শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০২৩
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৯৩৩ সালের ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বহড়ু গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত ছয়টি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি— যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয়—
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু’প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন—
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে
পাব প্রেম কান পেতে রেখে
বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছ, দেবতা আমার।
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কত দূরে আজ!
স্মারক বাগানখনি গাছ হয়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁড়া-বাসা শূন্য করে পলাতক হলো।
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছ? বুঝি ভুলে গেলে।
নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাব প্রেম কান পেতে রেখে।
দিন যায়
সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির।
ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদলা হাওয়া নয়
ক্রন্দন রঙের মতো নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার।
জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চটকা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, ষাদে, মিছে দিন যায়…
চাবি
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?
থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো।
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো—
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কিনা?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কি না?
এবার হয়েছে সন্ধ্যা
এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেল শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না— নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
শ্রাবনের মেঘ কি মন্থর!
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
কিশলয়, সবুজ পারুল
পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
চিরদিন হবে
এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেয়া কি সম্ভবে?
তুমি ভালোবেসেছিলে সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিল পরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন— নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর?
সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেল শালের জঙ্গলে
তবু নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে। সকলে বিদ্রূপভরে দ্যাখে।