শব্দ দূষণ: এক নীরব ঘাতক

মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০১৬

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এক দিকে যেমন বৃদ্ধি পায় পরিবেশ দূষণ অন্যদিকে তেমনি বৃদ্ধি পায় উন্নত জীবন শৈলির প্রতি মানুষের সচেতনতা। উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে সাধারণত: পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হচ্ছে অধিক উৎপাদন এবং ভোগ যা পরিবেশের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে এবং ঘটায় দূষণ। উন্নয়ন যদি স্থায়িত্ব অর্জন করে তাহলে জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং উন্নত পরিবেশের প্রতিও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ এবং সরকার পরিবেশ দূষণ মোকাবেলায় অধিক অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয়। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের পর ধীরে ধীরে পরিবেশ দূষণ হ্রাস পেতে থাকে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পরিবেশ দূষণের সম্পর্কটি প্রথম দিকে ধণাত্মক থাকলেও এক পর্যায়ে তা ঋণাত্মক হয়ে যায়। অর্থনীতিতে এই ধারণাটি পরিবেশগত কুজনেট রেখা হিসাবে পরিচিত। কোন গবেষণা লব্দ ফলাফল ছাড়াই সাধারণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশেও কুজনেটের অনুসিদ্ধান্ত ক্রিয়াশীল রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে দেশের, বিশেষ করে ঢাকার পরিবেশগত অবনতির যে চিত্র ছিল তা ২০১৫ তে এসে কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। পরিবেশ দূষণ মোকাবেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক কার্যক্রমও পরিবেশগত উন্নতির একটি নির্দেশক। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মৃত্তিকা দূষণ প্রভৃতি দূষণের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারী, বেসরকারী ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশগত দূষণের একটি বিশেষ রূপ শব্দ দূষণ অত্যন্ত ক্ষতিকারক হলেও এর প্রতি আমাদের দেশে সচেতনা খুবই কম।
শব্দ দূষণ এবং এর প্রভাব
উচ্চ এবং অবাঞ্চিত কোন শব্দ যা পরিবেশের এবং মানুষ বা অন্য কোন জীবের ভারসাম্য বিনষ্ট করে তাকেই আমরা শব্দ দূষণ বলে থাকি। শব্দ দূষণের ফলাফল তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝা যায় না। এটি সাধারণত পরোক্ষ ভাবে এবং ধীরে ধীরে মানব শরীরের উপর প্রভাব ফেলে থাকে। শব্দ দূষণের প্রধান শিকার মানুষের কান। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। তাহলে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার আশেপাশে নিয়মিত ভাবে কর্মরত ব্যক্তিদের শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কথা। ট্রাফিক পুলিশরা সাধারণত দীর্ঘ সময় জুড়ে উচ্চ শব্দের মধ্যে তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু তাদের উপর শব্দ দূষণের ফলাফল কি হয়েছে তা এখনো যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়নি। যদি ট্রাফিক পুলিশদের শ্রবণ সংক্রান্ত সমস্যা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে তাদের জন্য শব্দ দূষণ ভাতা প্রবর্তন করা উচিৎ। তবে কানই শব্দ দূষণের একমাত্র শিকার নয়। শব্দ দূষণের ফলে তাৎক্ষণিক ভাবে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় এবং বেড়ে যায় হৃদযন্ত্রের কম্পন। অনেকের সাময়িক ভাবে মাথা ঘুরা বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। শব্দ দূষণের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে বৃদ্ধি পায় উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, মেজাজ হয়ে উঠে খিটখিটে। ঢাকা শহরে চলাচলকারী লোকজনের মধ্যে যে অসহিষ্ণুতা এবং বদ মেজাজ দেখা যায় তার সাথে এই শহরের ভয়ংকর মাত্রার শব্দ দূষণের একটি কার্যকরী সম্পর্ক থাকতে পারে। ব্যস্ত কোন রাস্তায় কিছুক্ষণ অবস্থান করলে গাড়ির অযথা পুন:পুন: হর্ণ বাজানোর শব্দে ত্যক্ত হয়ে যে কেউ অন্যের সাথে সহজেই দুর্ব্যবহার করতে পারে। আহমেদ (১৯৯৮) এক গবেষণায় দেখান যে ঢাকাবাসীদের শ্রবণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত রোগীদের ৫% হতে ৭% শব্দ দূষণের কারণে কানের স্থায়ী সমস্যায় ভুগছেন। তবে শব্দ দূষণের সবচেয়ে সহজ শিকার হচ্ছে শিশুরা। তাদের শ্রবণীন্দ্রীয়সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অতি সহজেই শব্দ দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হয়। আমাদের ঢাকা শহরে বেড়ে উঠা শিশুরা তাই অল্প বয়সেই হয়ে পড়তে পারে কানের রোগী। এতে করে কিছু দিনের মধ্যেই নাক, কান ও গলার ডাক্তারদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেলেও শহরে পুন:পুন: ভাবে সেই ঘটনাটি ঘটতে দেখা যাবে যেখানে হঠাৎ দেখা হওয়া এক প্রতিবেশীর সাথে আরেক প্রতিবেশীর সংক্ষিপ্ত কথার ধরণ হবে এই রূপ- ‘কি ভাই, বাজারে যাচ্ছেন নাকি?’; ‘না না ভাই, আমিতো বাজারে যাচ্ছি’; ‘ও, তাই বলেন! আমিতো ভাবলাম আপনি বুঝি বাজারেই যাচ্ছেন’। অর্থাৎ, একজন আরেক জনের কথা না বুজেই কথা চালিয়ে যাবে।
শব্দ দূষণের উস
শব্দও যে একটি দূষণ এবং মানুষসহ জীব জগতের উপর এর অভিঘাত কত মারাত্মক হতে পারে তা সাধারণ মানুষ সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে পারেন না। তাই আমাদের চারপাশে আমরা প্রতি নিয়ত শব্দ দূষণ সংঘটিত করে থাকি। বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঘরে-বাহিরে ঢাকাবাসী অনবরত শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছে। নিজের ঘরে নিরাপদে বিশ্রাম করার সময়েও আমরা শব্দ দূষণের শিকার হই। বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী গৃহ অভ্যন্তরে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস। প্রেসার কুকার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, এসি, ওয়াসিং মেশিন, টেলিভিষণ, লাউড স্পিকার  প্রভৃতি যন্ত্রপাতি দীর্ঘ সময় জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শব্দ সৃষ্টি করে থাকে যা নীরবে মানব শরীরের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হর-হামেশাই নির্মাণ কার্যক্রম চলতে দেখা যায়। নির্মাণ কার্যক্রমে উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মেশিন ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা আশে-পাশে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ ছড়িয়ে থাকে। মোবাইলের উচ্চ রিং টোনও একটি শব্দ দূষক। ঘরের বাহিরে আমরা যে সমস্ত শব্দ দূষকের মুখোমুখি হই সেগুলো হচ্ছে গাড়ির হর্ণ, মাইকের শব্দ, ট্রেন, হেলিকপ্টার বা এরোপ্লেনের শব্দ, হইচই চেচামেচি প্রভৃতি।   
শব্দ দূষণ মানুষ ছাড়াও পরিবেশের অন্যান্য জৈবিক ও অজৈবিক উপাদানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঢাকা শহরে মানুষ ছাড়া অন্য কোন জীব সম্প্রদায় খুজে পাওয়া দুষ্কর। সামান্য কিছু গাছপালা, ছোটখাট পাখি, রাস্তার কুকুর-বিড়াল-ইদুঁর এবং মশা ছাড়া আর কোন জীব-সম্প্রদায় এখানে খুজে পাওয়া যায় না। এই ক্ষুদ্র জীবন্ত সত্ত্বাগুলোর ঢাকা শহরের মারাত্মক শব্দ দূষণের কারণে যে কি অবস্থা তা এক মাত্র বিধাতাই জানেন। আবার, শব্দ যেহেতু এক ধরণের কম্পন, তাই উচ্চ কম্পনের শব্দ পরিবেশের অজৈবিক উপাদানের ভারসাম্যকেও বিনষ্ট করে।
ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের বর্তমান অবস্থা    
ঢাকা শহরের শব্দ দূষণের প্রকৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা নিবন্ধ পাওয়া যায়। এদের সবকয়টিতেই শব্দ দূষণের যে চিত্র পাওয়া যায় তা ভয়াবহ এবং রাষ্ট্র অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশী। দেশের শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক শব্দের অনুমোদিত সর্বোচ্চ মাত্রা টেবিল-১ এ তুলে ধরা হলো।
টেবিল-১
ক্রমিক নং    এলাকার শ্রেণী    মানমাত্রা  (ডেসিবল ফন(অ)খবয়)

        দিবা
(ভোর ৬টা হতে রাত ৯টা)    রাত্রি
(রাত ৯টা হতে ভোর ৬টা)
১।    নীরব এলাকা (হাসপাতাল, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)    ৫০    ৪০
২।    আবাসিক এলাকা    ৫৫    ৪৫
৩।    মিশ্র এলাকা    ৬০    ৫০
৪।    বাণিজ্যিক এলাকা    ৭০    ৬০
৫।    শিল্প এলাকা    ৭৫    ৭০
এখন আমরা ঢাকার শব্দ দূষণের উপর পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করব। হক এবং অন্যান্য (২০১২) রমনা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় দিবাকালে শব্দের সর্বোচ্চ যে গড় মান লক্ষ্য করেন তা আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে টেবিল-২ উপস্থাপন করব।  
টেবিল-২
ক্রমিক নং    স্থানের নাম     শব্দমাত্রা  (ডেসিবল ফন(অ))

        সর্বোচ্চ    সর্বনি¤œ
১।    মালিবাগ (বাণিজ্যিক এলাকা)    ৮৪    ৭১.৭
২।    কাকরাইল (বাণিজ্যিক এলাকা)    ৮৪.৬    ৭৩.৭
৩।    শাহবাগ (বাণিজ্যিক এলাকা)    ৮৫.৬    ৭৫
৪।    বাংলামোটর (বাণিজ্যিক এলাকা)    ৮৬.৭    ৭৫
৫।    ভিকারুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজ (নীরব এলাকা)    ৮০    ৬৯.৭
৬।    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাসের সামনে) (নীরব এলাকা)    ৭৮    ৬৯
৭।    ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (নীরব এলাকা)    ৭০.৬    ৬৩.৭
৮।    হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল (নীরব এলাকা)    ৭৩    ৬৩.৩
৯।    উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল (নীরব এলাকা)    ৮০    ৭০
১০।     নীলক্ষেত (বাণিজ্যিক এলাকা)    ৭৯    ৭০

টেবিল-২ এ যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা ঢাকার অন্যান্য অঞ্চলেও কম-বেশী একই রকম। টেবিল-১ এর সাথে টেবিল-২ এর তুলনা করলেই ঢাকা শহরের বর্তমান শব্দ দূষণ পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়। বাণিজ্যিক এলাকার সর্বোচ্চ অনুমোদিত শব্দ মাত্রা যেখানে ৭০, সেখানে ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয় শব্দ মাত্রা প্রায়শ:ই ৮০ হতে ৯০ এর মধ্যে থাকে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে নীরব এলাকাগুলোর অবস্থা। হাসপাতাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব এলাকার মধ্যে পড়ে। উচ্চ শব্দ তরঙ্গের দ্বারা অসুস্থ ব্যক্তি এবং ছাত্রদের পড়াশুনা ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নীরব এলাকায় উচ্চ শব্দ একেবারেই কাম্য নয়। শব্দ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এ নীরব এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৫০। টেবিল-২ এ দেখা যায় যে আমাদের হাসপাতাল এবং  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শব্দ তরঙ্গের সর্বোচ্চ মান ৮০‘র ঘরেও পৌছে যায়। পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ।
শেষ কথা
এই অবস্থা হতে উত্তোরণের একটিই উপায়। তা হচ্ছে শব্দ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা। যার যার অবস্থান হতে জনগণকে শব্দ দূষণ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একজন যখন বুঝবে যে গাড়ির হর্ণ সত্যিই ক্ষতিকারক তখন অন্ততপক্ষে সে অযথা হর্ণ বাজাবে না। উচ্চ শব্দের মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণেও সচেতনা জরুরি। আর আমাদের গৃহের শব্দ দূষণ তো শুধুমাত্র আমরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এই ক্ষেত্রেও ব্যক্তির সচেতনতাই একমাত্র ভরসা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর