লেখকের পেশা এবং আমলা লেখক
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৮
শিক্ষিত এবং মহাশিক্ষিত যে কেউ আমি পেশায় ডাক্তার শুনে চোখ কপালে তুলে বলেন, ডাক্তার হয়েও আপনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন! তারপর পিঠ চাপড়ানির ভঙ্গিতে বলেন, বাহ বাহ, ভালো বেশ ভালো!
ভাবখানা এমন যে, লেখক বা কবি শুধু লেখক-কবিই হবেন। তাদের আর কোনো পেশা থাকবে না। অথবা সাহিত্য বোধহয় কেবলমাত্র সাহিত্যের ছাত্র-শিক্ষকদের কাজ। এখন আর আগের মতো বিরক্তি প্রকাশ করি না। শুধু বলি, এই দেশে লেখালেখির উপার্জন দিয়ে কারো পক্ষে ভদ্রস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হয় না। তাই লেখক-কবিদের একটা কোনো পেশা থাকে। কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ জজ, কেউ ঠিকাদার, কেউ প্রকাশক, কেউ এনজিও-কর্মী, কেউ পুলিশ, কেউ সামরিক অফিসার, কেউ আমলা...
পেশায় আমলা লেখক-কবিদের নিয়ে আবার খোদ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেই নানারকম মানসিক জটিলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষোভ প্রকাশও দেখা যায়। এই জিনিসটা আমাকে অবাক করে। কখনো বিরক্তিও উৎপাদন করে। অন্য পেশার লোক কবি-সাহিত্যিক হতে পারলে আমলারা কেন হতে পারবেন না? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো আমলাই ছিলেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। আ কা ম জাকারিয়া ছিলেন। আবদুশ শাকুরও। সমর পাল অগ্রগণ্য ইতিহাসচর্চায়। ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম, মোস্তফা মহিউদ্দীন, শহীদুল জহির আমলা ছিলেন। এটা কি কারো মনে আছে? কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, মোহাম্মদ সাদিক তো ছাত্রজীবন থেকেই কবি। পরে আমলা হয়েছেন জীবিকানির্বাহের জন্যই। মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক আছেন। রহমান হেনরী আছেন, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর আছেন। মাসউদুল হক, জাকির জাফরানও আছেন। অনেক প্রতিশ্রুতিময় কবিত্বশক্তি নিয়ে এসেছেন ইমতিয়াজ মাহমুদ। আছেন আরো কেউ কেউ।
পুলিশে চাকরি করা রহমান শেলী আছেন। আছেন আরো কেউ কেউ। ছিলেন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। সর্বোপরি ছিলেন আবু ইসহাক। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা লিখছেন। কাজী রাফি তো সবসময় লেখার মধ্যেই থাকেন। আছেন আহমেদ আব্বাস। খোশরোজ সামাদ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা তখনই বাঁধে যখন কেউ আমলা হিসাবে ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজের গৌণ ও অক্ষম লেখা অন্যদের গেলানোর চেষ্টা করেন। পুরস্কারের জন্য লবিং করেন এবং করান। তা এই ধরনের সুযোগ তো অন্য পেশার লোকেরাও নিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই তিনি বুদ্ধিজীবীতার দাবিদার হয়ে পড়েন। বাংলা একাডেমির চাকুরেরা চাকুরিসূত্রেই কবিত্ব ও লেখকত্বের অধিকার পেয়ে যান। সেইসাথে সাহিত্যের অভিভাবকত্বও।
আমি বিষয়টাকে দেখতে চাই কেবলমাত্র সাহিত্যের মানদণ্ডে। যিনি ভালো লিখতে পারেন না, তিনি ক্ষমতার দাপট দেখিয়েও কোনোদিন লেখক পদবাচ্য হতে পারেন না। তা তিনি আমলা হন, মন্ত্রী হন বা রাষ্ট্রপতি হন। এখানে ক্ষমতার দাপটে লেখা ছাপানো যায়, বই ছাপানো যায়, সাহিত্যের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হওয়া যায়। পুরস্কারও হয়তো বাগানো যায়। কিন্তু লেখক হওয়া যায় না। কারণ লেখকত্ব বা কবিত্ব হচ্ছে জীবনভর সাধনার বিষয়। আর সাধনার ঘাটতি সাহিত্য সহ্য করে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক