অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরা

অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরা

শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জুলাই ২৩, ২০২২

তাকে সত্যিই আজ পরির মতো লাগছে। পরির মতোই যে সেজে এসেছে সে। হালকা কমপ্যাক্ট বোলানো মুখমণ্ডল। গালের দু’প্রান্তে ডার্ক কালারের কন্ট্যুরিং করে মুখের বাল্কি ভাবটাকে একটু রোগা করা হয়েছে। চোখের ওপর স্মোকি লুকে আইশ্যাডো ছোঁয়ানো। লাল টকটকে গাঢ় লিপস্টিক বোলানো ঠোঁটে। রসলোভি গাছির কাঁচিতে কাটা খেঁজুর গাছের মতো কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে একটা লাল শিফন। চৌকোনা করে কাটা নখগুলো দৃশ্যমান হয় কচিৎ কখনো আলগোছে সরিয়ে দিতে আঁচল।

অদূরে প্রজাপতি প্রগাঢ় আহবানে নিস্পলক দৃষ্টি ম্যালে। সেও সে দৃষ্টিতে স্থির করে তার অস্থির চোখদুটো। অসম্ভব পুরুষালি উজ্জ্বল ঝকঝকে চেহারা। যেন এইমাত্র ষাট মিনিট সময় ধরে গা মাজুনি দিয়ে ঘষে ঘষে স্নান করা হয়েছে। চুলগুলো পরিপাটি। সুহৃদের মতো অগোছালো নয়। হালকা আকাশি রং ফর্মাল শার্টটি ভেতরের মানুষটিকে আরো খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। খানিক দ্বিধা সরিয়ে দিয়ে আরো কতক সময় চলতে থাকে চার চোখের অবাঞ্চিত কৌতূহল।

সেখানে ব্যাঘাত ঘটায় সাদা কালো পোশাকের ম্যাম ম্যাম করা কেতাদুরস্ত ওয়েটার। তার হাতে ধরা ট্রেটি টেবিলে রাখে। সদ্য রন্ধনকৃত খাবারগুলো আপন ঘ্রাণে সবার মাঝে উত্তাপ ছড়ালো। ইকবাল এক চামচ ফ্রায়েড রাইস তুলে দেয় সুহৃদের প্লেটে। আমি যেহেতু হোস্ট, আমিই পরিবেশন করি। সুহৃদ সিচুয়ান শ্রিম্প থেকে খানিকটা নিয়ে বলে, থ্যাক ইউ বন্ধু, আমরা নিয়ে নিতে পারবো। তবে তোর এসব করার দরকার ছিল না।

কী যে বলিস! বাসায় বউ থাকলে তো ভাবির অনারে বাসায়ই দাওয়াত দিতাম। বউ নেই বলে চাইনিজে আনলাম।

আমাদের বাসায় কবে খাবেন বলেন? রায়া সুলোলিত কণ্ঠে জানতে চায়।
বেশি বলবেন না, আমি কিন্তু খাদক টাইপের। দেখা যাবে, খাওয়ার সময় রোজই হাজির হয়ে গেছি।
মোস্ট ওয়েলকাম বন্ধু। চামচে খানিক ভেজিটেবলস উঠিয়ে মুখে পুরলো সুহৃদ।

দোস্ত এটা খেয়ে দেখ, হুনানা চিকেন। ভেরি টেস্টি। ইকবাল জিনিসটি সুহৃদের দিকে এগিয়ে দেয়। যেন সুহৃদ বাপের জন্মেও এসব খাবার খায়নি। সুহৃদও কম যায় না, ইয়ার তুম জো আইটেমকা নাম বোলা থা ম্যায় সুনাথা পার কাভি খায়া নেহি, জব ও ছামনে আয়া খানাতো পড়েগাই।

হা হা হা... সুহৃদের কথায় ইকবাল খানিক হাসি ঝুলিয়ে দিলো ঠোঁটে।
আচ্ছা ইকবাল, মিলির সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর?
কোন মিলি?
কোন মিলি মানে? এইটা তুই কী বলিস!
রিয়েলি কোন মিলি?

মিলি কে এখন তোকে আমার বলতে হবে? তবে বলছি শুনুন, যে মিলির সঙ্গে আপনি ভার্সিটির ছয়টি বছর কাটিয়েছেন, যে মিলিকে ছাড়া সেই সময়কার একটা দিনও আপনার চলতো না, যে মিলিকে আপনি অর্ধাঙ্গিনী বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যে মিলি বেটে করে লম্বা মতো...
থাম না ভাই। পাস্ট ইজ পাস্ট।
তো সে পাস্টকে প্রেজেন্ট আর ফিউচার করে ফেল না।
পাখি উড়ে গেছে।
পাখি উড়ে গেছে, কিন্তু কোনো খাঁচায় তো বন্দি হয়নি এখনো। কোনো খাঁচায় বন্দি হওয়ার আগে খপ করে ধরে নিজের খাঁচায় বন্দি করে ফ্যাল।
সে সম্ভাবনা খুবই কম।
আহা, কী দারুণ সম্ভাবনা! এখন হয়ে গেল সম্ভব না।
আরে, সব সময় কি সবাইকে ভালো লাগে!
ও এই কথা! তাহলে তোমার নতুন ভালো লাগাকেই জায়েজ করে নেও দোস্ত। শুধু শুধু গরুর হাটে খোঁজ দ্য সার্চ কেন?
প্যাঁচাস না, সেরকম কেউ নেই।
তাহলে আমেরিকায় তোর চলতো কী করে? নিচু স্বরে বলে সুহৃদ। এরপর ফিসফিসিয়ে চলে আরো কিছু আঠারো প্লাস কথোপকথন।

হা রে বন্ধু। কাজের ঠ্যালায় চোখে কিছুই দেখা যায় না।বাইরে কাজ, ঘরে এসেও কাজ। এজন্যই তো চলে এলাম।
আমাদের বাংলাদেশ অনেক ভালো।
হ্যাঁ, থাকো আরো কিছুদিন। তারপর বুঝবা কী চমৎকার লোডশেডিংয়ের লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প। তারপর যানজট অল্প, মন চায় উড়তে উড়তে বাইভার্বালে করে ঘুরতে। শেষের দিকে সুহৃদ হাল্কা সুর ধরলো।

আরে ইলেক্ট্রিসিটি না থাকুক, মোমবাতির আলোতে হলেও তো আপনজনের মুখ দেখতে পাব।
সাদা চামড়া দেখতে দেখতে পুরাই হাদা হয়ে গেছিস।
ধুরো, সাদার চেয়ে কাইল্লা বেশি।

রায়া অরণ্যকে খাওয়াতে ব্যস্ত হলো। দুই বন্ধুর কথায় অংশগ্রহণ করলো না। তার মন কী মৃদু বিষণ্ণ বা ঈর্ষান্বিত? কী কারণে, সে তা নিজেও জানে না। চলবে