শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’
পর্ব ১
প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২২
দরজার ওপাশে সুইচে কারো তর্জনি পড়তেই কলিংবেলটা তারস্বরে তার দায়িত্ব পালন করলো। রায়া উঠে দরজার কাছে আসতে আরও দু’বার ঘন ঘন বেল বাজিয়ে আগন্তুক জানান দিল, সে কিছুটা অস্থির প্রকৃতির। অভ্যাসমতো ‘কে’ বলে দরজার হাতলে স্থির রায়া। উত্তরটা আতংকিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘র্যাব-টু থেকে এসেছি। দরজাটা খুলুন।’ এটুকু শুনতেই ভেতরের ড্রামবাদক দ্রুতলয়ের সংগীত উপযোগী প্রহার শুরু করলো ড্রামসে। শুনছ? একটু বের হও।
কেন? বাথরুম থেকে গমগম আওয়াজ এলো সুহৃদের। রায়া বিস্তারিত বলতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, ভয়ের কী আছে? আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি?
কিছুটা ভীরু পায়ে রায়াও সুহৃদকে অনুসরণ করলো। র্যাব মহাশয় ঘরে ঢুকতেই গালিগালাজে অনভ্যস্ত সুহৃদও একটা গালি ছুড়ে তাকে অভিবাদন জানালো। সুহৃদের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে সোফায় বসলো ইকবাল। কী কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম? কৌতুক মেশানো চোখে সে বললো। শালা এতদিন কোথায় ছিলি?
সুহৃদের কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো ইকবাল, এই সুন্দরী মহিলাটা কে?
আমার বউ।
রায়া, এ হচ্ছে ইকবাল। আমার ভার্সিটির বন্ধু। ও-ই যে আমেরিকায় থাকে, বলেছিলাম না?
রায়া হাত উঁচিয়ে সালাম দেয়ার মতোই করলো। ইকবালের ব্লেডের মতো ধারালো চোখ এবার রায়ার করোটিঘেরা মেঘমালা থেকে এক পায়ে পরা মাদুলির নূপুর অবধি সার্চ করে নেয়। অপুর্ব! মুখে নয়, মনে মনে বললো ইকবাল। আহামরি সুন্দরী বোধহয় একেই বলে! কথা বলা চোখ দুটোর মাঝের এলাকা দিয়ে উঠে গেছে অন্নপূর্ণা। তারই নিচে কমলালেবুর কোয়া দুটো। গোলাপী সালোয়ার কামিজের ওপরের দিকটায় বেগুনি রংয়ের ওড়নাটা সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়েছে। তবু বোঝা যায়, বেশ শক্তপোক্ত গড়ন। এত কিছুর পরে দুধ সাদা রঙটা না হলেও চলতো। শ্যামলা হলেও একে কিছু কম লাগতো না।
সে সুহৃদের পাশে বসতেই ভেতর থেকে চার পাচ বছর বয়সী ছেলেটি এসে মায়ের আঁচল ঘেঁষে বসলো।
আরে এইটা কে?
ইকবাল মিথ্যে বিস্ময় দেখালো।
চাচ্চুকে সালাম দাও বাবা। রায়ার কথা শেষ না হতেই সে এক দৌড়ে আবার ভেতরে চলে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে ইকবাল বললো, বাহ, দারুণ হ্যাপি ফ্যামিলি! আমার ও একটা গতি করে দে না। আমেরিকা আর ফেরত যাব না। টাকা-পয়সা প্রচুর নিয়ে এসেছি। এখানেই ব্যবসা বাণিজ্য করবো। অতএব পাত্র হিসেবে আমি একেবারে খারাপ নই। ভাবি, আছে নাকি আপনার কোনো বোন টোন আপনার মতো সুন্দরী?
রায়া বুঝি এবার একটু লজ্জাই পেল। মুখে হাসি ধরে সে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। লজ্জা পেলেও তার ভেতরটা একটু পুলকিত হলো বৈকি। নিজের প্রশংসা কার না শুনতে ভালো লাগে! মেহমান আপ্যায়নে একটু বিচলিতই হলো সে। ঘরে তৈরি কিছু নেই। সুহৃদটাও যা গল্পে মেতে আছে, কী খাওয়াবে তার কোনো ফিকির নেই। রায়া দুই চুলায় আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ চাপালো। সেদ্ধ হয়ে এলে শুকনো মরিচ আর পেয়াজ দিয়ে আলু ভর্তা করে ভেতরে সেদ্ধ ডিমের অর্ধেকটা ফালি করে ভরে দিলো। এরপর সে ফেটা ডিমে চুবিয়ে বিস্কুটের গুড়োতে গড়িয়ে তেলে ছেড়ে দিল। তার মন অবশ্য ডিমচপে নেই। মৃদু ভাসমান হয়ে বিক্ষিপ্ত চিন্তায় মগ্ন। এই জামাটা সে আজ পরেছে কেন? এটা বেশ মলিন হয়ে গেছে। চুলটাও ঠিকমতো পরিপাটি নেই।
ড্রয়িংরুমে ইকবাল আর সুহৃদের আলাপচারিতা এখন পেশার দিকে মোড় নিয়েছে।
তুই কি এখনো কলেজে পড়াচ্ছিস?
হ্যাঁ, আর কী করবো?
প্রাইভেট টিউশনিও করাস নাকি?
বাংলা কে পড়তে আসে?
হ্যা তাই তো! ইকবাল এ কথা বলে ঘরের সবকিছুতে চোখ বোলাতে লাগলো, যেন বাংলা পড়ানোর অপরাধেই সুহৃদের ঘরদোর এমন দীনহীন। তারা যে বেতের সোফাটায় বসেছে তার পাশে একটা রট আয়রনের টু সিটার। সেন্টার টেবিলটার ছোট্ট ফুলদানিতে দুটো প্লাস্টিকের গোলাপ। খানিক দূরে একপাশে ডাইনে টেবিল। সেখানে সুহৃদের দু’একটা অগোছালো বইপত্র পড়ে আছে। মনে হচ্ছে, এই একটু আগেও কেউ পড়ছিল। রায়া নাশতার ট্রে হাতে ঘরে ঢুকতেই ইকবাল সেদিকে মনোযোগী হলো। সুহৃদ চায়ের কাপ নিতে নিতে বললো, বিকেলবেলা আমি বাসাতেই থাকি। চলে আসিস মাঝেমধ্যে।
ইকবাল জানালো, সে নিশ্চয়ই আসবে। না এলে তার চলবে কেন! চলবে