শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’
পর্ব ২
প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০২২
সুহৃদ বিছানায় উপুড় হয়ে গভীর চিন্তামগ্ন। তার ডান হাতে ধরা কলমটি এখন স্থির। মাঝেমধ্যে সাদা খাতার কোনায় কোনায় আঁকিবুঁকি হচ্ছে। ফুল পাতা ছাইছাতা টাইপ দাগাদাগি। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে রায়া বললো, কী লিখছ এত শুনি।
সুহৃদ নিরুত্তর।
ওসব কবিতা টবিতা দিয়ে সংসার চলবে না, বুঝলে?
সংসার কি থেমে আছে? চলছে তো। রায়ার দিকে না তাকিয়ে সুহৃদ বললো। রায়া চুল আচড়ানো থামিয়ে সুহৃদের কাছে এগিয়ে এলো। সুহৃদ রায়ার এই ভঙ্গিটার সাথে পরিচিত। সে এখন কিছুটা আক্রমণাত্মক মন নিয়ে এগোচ্ছে। তার যত না পাওয়াগুলো আছে তা একে একে নখ দাঁত বের করবে। তবে সুহৃদ জমতে দেবে না। রায়া যত কথাই বলুক, সে উত্তর না দিয়ে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবে। পদ্ধতিটি মন্দ নয়। ঝগড়াঝাটি দু’পক্ষ না হলে জমে না। এখানে রায়াই বাঘিনী, সে মেনিবেড়াল। তাতে তার আক্ষেপ নেই। মেনি বেড়াল হয়ে যদি শান্তি রক্ষা হয়, হোক না।
রায়া মৃদু ঝাজালো কণ্ঠে বললো, সংসার থেমে নেই। তবে এটাকে কোনো চলা বলে না। সারাদিন একা একা খেটে মরি, তবু একটা কাজের লোক রাখি না।
রাখো না কেন? রাখলেই পারো। মিনমিনে কণ্ঠে সুহৃদ বললো।
কাজের লোকের বেতন এখন কত জানো তুমি? গ্রাম থেকে আসে ওরা গাদা গাদা ভাত খায়। চালের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। মাস গেলে একগাদা বিলের সাথে আরো একটা বিল যোগ হবে। কত করে বললাম পত্রিকা রাখা বাদ দিয়ে টিভিতে ডিশের লাইন লাগাও। বস্তির ঘরে ঘরে এখন ডিশের লাইন। তারাও সারাদিন রিকশা চালিয়ে, বাসায় কাজ করে রাতে এসে সিনেমা দেখে মজা করে। তোমার কোনো কিছুরই শখ নেই। কিপটামির জন্য নিজের সব শখই বিসর্জন দিতে পারো তুমি। কিন্তু আমিতো পারি না।
নিচে মেঝেতে খেলা করছিল অরণ্য। সেদিকে তাকিয়ে সুহৃদ বলে, দেখো আমি ডিশের কানেকশন নেই না শুধু ওর জন্য। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ছাড়া কোনো চ্যানেলে চোখ রাখা যায় না। মেয়েদের কাপড় চোপড়ের যা ছিরি!
ইস! একেবারে সাধু বাবা। সংসারধর্ম ছেড়ে গেরুয়া কাপড় পরে ইয়োগা করোগে যাও রামদেবের মতো। কবিরাই হলো এক নাম্বারের শয়তান।
আবার কবিরা কী দোষ করলো?
মেয়েদের পোশাকের কথা বলছ। সেই মেয়েদের উলংগ করেই যে কবিতা লিখতে ভালবাসো তোমরা। এখন কি আর সুকান্ত, নজরুলের মতো বিদ্রোহী কবি আছে? অথচ বিদ্রোহ করার মতো বহু ঘটনা রাষ্ট্রে-সমাজে ঘটে যাচ্ছে। আর কবিরা বুঁদ হয়ে আছেন নারীদেহ আর কামাসূত্রে। এইসব মলমূত্র ঘাটা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এদের। আগেকার দিনে একটা ভালো কবিতা সমাজ রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিতো। কবিকে জেলও খাটতে হতো। আর এখনকার বড় কবিরা কে কোথা দিয়ে কবে কোন কবিতা লিখল কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায় না।
কী যে বলো, শূন্য দশকের আজিজ কবিরা দুর্দান্ত লিখছে।
ওগুলো কবিতা নয়, পর্নোগ্রাফি।
প্রসঙ্গ ঘর থেকে বাইরে যাওয়ায় সুহৃদ আসন্ন ঝড়ো আবহাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হুলো। রায়ার মেজাজ ধীরে ধীরে ঠাণ্ঠা হতে শুরু করেছে। শোনো, জয়ার তো ইন্টার শেষ হলো। ও চাচ্ছে ঢাকায় এসে পড়াশোনা করতে।
বেশতো, আসুক। জয়া এলে তো ভালোই হবে। ও না ভালো গান গাইতো? এখনো শেখে নাকি?
গান শেখে, চমৎকার করে কথা বলে। খুলনার টান নেই কথায়। ওভার স্মার্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা, ইকবাল ভাইদের ফ্যামিলি কেমন?
ফ্যামিলি ভালোই। আর এখনতো ইকবাল আমেরিকা গিয়ে এলাহি অবস্থা করে ফেলেছে। তুমি কি জয়ার কথা ভাবছ?
ভাবছি, কিন্তু ইকবাল ভাইয়ের বয়সটা বেশি হয়ে যায়।
হ্যাঁ, জয়াতো বাচ্চা একটা মেয়ে। জয়ার সংগে আব্বা আম্মাকেও আসতে বলে দাও। অনেক দিন আসেন না। বাসায় ময়মুরুব্বি থাকলে বেশ ভরা ভরা লাগে।
হ্যাঁ, আব্বা কি আর তোমার মতো আরামের লেকচারার। কলেজ শেষে আব্বার কাছে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাইভেট পড়তে আসে ছেলেমেয়েরা। প্রাইভেট পড়িয়েই আব্বা খুলনার বাড়ি গাড়ি করেছেন। কোনোদিন অভাব কী জিনিস, তা আমাদের বুঝতে দেননি। আর এখন! শিক্ষকরা যে কেন শিক্ষক জামাই খোঁজে! তাদের সমঝোতার বিয়েতে সবার মুখে একটাই কথা ছিল, সুহৃদ মানুষ হিসেবে খুব ভালো, সে রায়াকে কষ্ট দেবে না। কষ্ট সুহৃদ দেয়নি বটে, কিন্তু অপূর্ণতার পাল্লাটি এত বেশি ভারি যে, সেটি বয়ে নিতে রায়া এখন রীতিমতো বিরক্ত। মায়া মমতাগুলোও দুই ঝিনুকের মাঝে মুক্তাবন্দি আজ। তাকে খুলে আর ঘষামাজা হয় না।
মা আমাকে পাখা কিনে দেবে? আমি উড়তে চাই। অরণ্যের আবদার শুনে তার মা বাবার চার চোখ মিলিত হলো পরম মমতায়। ঠোঁটে স্বর্গীয় হাসি।
ভাবি, আপনাকে পরীর মতো লাগছে। ইকবালের বেশরম প্রশংসায় রায়া একটু আড়ষ্ট হলো। চৈনিকের নরম আলোয় সেই লজ্জিত ভঙ্গি অপরূপ সোন্দর্যের দ্যুতি ছড়ায় ইকবালের চোখে। স্যুপের বাটির তলানিতে পড়ে থাকা সামান্য স্যুপটুকু খেতে ব্যস্ত হয় রায়া, সবুজ থাই পাতা সরিয়ে সরিয়ে। সবারই স্যুপ, অনথন শেষ, এখন মেইন কোর্সের অপেক্ষায়। সুহৃদ একটি টিস্যু দিয়ে অরণ্যের ঠোঁটের কোনা পরিষ্কার করে। এদিকে ওখানে পাশের চেয়ারে প্রজাপতি ডানা ঝাপটায় নতুন ফুলের সুরভিতে। ফুল তাতে বিরক্ত নয়। বরং মৃদুমন্দ জান্নাতের হাওয়া কোথা থেকে এসে যেন তার ঘরদোর স্নিগ্ধ করে। এক অনাবিল হাতছানি এসে নিষিদ্ধ গন্ধমের স্বাদ নিতে আকুলতা জানায়।
কী আশ্চর্য! কোথাও কোনো ঘটনা ঘটেনি। অথচ একঝাঁক সুখপাখি তার দরজায় কড়া নেড়ে যায়। ফাঁকফোকর গলে কেউ কেউ ঢুকেও পড়ে। এত আনন্দ কোথায় ছিল? কোথা থেকে এলো? চলবে