শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২
কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ ভারতের উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে তার জন্ম। আদিনিবাস উত্তর কোলকাতার বরানগর কুঠিঘাটে। সারা জীবন কথাসাহিত্য চর্চা করে গেলেও কয়েকটি কবিতা তিনি লিখেছেন। তার মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
ওরে মাতাল, দুয়ার খুলে দিয়ে
ওরে মাতাল দুয়ার খুলে দিয়ে
পথেই যদি করিস মাতামাতি
থলি ঝুলি উজাড় করে দিয়ে
যা আছে তোর ফুরাস রাতারাতি।
অশ্লেষাতে যাত্রা করে শুরু
পাঁজি পুঁথি করিস পরিহাস
অকারণে অকাজ নিয়ে ঘাড়ে
অসময়ে অপথ দিয়ে যাস।
হালের দড়ি আপন হাতে কেটে
পালের পরে লাগাস ঝড়ো হাওয়া
আমিও ভাই তোদের ব্রত লব
মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া।
ওগো বহ্নি, জ্বলো জ্বলো
ওগো বহ্নি, জ্বলো জ্বলো
বহে জীবন নদী খর বৈতরণী
কল কল ছল ছল!
তারি তীরে সে তিমিরে
প্রাণবহ্নি জ্বলো জ্বলো।
হাসে মৃত্যু বিষকণ্ঠে খলখল
নাচে ধ্বংস—কাঁপে পৃথ্বী টলমল
তারি ছন্দে মহানন্দে
চিতা-ধূমে শবগন্ধে
প্রেমবহ্নি, জ্বলো জ্বলো।
আমার মন-চুয়ানো মধু
আমার মন-চুয়ানো মধু
ঝরবে যখন বাতাসে ক্ষরবে যখন
আসবে নাকি বঁধু?
গন্ধে যখন ভরবে চরাচর
আসবে নাকি মধু-মাতাল
পাগল মধুকর?
ওগো তার তরে যে আমি
পথটি চেয়ে কাটাই দিবাযামী
আমার বুকের বরমালা
সুখের মধু-ঢালা
পরিয়ে দেব তার গলাতে
আসবে যখন বরমালার বর—
মধু-পাগল মধুকর!
আমার মনে যে ফুল ফুটেছিল
আমার মনে যে ফুল ফুটেছিল
আকাশের সূর্য তারে শুকিয়ে দিল রে।
ধূলাতে পড়ল ঝরে সে
বাতাসের নিদয় পরশে
বুকে মোর কাঁটার বেদনা
বুক দুখিয়ে দিল রে।
আমার মনে চাঁদ—
আমার মনে চাঁদ যে উঠেছিল
ও তারে প্রলয় মেঘে লুকিয়ে দিল রে।
মরমের মৌন অতলে
নিরাশার ঢেউ যে উথলে—
জীবনের পাওনা-দেনা মোর
কে চুকিয়ে দিল রে।
ডাকব নাকি পুলিশ
পড়ার ঘরে পড়তে বসি যখন
বাবা ডেকে বলেন, ওরে খোকন,
মন দিয়ে খুব করিস্ লেখাপড়া
একজামিনে নইলে খাবি বড়া।
কিন্তু আমি পড়ি কেমন করে?
বাবা জানেন না তো, পড়ার ঘরে
জুটেছে সব দুষ্টু পাজি যত
পড়তে কি দ্যায় একটু মনের মতো?
বলেন বাবা, কেবল পড়া ভুলিস্!
ডাকব নাকি পুলিশ?
টিকটিকি, তুই আমার দেয়ালে
ঘুরে বেড়াস্ মনের খেয়ালে।
কার হুকুমে করিস্ পোকা সাবাড়?
পোকা ছাড়া নেই কি রে আর খাবার?
আয় না নেমে উঁচু দেয়াল ছেড়ে
ল্যাজটি কেটে বানিয়ে দেব বেঁড়ে!
কইলে কথা, বল্ তো ওরে নবাব,
একটি বারও দিস্ না কেন জবাব?
পোকা-মাকড় খেয়ে কেবল ফুলিস্
ডাকব নাকি পুলিশ?
ছারপোকা, তুই আমার চেয়ারে
লুকিয়ে বসে থাকিস যে, আরে!
ভাবিস বুঝি চেয়ারখানা তোর?
বেরিয়ে কেন আসিস্ না রে, চোর।
কুটুস কুটুস কামড় দিয়ে জ্বালাস্—
ফুড়ৎ করে ফুটোর মধ্যে পালাস!
একরত্তি চেহারা তোর, তাই
ধরতে গিয়ে ফস্কে খালি যাই।
পড়ার সময় পাগল করে তুলিস,
ডাকব নাকি পুলিশ?
আরশোলা, তুই ফরফরিয়ে উড়িস
দেমাক-ভরে মাথার ওপর ঘুরিস্!
নিজেকে তুই মনে ভাবিস্ নাকি—
উড়োজাহাজ কিম্বা ঈগল পাখি?
পড়িস যদি চীনেম্যানের হাতে,
কচমচিয়ে চিবিয়ে খাবে দাঁতে।
আমি নেহাৎ ভালমানুষ ছেলে!
আমার ঘরেই উড়িস্ পাখা মেলে
সড়সড়িয়ে পিঠের পরে বুলিস্—
ডাকব নাকি পুলিশ?
মাকড়সা, তুই ঘরের কোণাতে
ব্যস্ত আছিস্ যে-জাল বোনাতে,
সে-জাল নিয়ে করবি কি`রে বোকা?
ডাঙ্গায় বসে ধরিস্ খালি পোকা।
জেলে ধরে কাৎলা ইলিশ রুই
মাছ না ধরে মাছি ধরিস তুই!
ছাত থেকে তুই শূন্যে নেমে ঝুলিস্
দোলনা চেপে মনের সুখে দুলিস্
দুলে দুলে বোধ হয় খালি ঢুলিস্—
ডাকব নাকি পুলিশ?