাই সে সিঁড়ি বেয়ে বিনা বাধায় তাহসানের দরজায় বেল টিপলো। আচ্ছা, সে না অনেক বড়লোক? তাহলে এত পচা বাসায় থাকে কেন? হয়তো তার কোনো বন্ধুর বাসা। নিজের বাসার ঠিকানা সে দেবে কেন? একটু পরেই দরজা খুললো উনিশ-কুড়ি বছরের একটি ছেলে। রাইসা কিছু বলার আগেই সে বলল, আসেন আপু। ভিতরে আসেন। বস আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
রাইসা দুরু দুরু পায়ে ভিতরে ঢুকলো। কেমন বিশ্রি ড্রয়িং রুমটা। একটা পুরনো বেতের সোফা। পর্দাগুলো কম দামি। চূড়ান্ত ক্ষ্যাত। সাইড টেবিলে একটা কমদামি ফুলদানি। ওপরে কটকটে হলুদ রঙের কতক ফুল। জানালার কাছে একটি খাটও আছে। সেখানে মশারি ঝুলে আছে। এই সংসারে কোনো মেয়েমানুষ আছে বলে মনে হয় না। রাইসার হঠাৎ যেন মনে হয়, আচ্ছা তাহসানের আইডিটা ফেইক নয় তো! কোনো বাজে ছেলে তার সঙ্গে শয়তানি করছে না তো? পুরোটা বোঝার আগেই ছেলেটি দরজা লক করে দিয়ে বলে, যান, বস তো ভিতরে।
ভিতরে মানে! সে অভদ্রের মতো শোবার ঘরে যাবে নাকি? পাশের একটি রুম থেকে সাত আটজন ছেলে হইহই করে উঠলো। গোল হয়ে বসে তারা কার্ড খেলছে। তাদের পাশের রুম থেকে হুইস্কির বোতল হাতে যে ছেলেটি বেরিয়ে আসলো তাকে দেখে রাইসার ভয়ে দমবন্ধ হয়ে এলো। সেই দিনের সেই ছেলেটা! সিসাবারে যে তার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল। যাকে সে সবার সামনে কষে চড় মেরেছিল। ছেলেটি ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে অট্টহাসি শুরু করে। তাহসানের কাছে এসেছ তুমি? আমিই তাহসান। সঙ্গের ছেলেগুলো একসঙ্গে পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে। রাইসা মুহূর্তে ব্যাগ থেকে সেলফোনটা বের করে রাব্বির নাম্বারে কল করে। রাব্বি তাকে ভালোবাসে জান দিয়ে। ও তাকে ঠিক উদ্ধার করবেই পিশাচগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কাছে পৌঁছাবার আগেই পিছন থেকে একটা ছেলে এসে ফোনটা নিয়ে নেয়।
প্লিজ আমাকে যেতে দাও। এসবের মানে কি... রাইসা কেঁদে কেঁদে অনুনয় করতে থাকে। ফারিয়ার বন্ধু ছেলেটি এবার তার গলা থেকে ওড়নাটি নিয়ে নিজের মাথায় পেঁচিয়ে নেয়। রাইসা লজ্জা-ভয়ে কুঁকড়ে থাকলে সে হাসতে হাসতে বলে, ওড়না তো গলায় পরছিলা। এখন নিয়া নিছি বইলা এত লজ্জা পাইতেছ কেন। ভালো ভালো। লজ্জা নারীর ভূষণ।
প্লিজ ভাইয়া, আমারে যাইতে দাও। তুমি যা বলবা আমি তাই শুনবো। ভীত কণ্ঠে জপতে থাকে রাইসা। হো হো অট্টহাসিতে ছেলেটি বলে, এই শেহজাদকে কেউ কোনোদিন মানুষের সামনে অপমান করতে সাহস করেনি। তুই সেই সাহস দেখাইছস বান্দীর বাচ্চী।
প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব।
ঠিক আছে, মাফ করে দেব। আপাতত কাল ভোর পর্যন্ত তুমি আমাদের সবাইকে একে একে সার্ভিস দিবা। ওকে?
রাইসা ঠিক কখন তার জ্ঞান হারায় তা সে মনে করতে পারে না। যখন সে চোখ খোলে তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন নার্স। পাশে রাব্বি আর তার বোন মাইশা।
চার.
অনেকক্ষণ ধরেই কলিংবেলটা বেজে চলেছে। জেবুন্নেসার চুলায় গরম তেল। চিকেনগুলোকে আগেই মেরিনেট করে রেখেছিল। এখন ডিমে আর ময়দায় ডাবল করে চুবিয়ে সে ডুবো তেলে ফ্রাই করবে। কে এফ সির এই ফ্রায়েড চিকেন শেহজাদের অনেক পছন্দ। সেমিস্টার শেষে সে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গেছে। মাত্র একটা দিন একটা রাত সে নেই, তাই জেবুন্নেসার বুকটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠছে। আগে থেকে সে তার পছন্দের রান্না করে সারপ্রাইজ দেবে এলে। ন্যাপকিনে হাতটা মুছে দরজা খুলে থ বনে যায় জেবুন্নেসা। মুহূর্তের মধ্যে তার বাসা ওয়াকিটকির শব্দে গমগম করে। পুলিশের লোকগুলো শেহজাদকে খুঁজতে এসেছে। জেবুন্নেসা নিজেকে শক্ত করে বেশ চোটপাটের ভঙ্গিতে বলে, আপনাদের ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গেছে ঢাকার বাইরে। আর যে ঘটনার কথা বলছেন সেটা তো লালমাটিয়ায় ঘটেছে। ছেলে তার খুব ভালো— এমন কথা বোঝাতে যেয়ে জেবুন্নেসা অফিসারের ধমক খেল। তার নাকি আর লুকনোর কোনো উপায় নেই। মেয়েটিকে রাতভর অত্যাচার করা হয়েছে এবং সেই ভিডিও তারাই ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফেসবুক এখন এই নিয়ে তোলপাড়। কাল থেকে সে ফেসবুকে ঢোকেনি। এসব সে জানে না।
পুলিশের লোকগুলো চলে গেলে জেবুন্নেসা মূর্তির মতো ধপ করে সোফায় আধশোয়া হয়। রান্না ঘর থেকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।