লেখক, কবি এবং শিল্পীর খুচরো কথা

দেবদুলাল মুন্না

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৯

আমি বলছি না ভালো লেখক হওয়ার জন্যে ভালো চরিত্রবান হতেই হবে। শিল্পসৃষ্টি একটি টেকনিক। লেখক-শিল্পী-কবিদের নিয়ে অপবাদ কম নয়। তারা পাগলাটে, তারা নারীলোলুপ এমন অনেক কিছু। কিন্তু আপনি কোনো গ্রামারে বিচার করতে যাবেন না কোনো সম্প্রদায়কে। তবেই ভুল হবে।

 

যেমন: গ্রেগর সামসা নামের এক সেলস্ম্যান এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে একটা তেলাপোকায় পরিণত হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বেচারা তখনো ভাবছে অফিসে যাওয়ার ট্রেনটা যেন আবার মিস না হয়ে যায় (গল্প ‘রূপান্তর মেটারফরসিস); জোসেফ কে. নামের এক নিরপরাধ ব্যাংকারকে একদিন সকালে অজানা এক অপরাধের দায়ে দুজন সরকারি এজেন্ট আকস্মিক গ্রেপ্তার করে বসে। কে.র প্রতিবেশী মহিলার ঘরে তার একটা ছোটখাটো বিচার হয়ে যায়। তাকে কেউ গ্রেপ্তার করে কোথাও নিয়ে যায় না, শুধু ‘মুক্ত’ভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতি আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার আদেশ দেওয়া হয় তাকে (উপন্যাস বিচার, ট্রায়াল। এই যে কাফকা তিনি আজ বিশ্বখ্যাত। কিন্তু  কাফকা তাঁর জীবদ্দশায় লেখক হিসেবে বলতে গেলে অপরিচিত ছিলেন; লেখা প্রকাশে তাঁর ছিল বিরাট অনীহা। কাফকা তাঁর সমস্ত লেখা ম্যাক্স ব্রডকে তাঁর মৃত্যুর পরে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। কারণ তিনি খ্যাতি পছন্দ করতেন না। তার কোন কিছুর প্রতিই মোহ ছিল না। সারাদিন কাজ করতেন। রাতে অসুস্থ স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। কাফকা জীবনের বহু বছর যক্ষ্মা রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। কাফকা তাঁর জীবনে আসা নারীদের সঙ্গে অসম্ভব রকমের সৎ ছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ ও অসহায়। একই অবস্থা বাংলার জীবনানন্দ দাশের। জীবনানন্দ দাশের নোটবই থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ বেরিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘বিভাব’ জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মরণ সংখ্যায়। কয়েকটি পড়া যাক;

 

২৩. ৭. ৩১

—প্রেমে প্রেমে হয়তো আমার জীবন সুরভিত করে তুলতে পারত গেঁয়ো এক মেয়ে: ওয়াই. তা পারে, তবু কত দূরে সে এসব থেকে। হয়তো সে তা-ই, তবু সে তা নয়…আহ, কোথায় যে খোঁজ পাওয়া যাবে তার…যদি পাওয়া যেত!

 

২৪. ৭. ৩১

—হাতের ১০টা আঙুলেরি দরকার আছে : একটা কেটে গেলেই বুঝতে পারা যায়—

—আজ: অনেক নোংরা লেগে যাওয়া এক দিন : আত্মার অপমান (প্রত্যেকটা কুকুর-বেড়ালকে আজ আমি কুর্নিশ করেছি)।

—বিতাড়িত হয়েছে এক ব্যর্থ, এক বেকার, এক অসফল মানুষ : কম সফলতা দেখাও, তোষামোদ পাবে

 

১৪. ৯. ৩১

—স্ত্রী আর সন্তান গ্রহণের কারণে (এ জন্য ক্ষমাপ্রার্থী) অনুরাগ, প্রেম, এমনকি সহানুভূতি অব্দি থেকে আমার দাবি খারিজ হয়ে গেছে

—‘সাহায্য করো তোমার সহযোদ্ধাদের’ বরিশালের অধ্যাপক আর জনতার কাছে এ জন্য লজ্জিত—মায়ের ক্যাট্ ক্যাট্ খ্যাট্ খ্যাট্—কারো পৌরুষ বা আচরণের অবধারিত অবনমন আর অপমান—কারো কিছু বলার অধিকার নেই—

 

নোবেলজয়ী উইলিয়াম ফকনারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতা লিখে। ১৮৮১ সালে একটি জনপ্রিয় রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন যার নাম ছিল দ্য `হোয়াইট রোজ অভ মেমফিস`। এই বইটি লেখার সময় তিনি লিডা এস্টেলের প্রেমে মত্ত। লিডা একটু প্যারানয়েড ছিলেন। ফকনার তাকে স্যানাটোরিয়ামে দেখতে যেতেন। লিডা অসুস্থ বলেই না বুঝে ফকনারকে মারতেন। শরীরে চুরুটের চ্যাকা দিতেন। কিন্তু এসব কিছুই সহ্য করে ফকনার বইটি লেখেছেন। এবং ১৯২৯ সালেই তিনি তাঁর স্কুলজীবনের বান্ধবী লিডা এস্টেল ওল্ডহ্যাম ফ্র্যাংকলিনকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে দুই মেয়ে হয়। তার জীবনে অনেক ভক্ত নারী এসেছিলেন। কিন্তু তিনি সবসময়ই বিশ্বস্ত ছিলেন লিডার। ফকনার মোট ১৯টি উপন্যাস ও বহু ছোট গল্প লেখেন। চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ তো প্রেমিকার জন্য মানসিক ভারসাম্য হারালেন। পাগলাগারদে আঁকলেন সেরা পেইন্টিং ‘ইয়েলো গার্ডেন’। কান কাটার প্রচলিত গল্প থাক, না বলাই ভালো, কিন্তু ভ্যানগগ একবার প্যারিসের টেসস শহরে গেলেন ইন্ডাভার সঙ্গে দেখা করতে। প্রেমিকা বললেন, ‘তুমি আর্টিস্ট হয়ো না। আর্টিস্টদের জীবন গোছানো হয় না। তুমি বরং ব্যাংকে জব করো। বিশ্বাস করবেন, ভ্যানগগ এরপর সাতবছর পেইন্টিং করেননি। এবং কডওয়েল ব্যাংকে কেরাণীর চাকরি করেছেন। কিন্তু তারপর যখন তার প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখান করলো তখনই তিনি ফের পেইন্টিং এ ফিরে এলেন এবং সেরা কাজগুলো করলেন।

 

ইতালীয় লেখক যার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা জার্মিনাল’, হ্যা , আমি এমিল জোলা’র কথাই বলছি। সেই এমিল জোলা যেদিন তার বউ সুইসাইড করলেন সেদিন তিনিও করতে গেলেন। কিন্তু মারা গেলেন না ঘটনাক্রমে। পরের বছেরগুলো অবসাদে ভুগতেন।

 

আহা ডিলানটমাস, তাকে নিয়ে কতো বদনাম! ব্রথেলে যেতেন। মদ খেতেন। এসব মিথ্যা নয়। কিন্তু সত্য ছিল অন্যরুপে। কি সেটি? ডিলান টমাসের মা ছিলেন সেক্স ওয়ার্কার। তো ডিলান কিশোর বয়স থেকেই তার মা’কে খুঁজতে ব্রথেলে যেতেন। কিন্তু কারো সাথে শুতেন না।

ডিলানের আকুতি ও হাহাকার আপনারা শুনতে পান?