শামীমা জামানের গল্প ‘মনস্টার আংকেল’
প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০১৯
পশ্চিম নিউইয়র্কের এই শহরে যখন প্রথম এসেছিল টুশিরা, দেশ ছেড়ে, পরিবার-পরিজন আর স্কুলের বন্ধুদের ফেলে, তখন ও এত মন খারাপ করত না তার। আসলে মন খারাপের সময়ও তেমন পাওয়া যায়নি স্কুল আর বেড়ানোর ব্যস্ততার জন্য। এই তো বছর দুয়েকও হয়নি ওরা এসেছে এই কনকনে ঠাণ্ডার শহর বাফালোতে। প্রায় প্রতিদিনই বাবা আর মায়ের সাথে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়া, বাইরে খাওয়া, সবকিছু চেনা এসবই ছিল টুশির কাছে ভীষণ রোমাঞ্চকর!
সেদিনও তারা শহরের জ্যাকসন এভিনিউতে খেতে গিয়েছিল একটা ইটালিয়ান রেস্তোরাঁতে মলবেরী স্মুদিটা কী মজার ছিল! পাস্তা তার খুব পছন্দ। তবে মায়ের বানানো বোরিং পাস্তা নয়, মলবেরী ক্যাফের রাঁধুনির বানানো পাস্তা। বড় হয়ে সে রাঁধুনি হবে কি? তাহলে সব মজার মজার খাবার খাওয়া যাবে। রেস্তোরাঁয় বাবা আর মা খেতে খেতে কথা বলছিল মোবাইলে। সম্ভবত তারা কাউকে সাহায্য করতে চাইছিল। মা আর বাবা ফোনে তাদের বাসার এড্রেস বলছিল বারবার। কীভাবে আসতে হবে তাও বলে দিচ্ছিলো। টুশির ছোট্ট হৃদয়টা আনন্দে নেচে উঠেছিল। এই সুন্দর ঝকঝকে তকতকে হালকা সবুজ ঘাসের, গাঢ় সবুজ গাছের, নীল জল ঘেরা শহরে যেদিকে চোখ মেলে তাকানো যায় শুধু সুন্দর আর সুন্দর! এতসব সুন্দরের মাঝে আপন মানুষেরা নেই বলে টুশির বুকটা এক অচেনা কষ্টে হু হু করে উঠতো। মা আর বাবারও বুঝি তাই করে। যদিও বাফালোতে অনেক বাঙালি। একটা মিনি বাংলাদেশ বলা যায়। আর আছে প্রচুর হুজুরেরা। এত হুজুর এখানে কী করে এলো, কে জানে“
বাবার ফোনালাপে সে বেশ বুঝতে পেরেছিল তাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে কেউ আসছে, যে থাকবে তাদেরই সঙ্গে। এটা বেশ মজা হবে। স্কুল থেকে ফেরার পর প্রায়ই তাকে একা থাকতে হয়। বাবা আর মা তখনও কাজে থাকে বাইরে। সে স্কুল থেকে চলে আসে অনিতা আন্টির সাথে। তাদের হাউস থেকে তিনটে হাউস পরই অনিতা আন্টির বাড়ি। কলকাতার বাঙালি অনিতা আন্টি ওদের পাবলিক স্কুলেই চাকরি করেন। তার ছেলে জুনও টুশির ভালো বন্ধু। তারা বিকেলে লনের সামনে খেলা করে আরো সব নেইবারদের সাথে। পৃথিবীটা যে কত সুন্দর তা যেন বিকেল না আসলে টেরই পেত না টুশি।
অনিতা আন্টি ঠিক করে সিট বেল্ট বেঁধে দেন। তারপর তার চোখ কেবল সামনে রাস্তার দিকেই থাকে। জুন আর সে ছুটির আনন্দ আর ক্লান্তিতে ঝিমোতে ঝিমোতে পথঘাট দেখতে থাকে। অনিতা আন্টিকে টুশির খুব ভালো লাগে। বড় হয়ে সে এমন দেখতে হতে চায়। কেমন যেন অন্য মাদের থেকে আলাদা। জিন্স প্যান্ট আর সাদা ফতুয়ায় তাকে আরো সুন্দর লাগে অথচ সে তার মায়ের মতো ফর্সা নয়। আবার জগলুল আংকেলের মতো কালো কুচকুচেও নয়। টুশির মনটা আবারো খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু একটা ভুলে যেতে চায়। আবার অনিতা আন্টির শক্তপোক্ত চেহারাটা দেখে মনে হয় তার মনের সমস্ত কথা সে অনিতা আন্টিকে বলতে পারে। আচ্ছা মাকে কেন এমন মনে হয় না তার। অথচ মা-ই তাকে সবকিছু কিনে দেয়। মা আসলে অনিতা আন্টির মতো এত স্মার্ট নয়। আর বড্ড বেশি ভালো। সারাদিন বাইরে জব করে এসে বাসার কাজে ব্যস্ত থাকে। আগে রান্না নিয়ে এত ভাবত না, এই জগলুল আংকেলটা আসার পর থেকে মাকে রান্নাঘরে অনেক বেশি সময় দিতে হয়। তার সাথে যে একটু ভালো করে কথা বলবে, সেই সময় কোথায় আর!
আচ্ছা, সে কেন এসব ভাবছে! মন খারাপ করা চিন্তা করলে শরীর খারাপ করে। তাই সে এখন থেকে ভালো ভালো চিন্তা করবে। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বোজে টুশি। পৃথিবীর সব চেয়ে ভয়ংকর সুন্দর জায়গাটি তার সামনে ভাসতে থাকে। গত উইকেন্ডেই গিয়েছিল তারা সেখানে। তাদের হাউস থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ। ওএমজি! কী সাংঘাতিক ব্যাপার সেখানে! শুধু পানি আর পানি। কত উপর থেকে পড়ছে আর পড়ছে! সাদা ধবধবে পানি নিচে নেমে শান্ত নীলে মিশে সাদা ধোঁয়া পাকিয়ে চলেছে যেন। এত পানি কোথা থেকে আসছে? আর কোথায়ইবা যাচ্ছে? চারদিকে শো শো পানির শব্দ। এই-ই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত নায়াগ্রা। ইউএস, কানাডা বর্ডারে যার এক তৃতীয়াংশের দেখা মেলে। বাকি দুই তৃতীয়াংশ কানাডার অন্টারিওতে পড়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা কত শত মানুষেরা ছবি তোলায় ব্যস্ত। মা আর অনিতা আন্টিও কম যায় না। একের পর এক ছবি তুলতে তারা ব্যস্ত। জুন আর তাকে সামলাতে জগলুল আংকেল অতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উফ! এরপরে আর কিছু ভাবতে তার ভাল লাগে না। বাবা-মা অনিতা আন্টি বা অন্য কেউ আদর করলে তার কত ভালো লাগে। কিন্তু এই জগলুল আংকেল তাকে আদর করতে এলে তার খুব বিচ্ছিরি লাগে। পৃথিবীটাকে তখন খুব খারাপ আর ভয়ানক একটা জায়গা মনে হয়। এটা নিশ্চয়ই ব্যাড টাচ! অনিতা আন্টি গাড়ি থামিয়ে দিলেন। তাদের লন ঘেরা সুন্দর হাউসটি এসে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে সে অনিতা আন্টির হাত ধরলো। অনিতা আন্টি ব্যস্ততার সাথে বললেন, ওয়াটস রং উইথ ইউ বেব?
আচ্ছা আন্টি, তোমাদের বাসায় মন্সটার আসলে তুমি কি করো?
মন্সটার বলে সত্যি কিছু নেই হানি, সব ইমাজিনেশন। অনিতা আন্টি কাছে এসে তার ঝলমলে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার ভয় করে একা বেবি? জগলুল আংকেল এসে পড়বেন তো, আর একা ভয় করবে না।
অনিতা আন্টি চলে গেলে সে বাড়িতে ঢুকে ব্যাগটা ফেলে চেঞ্জ হয়ে নেয়। টিভি ছেড়ে লম্বা সোফাটায় ঝাপ দিয়ে শুয়ে পড়ে একটা চিপসের কৌটা হাতে। টিভিতে একটা পুরনো মুভি দেখাচ্ছে। হোম এলোন। মুভিতে তারই বয়সী একটা ছেলে একা একা নানান বুদ্ধি বের করে রবারগুলোকে ধরাশয়ী করছে। হাসতে হাসতে টুশির পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম। একটু পরেই সে এসে পড়বে। মা আর বাবা আসার আগে। টুশি ফ্রিজ খুলে চিজ কেক আর সসেজ বের করে আয়েশ করে খেতে বসলো। গন্ধ পেয়ে কিটোটা ঘুম থেকে উঠে এক লাফে তার কাছে এসে মিঁয়াও মিঁয়াও করে অস্থির হলো। অসভ্য বেড়াল! কোনো ম্যানারস জানে না। সে তাকে এক স্লাইস সল্টেড বিফ কেটে দিল। কিটো চেটেপুটে খেয়ে টুশির কোলে এসে খাতির জমায়। মোটু বিল্লিটাকে কোল থেকে নামিয়ে কিচেনে যায় টুশি। মশলার কৌটোগুলো থেকে পেপরিকা খুঁজে নিয়ে পানিতে গুলে নেয়। আর সেটা তার প্লাস্টিকের বড় ওয়াটার গানটায় ভরে ফেলে। ফ্রিজ থেকে বাটার বের করে ওভেনে ঢোকায়। কিটোটা পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করছে। যেন সেও সব মতলব বুঝে নিচ্ছে।
জগলুল আংকেল ঘরে ঢুকতেই বাটার লাগানো পিচ্ছিল টাইলসে পা ফসকে চিৎপটাং। কিটো এক লাফে কোথা থেকে এসে ঝাপিয়ে পড়ল তার বুকের ওপর। সমানে তার ধারালো নখ দিয়ে মুখে গলায় আঁচড়াতে লাগলো। এই বুলশিটটাই তার ফ্লাফি লোমওয়ালা গায়ে পা দিয়ে গুতো দিত! টুশি একটুও সময় নষ্ট না করে ওয়াটার গান তাক করল লোকটার চোখ বরাবর। খানিক পেপরিকা বৃষ্টি ঝরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভো দৌড় দিল জুনদের হাউসের দিকে।
বাবার সাথে টুশি আর কোনোদিন কথা বলবে না। জগলুল আংকেল বাবাকে সব নালিশ করেছে। বাবার সে কী বকা! বাবা টিভিতে নিউজ দেখছে। মাও কিচেনে কাজ করতে করতে নিউজ দেখে। সে যে সোফায় উপুড় হয়ে কাঁদছে সেদিকে কারো খেয়ালই নেই! কিটো তার গা ঘেষে গুটি পাকিয়ে বসে। লেজ নাড়িয়ে সান্ত্বনা জানায়। বাংলাদেশের চ্যানেলে দেখাচ্ছে পূজা নামের একটি মেয়েকে একটা দৈত্য প্রায় মেরেই ফেলেছে। কী ভয়ংকর! মা কিচেন থেকে বলল বাবাকে। টুশি উঠে বসে দেখতে চেষ্টা করে আর অমনি বাবা রিমোট দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দেয়।
বাবা পূজাদের বাসায়ও কি একটা মন্সটার আংকেল থাকত?
বাবা আর মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মা কাজ ফেলে ছুটে এসে তাকে বুকে চেপে ধরে! সাহস করে টুশি তার মনের কথাটি বাবা আর মাকে বলতে পেরেছিল। তারপর থেকে টুশিদের হাউস এমনকি বাফালোর ঝকঝকে রাস্তাঘাটের কোথাও আর মন্সটার আংকেলটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্কুল আর বাড়ির চারপাশের বন্ধুদের সাথে টুশির দিনগুলো মন্দ যায় না। কিটো তার হুলো লেজ উড়িয়ে সর্বদাই সঙ্গে থাকে।