শঙ্খচিলের প্রবন্ধ ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রত্যয়’

শেষ পর্ব

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ও মাওবাদ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২০

কেন সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী?

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির শ্রম বিক্রি করা ছাড়া বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই। তাই তারা নিজেদের এইরকম দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণিগত বিকাশ চাইতে পারেনা। তারা চায় তাদের এই যন্ত্রণাদায়ক শ্রেণিগত অবস্থার অবলুপ্তি। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থার অনিবার্য অংশ হিসেবে তারা দেখতে পায় তাদের মেহনতে তৈরী সমস্ত সম্পদ, অথচ তা থেকে তারাই বঞ্চিত। কারণ উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকতা সত্বেও তাদের এই শ্রেণিগত দুর্দশার জন্য দায়ী উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তি মালিকানা। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারায় সর্বহারা শ্রমিক তৈরির যন্ত্র প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বজায় রেখে তাদের শ্রেণি অবলুপ্তি বা মুক্তি সম্ভব নয়। অতয়েব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সহ সমস্ত শ্রেণি অস্তিত্ব ধ্বংস করে সাম্যবাদী সমাজ তৈরির পথই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির একমাত্র পথ। এই বিপ্লবী দায়িত্ব নিয়েই শ্রমিক শ্রেণি রঙ্গমঞ্চে হাজির হয়েছে বিপ্লবী সর্বহারা হিসেবে। আর মার্কসবাদ যেহেতু শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির এই মতাদর্শ হাজির করেছে তাই তা হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণি সহ সমগ্র মানব জাতির শোষণ মুক্তির মতবাদ। স্তালিন বলেছেন: "মার্কসবাদ হলো শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তি"।


শ্রমিক শ্রেণির এই বিপ্লবী মতাদর্শ নিয়ে এত কথার কারণ কি? কি বলে লেনিনবাদ?

সুতরাং দেখা গেল মার্কসবাদকে শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব বললে তার বিপ্লবী শিক্ষাকেই হেয় করা হয়। বুর্জোয়ারা এমনটাই চায়। তাই কমরেড লেনিন বলেছেন "সেই শুধু মার্কসবাদী যে শ্রেণি সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা একনায়কত্ব পর্যন্ত প্রসারিত করে"। আর দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে তার এক উপযোগী বিপ্লবী পার্টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন লেনিন। তাকে মার্কসবাদের সফল প্রয়োগের জন্য তত্ত্বে ও প্রয়োগে মার্কসবাদের বিকাশ সাধন করতে হয়। তিনি শ্রমিক শ্রেণির প্রধান সংগঠন হিসেবে পার্টির ভূমিকা ও নীতি-পদ্ধতি তুলে ধরেন তার বিখ্যাত “এক পা আগে, দু’পা পিছে” নামক বইয়ে। একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হলে শ্রমিক শ্রেণির কী ধরনের পার্টি গঠন করতে হবে লেনিন তার নীতিমালাগুলো গড়ে তুলতে থাকেন।

লেনিনিয় এই শিক্ষা আকাশ থেকে পরেনি বা এ লেনিনের ব্যক্তি প্রতিভারও ফল নয়। শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মতবাদ মার্কসবাদের শুরু থেকেই তার বিকাশ ও শ্রমিক বিপ্লবে তার সফল প্রোয়োগের ঐতিহাসিক ধারায় গড়ে ওঠে লেনিনবাদ। যা মার্কসবাদের শুরুর থেকেই মার্কস, এঙ্গেলসের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ফলাফল থেকে উঠে এসেছে। মার্কস নিজে প্রথমে “জার্মান শ্রমিক সমিতি” গঠন করেন এবং পরে “কমিউনিস্ট লীগ” নামে এক গোপন প্রচার সমিতিতে যুক্ত হন। ১৮৪৮ সালে এই সংগঠনের দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকেই মার্কস-এঙ্গেলস সুবিখ্যাত “কমিউনিস্ট ইশতেহার” প্রকাশ করেছিলেন। এর বিলুপ্তির পর তারা “দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক” গড়ে তোলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর বার্নস্টাইন-কাউটস্কির মত নেতারা মার্কসবাদকে সময়পযোগী সংশোধনের নামে তার বিপ্লবী মর্মবস্তু বাদ দিয়ে তাকে শত্রু শ্রেণির উপযোগি করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। `বার্নস্টাইন` মার্কসের পুঁজির কেন্দ্রীভবণ ও শ্রমিকের ক্রমাগত গরীব হয়ে পরার কথা মানতেন না। শ্রেণি সংগ্রাম, বল প্রোয়োগের তত্ত্ব ও তার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ত্ব তিনি অস্বীকার করতেন। পুঁজিবাদ ভেঙে পরবে বলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন সংস্কার মূলক ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলে যাবে। শ্রমিকের কাজ সংস্কার সাধন, "চুরান্ত লক্ষ্য বা বিপ্লব" এবং সর্বহারা একনায়কত্ব ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন নেই। আন্দোলনই শেষ কথা। তিনি তার বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র বইয়ের মাধ্যমে এই মতবাদ তুলে ধরেন। মার্কসবাদীরা তাই বার্নস্টাইনকেই সংশোধনবাদের জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই মতবাদকে অর্থনীতিবাদী বা বিবর্তনবাদীও বলা হয়। এরপর বিভিন্ন রুপের সংশোধনবাদের সঙ্গে লড়াই করেই বিপ্লবী মার্কসবাদীদের পথ চলতে হয়েছে।

কমরেড লেনিন এই সমস্ত ভূল চিন্তা ভাবনার বিরুদ্ধেই “কী করিতে হইবে” শীর্ষক পুস্তকের মাধ্যমে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তিনি বলেন "সাধারণ শ্রমিকশ্রেণি থেকে পার্টির পার্থক্য আছে। পার্টি হলো শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামীদের বাহিনী। শ্রেণি চেতনায় সজ্জিত মার্কসবাদী বাহিনী। কেউ শ্রমিক হলে বা ধর্মঘটে যোগ দিলেই সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারে না। আবার তথাকথিত মার্কসবাদী পণ্ডিত হলেও চলবে না। বিপ্লবী রীতি-নীতি সহ অনুশীলনে পরিক্ষীত সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠবে বিপ্লবী পার্টি। যাতে সাধারণ শ্রমিক ও পার্টি সদস্যর পার্থক্য গুলিয়ে না যায়। সুতরাং পার্টি হলো শ্রমিক শ্রেণির অগ্রসর অংশ। যারা মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় সজ্জিত।" পার্টি গঠন ও কাঠামো সম্পর্কে লেনিনের মত ছিল- "পার্টির দুটো অংশ থাকবে, ১) নেতৃস্থানীয় নিয়মিত কর্মিদের নিয়ে একটি ঘণবদ্ধ চক্র। যারা মূলত সেই পেশাদার বিপ্লবী, দৃঢ় সুশৃংখল, অর্থাৎ যারা পার্টির কাজ ছাড়া আর কিছু করেন না এবং যতটা দরকার ততটা মার্কসবাদী জ্ঞান, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও শত্রুর পুলিশকে পাল্লা দেওয়া ও এড়িয়ে চলার জন্য গোপনে পার্টি কার্যক্রম চালাতে সক্ষম ২) স্থানিয় পার্টি সংগঠনগুলির বিস্তৃত জাল এবং অসংখ্য এমন পার্টি সভ্য যারা লক্ষ লক্ষ মেহনতী জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন প্রাপ্ত। যাদের মাধ্যমে সমগ্র নীপিড়িত জনগণ পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তিনি বলেন পার্টির সভ্য সে-ই হতে পারবে যে ব্যক্তি পার্টির কোন না কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকবে, পার্টিকে চাঁদা দেবে। পার্টির কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত না হয়ে পার্টি সদস্য হওয়া যাবে না।" তিনি আরও বলেন, “পার্টিকে হতে হবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনী, সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের সমন্বয় সাধনে ও পরিচালনায় ব্রতী, পুঁজিতন্ত্রের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই হলো পার্টির চরম লক্ষ্য”। এই লক্ষ্যে একটি সঠিক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার জন্য লেনিন প্রথমে রাশিয়ায় “শ্রমিক মুক্তি সংঘ”, পরে “রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি” গঠন করেন। কিন্তু বার্নস্তাইনপন্থী অন্যান্য সোশ্যাল ডেমোক্র‍্যাটদের থেকে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আলাদা করতে তিনি তার বিখ্যাত “এপ্রিল থিসিস” দলিলে সুনির্দিষ্টভাবে সোশ্যাল ডেমোক্রাট নাম পরিবর্তন করে কমিউনিস্ট পার্টি রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়া (বলশেভিক)। সেই থেকে সোশ্যাল ডেমাক্র্যাটদের থেকে কমিউনিস্টদের সুস্পষ্ট বিভাজন হয়ে যায়। যাবতীয় ভুল ও সুবিধাবাদি শক্তির সঙ্গে জটিল ও বহুমাত্রিক সংগ্রাম চালনার বৈজ্ঞানিক উপায় হিসেবে ১৯১৬ সালে অনুষ্ঠিত রাশিয়ান পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে পার্টির প্রতি সদস্য, প্রতি ইউনিট এবং প্রতি সংস্থার জন্য অবশ্য পালনীয় "গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা"র সাংগঠনিক নীতিমালা গৃহীত হয়। যে নীতিমালা ছাড়া মতপার্থক্যসহ পার্টি পরিচালনা অসম্ভব। এটাই হলো লেনিনবাদী পার্টি-নীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই হলো বিপ্লবী পার্টি পরিচলনায় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ঐতিহাসিক তাৎপর্য।


এর থেকে কি শিক্ষা উঠে আসে?

এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী মতাদর্শকে প্রথম দিন থেকেই শ্রেণি সমঝোতার মতবাদ বা সংশোধনবাদের বিপদের সঙ্গে লড়াই করেই এগোতে হয়েছে। বলা বাহুল্য তা হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব শিবীর থেকেই। শ্রমিক দরদী, তার সংগঠন ও তার নেতাদের মুখোশের আড়ালেই। শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শ ও তার সংগঠনকে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন শ্রেণির যুতসই, আহ্লাদের বিষয় করে গড়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রামে। তাই কমরেড মাও সে তুং শিখিয়েছেন `সংশোধনবাদের এই বিপদ শ্রেণি বিভক্ত সমাজের প্রতিফলন রূপে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরের একটি সংগ্রাম হিসেবে সম্পূর্ণ সাম্য ব্যবস্থা অর্জিত হওয়া অবধি থাকবে। যার বিরুদ্ধে সঠিক বিপ্লবী লাইনের অব্যাহত সংগ্রামই মার্কসবাদীদের লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র পথ। যাকে মাও বলেছেন দুই লাইনের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম চলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার বৈজ্ঞানিক নিয়মে। আমরা দেখলাম সংশোধনবাদের সঙ্গে সংগ্রাম করেই এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার লেনিনবাদী নীতি গড়ে উঠেছে। সুতরাং এর বিরোধীতা মানে মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিরোধীতা ও সংশোধনবাদকে মজবুত করার সামিল।


এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার বিপক্ষে ঝুঁকিটা কি?

আমরা জানি শ্রেণি আধিপত্য ও সেই জন্য অল্প লোকের কর্তৃত্বের ধারণা তো শোষণমূলক ব্যবস্থারই অবদান। যা হাজার হাজার বছরের অভ্যেসে পুরো সমজটাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যা আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বে পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি পুরো সমাজটারই ঘণীভূত রূপ তাই পার্টিতেও সমাজের বাস্তব দোষ গুণের প্রতিফলন হিসেবে আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সংক্রমণ দেখা দেয়। যা আসলে একটি বুর্জোয়া মতাদর্শ। সঠিক বোঝাপড়ার অভাবে অনেকেই একে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। যার সুযোগে ঝানু সুবিধাবাদিরা খোদ একেকটা আমলাতান্ত্রিক কর্তা হয়ে উগ্র গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া স্বাতন্ত্রবাদের আখড়া বানাতে চায় পার্টিকে। আর আমলাতান্ত্রিক কর্মপ্রক্রিয়ার বারংবার পুণরাবৃত্তির বিরুদ্ধে হতিশার প্রকাশ হিসেবে দেখা দেয় মতান্ধতাবাদী হঠকারীতা। যা আসলে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অজুহাতে তাকেই শক্তিশালী করে। তাই কমঃ মাও আমলাতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন "একদিকে আমলাতান্ত্রিক শ্রেণি আর অন্যদিকে গরীব ও মাঝারি কৃষক সহ শ্রমিক শ্রেণি হচ্ছে পরস্পর যুযুধান দুইটি শ্রেণি"।


গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ও মাওবাদ:

পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদের স্তরে বিকোশিত হয়ে আন্তর্জাতিক ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে পশ্চাৎপদ ও পাকপুঁজিবাদী উপনিবেশ গুলোতে পুরোনো ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে আশু শ্রমিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি শক্তি সংহত করে আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন শ্রমিক শ্রেণিরও প্রয়োজন হয়ে পরে আরও বেশী বেশী নিবিড় যুদ্ধ নীতি সজ্জিত তার চার পাশে বিপুল নিপীড়িত জনগণের সমাবেশ কর্মসূচির। যা করার হাতিয়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবিরকে সময়পযোগি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন কমরেড মাও সে তুং। চীন বিপ্লবের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন "এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলো পশ্চাদপদ পাক পুঁজিবাদী দেশ গুলোকে উপনিবেশ করে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে। তারা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের গ্যারান্টি হিসেবে সেইসব পশ্চাদভুমির পুঁজিবাদী বিকাশকে আটকাতে পাক পুঁজিবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে গাটছড়া বেধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। তৈরী করেছে একদল দালাল পুঁজিপতি, যারা পশ্চাদপদ সামন্ত ব্যবস্থার সঙ্গে আঁতাত করে জন্ম দিয়েছে আধা উপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক এক বিকৃত ব্যবস্থা। সুতরাং এই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এইসব আধা উপনিবেশগুলিকে শোষণ করে তাদের দেশের সর্বহারা বিপ্লবকে আটকে রাখে। অতয়েব এই অবস্থায় এইসব আধা উপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলোই হলো বিশ্ব বিপ্লবের কেন্দ্র। কিন্তু এইসব দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব না হওয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকিকরণও হয়নি। ফলত এসব দেশে সর্বহারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিস্থিতি থাকে না। অসম বিকাশ, সমস্যার বিভিন্নতা ও সেইজন্য এলাকা ভিত্তিক চেতনার তারতম্যকে কাজে লাগিয়ে এইসব অঞ্চলে নিপীড়িত জনগণকে বহু বিভাজিত করে শ্রেণি সংগ্রামকে দুর্বল ও বিপথগামী করার সুযোগ থাকে। তাই এখানে বুর্জোয়াদের অসম্পন্ন বকেয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দায় বর্তায় শ্রমিক শ্রেণি ও তার পার্টির উপর। বুর্জোয়াদের বদলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকিকরণ করার এক নয়া বৈপ্লবিক স্তর পেরিয়ে সর্বহারা সমাজতান্ত্রিক গঠন কার্যের ভিত্তি তৈরী করার এই নতুন পথকেই কমরেড মাও নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেন। যার কর্মসূচি হিসেবে তিনি নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের সহায়ক জনযুদ্ধের পরিপুরক কর্তব্য হিসেবে এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখল ও গ্রাম দিয়ে সহর ঘিরে পর্যায়ক্রমে শত্রুকে দুর্বল করার এক দীর্ঘস্থায়ী পথে ক্ষমতা দখলের বিপ্লবী কর্তব্যের সহজ ও সুবিন্যস্ত শিক্ষা তুলে ধরেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব বিন্যাসের নিরীক্ষে তার এই দ্বিস্তরিয় বিপ্লবী শিক্ষা বিশ্ব বিপ্লবের সাধারন শিক্ষা হিসেবে মার্কসবাদ, লেনিনবাদের ভাণ্ডারে মাওবাদ হিসেবে বিকশিত মতাদর্শগত অনিবার্যতা অর্জন করেছে। যা ছাড়া বহু ব্যর্থ বৈপ্লবিক প্রয়াস তার সত্যতাকে প্রমাণ করেছে। কিন্তু এই তত্বের বিকাশ এমনি এমনি হয়নি। পার্টির ভিতর দুই লাইনের সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতিকে আরও সহজ ও সাধারণীকরণ করার মাধ্যমে তাকে এগোতে হয়। জনগণের সচেতনতায় তিনি তথাকথিত কমিউনিস্ট রক্ষণশীল মর্যাদাকে ভেঙে পার্টির ভিতর দুইটি শ্রেণি স্বার্থের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে দেন। ষাটের দশকে সোভিয়েত ক্রশ্চেভিয় সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তার "মহা বিতর্ক" আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপ্লবী কমিউনিস্টের পথ দেখায়। তিনি দেখান এই প্রথম সংশোধনবাদীরা ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে মতাদর্শগত সংশোধনবাদের বিষয়গত আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার বিষয়ীগত শক্তি অর্জন করেছে। যা "আধুনিক সংশোধনবাদ" হিসেবে দুনিয়াজোড়া সংশোধনবাদীদের উৎসাহীত করে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব বিন্যাসের সমিকরনকে বদলে দিয়েছে। তারই ধারায় বিপ্লবকে অব্যাহত রাখতে কমঃ মাও সে তুঙ ক্ষমতাসীন চীনা পার্টিতে ক্রুশ্চেভিয় অনুচর বুর্জোয়া দখলকে ধ্বংসের জন্য জনগণের স্বার্থে সর্বহারা মতাদর্শের এযাবৎ সর্বশ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার প্রয়োগ ঘটান, বুর্জোয়া বিপথগামী নেতৃত্বাধীন তথাকথিত পার্টির বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ বিদ্রোহ ও গণ সমাবেশের দুনিয়া কাঁপান "মহান সর্বহারা সাংকৃতিক বিপ্লব"-এর মাধ্যমে। যার প্রেরণা হিসেবে তিনি বলেন "সদর দপ্তরে কামান দাগ"। আমাদের ভুললে চলবেনা জনগণের স্বার্থে তার মহান পরামর্শগুলো। তিনি একটি কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যয়কে তুলে ধরে বলেন "জনগণ ছিল, তারা আছে এবং তারা থাকবেও। শ্রেণি সংগ্রামের ময়দানে জনগণের স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টির জম্ম। তা যদি জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তবে জনগণ অবশ্যই তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। যার ধারায় তার সেই বিখ্যাত মুল্যায়ণ "মার্কসবাদ বহু সত্যের সমাহার, কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহই তার সার কথা।" তিনি প্রথম সুস্পষ্ট কথায় ব্যপক নিপীড়িত জনগণের স্বার্থে দাড়ানর বিপ্লবী দৃঢ়তাকে এযাবৎ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ব্যপকতম প্রত্যয় হিসেবে তুলে ধরেন।যারপর আর বিশ্ব জনগণের বুঝতে বাকি থাকে না ব্যাপক জনগণের স্বার্থেই সর্বহারা মতাদর্শের প্রান সরূপ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতিটিকে। এরপর গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার বিপক্ষে যাবতীয় আচার-আচরণ যা জনগণের স্বার্থের সেবা করেনা তাইই মার্কবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ বিরোধী বুর্জোয়া মতাদর্শ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাই আমরা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সঠিক সংগ্রামে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী শিক্ষাকে উর্দ্ধে তুলে ধরে বিপ্লবকে শক্তিশালী করে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সি.পি.আই., সি.পি.এম-এর সংশোধনবাদী আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কমঃ চারু মজুমদা, কমঃ কানাই চ্যাটার্জি সহ বিপ্লবী শিক্ষকেরা জনগণের স্বার্থের বিপ্লবী কেন্দ্রীকতার প্রয়োগ ঘটান। ভারতীয় বিপ্লবের মত ও পথ হিসেবে মহান নকশালবাড়ির সংগ্রাম চীনা সীমানার বাইরেও কমঃ মাও সে তুঙের শিক্ষাকে সাধারণ আন্তর্জাতিক অনিবার্যতা হিসেবে তুলে ধরে। কমঃ মাও-এর পথ ধরে কমঃ চারু মজুমদারও সংশোধনবাদ সহ জনগণের স্বার্থের প্রতিকূল ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে সমালচনা করে বলেন "জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ"। অর্থাৎ জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী পার্টি, তার নেতৃত্বের বুর্জোয়া কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে সংগ্রামই আজকের যুগের বিপ্লবী কেন্দ্রীকতার মানদণ্ড। যেহেতু তা ব্যপক জনগনের পক্ষে সেহেতু এই হলো আমাদের যুগের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার আসল মর্মবস্তু। পার্টির দখল নেওয়া বুর্জোয়া বিপথগামী আমলাতন্ত্র যতই তথাকথিত কেন্দ্রীকতার অজুহাতে তাকে কুৎসা ও কালিমালিপ্ত করুকনা কেন।


গুরুত্ব:

যখন রুশ বিপ্লবের পর চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বহারা বিশ্ব বিপ্লবের সামনে তার ধ্রুপদী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য বিপ্লবের এক অনিবার্য নতুন পথ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর পেরতেই হবে, তখন সংশোধনবাদ মার্কসবাদের ক্রমবিকাশের ধারা হিসেবে এই মাওবাদী শিক্ষাকে অস্বীকার করে বিশ্ব বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে চলেছে। বিশ্ব জনগণকে বিভ্রান্ত করার সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের দোসর হিসেবে তারা আজও সংসদ, গণতন্ত্র, সংস্কার সহ যতসব আজগুবি বিবর্তনবাদী উত্তরাধুনিকতাবাদী গালগল্পে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট। বরাবরের মতো মার্কসবাদী শিবিরের ভেতর থেকে তারা গুলিয়ে দিতে চায় রাষ্ট্রযন্ত্র সমেত সমস্ত সুবিধা জনক অবস্থানের কেন্দ্রে থাকা শোষক শ্রেণির হিংস্র বাস্তবতাকে। তার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম সহ যাবতীয় প্রয়োগ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা কি এক ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্র ছাড়া বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চলতে পারে? হাজার হাজার বছরের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা সমেত শ্রেণি শোষণের সমস্ত উপায় অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হওয়ার পর তা বজায় রেখে যে কোনো সংস্কার যে আসলে এই শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার সামিল তা বলাই বাহুল্য। তথাকথিত মার্কসবাদীদের সঙ্গে চালু ব্যবস্থার ব্যবহার ও হাজারো রকম সম্পর্ক সে কথাই প্রমাণ করে। অন্যদিকে সামান্যতম বিরুদ্ধতাকে শোষক শ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্র যন্ত্র কি নির্মমতায় ধ্বংস করে তা শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে। তাই সংশোধনবাদ সর্বদাই শোষক শ্রেণীর সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়ার উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। বর্তমানে যা সাম্রাজ্যবাদের ভেন্টিলেশন। আর এর বিপক্ষে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ শিক্ষা দিচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাসে প্রত্যেক যুগেই এক শ্রেণি আরেক শ্রেণিকে হটিয়ে হিংসাত্বক পথেই ক্ষমতা দখল করেছে। তখন তারাও নবাগত শ্রেণি হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা শাসক শ্রেণিটির বিরুদ্ধে, তার সশস্ত্র সংঘবদ্ধ রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে সক্ষম কেন্দ্র বা কর্তৃত্ব ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজয় অর্জন করতে পারেনি। যখন একটা থেকে আরেকটা শোষণ ব্যবস্থার অদলবদলে শক্তি ভারসাম্য ও গণ সমাবেশের জন্য যেটুকু দরকার তার বাইরে একটুও কর্তৃত্ব কখনোই ছাড়া হয়নি তখন সম্পূর্ণ বিপরীত সাম্যবাদী ব্যবস্থার সংগ্রাম কর্তৃত্ব বা একনায়কত্ব ছাড়া কি করে চলতে পারে? শ্রেণি সমাজ থেকে শ্রেণিহীণ সমাজে শোষণমূলক সমাজ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের এই অন্তিম লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণিটিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে, হাজার হাজার বছরের তাদের কায়েমী সংস্কৃতিকে ঝেটিয়ে বিদেয় করে নতুন সাম্যবাদী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সবল কেন্দ্রীকৃত নেতৃত্বের প্রশ্নটি তাই সবিশেয গুরুত্বপূর্ণ। তা আরও গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে, হাজার হাজার বছর ধরে শোষণ ও সুবিধার কেন্দ্র থেকে উচ্ছেদ হওয়া শক্তিগুলির হৃতক্ষমতা পুনরুদ্ধারের মরিয়া ষড়যন্ত্রকে দমন করতেও। মার্কসবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ অক্ষটিকে কেন্দ্র করেই লেনিনবাদ গড়ে উঠেছে। আর লেনিনবাদ শ্রমিক শ্রেণী আর তার নেতৃত্ব হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তি বিন্যাসের ভারসাম্যে একটি যুদ্ধনীতি সমৃদ্ধ পরিচালন সংস্থা বা কেন্দ্র হিসেবে ঘোষনা করেছে। যার প্রয়োজন অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছতে তার সংগ্রামে সমগ্র শ্রেণী ও নিপীড়িত জনগণের পরিচালক হিসেবে তার অর্জিত ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আর নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই যুগে বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের মিমাংসা ও মিত্র শ্রেণিগুলির সঙ্গে বিপ্লবী যুক্তফ্রন্ট পরিচালনার দ্বারা আরো বেশি বেশি গণ সমাবেশের পথে চুরান্ত প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে সর্বহারা একনায়কত্ব আরো বেশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। এ যুগে সর্বসংহত কেন্দ্র বা কর্তৃত্ব ছাড়া লড়াইয়ের কথা ভাবাটাও পাগলামী। আর আমরা ইতিমধ্যেই বুঝেছি শ্রেণি সংগ্রামের বৃহত্তর ক্ষেত্রে যা শ্রেণি একনায়কত্ব হিসেবে মার্কসবাদ তাইই পার্টির আভ্যন্তরীণ সংগ্রামে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার সাংগঠনিক রূপ হিসেবে লেনিনবাদ। আর বর্তমানে আধুনিক সংশোধনবাদের যুগে পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা তথাকথিত নেতৃত্বের মুখোশে আমলাতন্ত্রিক প্রতিকৃয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহই হলো জনগণ ও বিপ্লবের স্বার্থে প্রকৃত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মাওবাদি শিক্ষা। যে কোনো অজুহাতেই "মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব"-এর পর যার বিরোধীতা আসলে সংশোধনবাদ। যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে বিপ্লবের পথে এক পা`ও এগোনো যাবেনা।