লুনা রাহনুমার দুটি খুদে গল্প
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৯, ২০২০
মনের ঘরে একটি পোকা
গরম ভাতের সাথে তেলা-কৈয়ের ঝোল মাখতে মাখতে প্রবাল বলল, খাসা রেঁধেছো তো আজ কইমাছ আর মটর শুঁটির তরকারিটা। সু, আরেকটু লেবু চিপে দাও আমার ভাতের উপর।
সুপ্রিয়া ভালো রাঁধুনি। দেশি-বিদেশি সব রকমের রান্না ওর হাতে দারুণ স্বাদের হয়। আর প্রবালটাও মিলেছে একটা পেটুক। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা, মৌসুমের প্রথম ফলটা, তাজা সবজির আঁটি— ব্যাগে ভরে বাড়ি নিয়ে আসে।
কাল তো শনিবার, দুপুরে তোহা ভাইয়ের ছেলের জন্মদিনের দাওয়াত আছে, গিফট কিনে ফেলো একটা আজ।
বরিস জনসন লকডাউন দুই মিটার থেকে কমিয়ে এক মিটার করেছে, ব্যস পার্টি শুরু। পুলিশ ধরলে ফাইন করবে না।
বাড়িতে তো গেদারিং করছে না, লিডিয়ার্ড পার্কে। তোহা ভাবির স্পেশাল বিরিয়ানি, বোরহানি আর কি কি যেন রান্না করে নিয়ে আসবে বলছিল। সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে বসবো আমরা, আর বাচ্চারা একটু খেলতে পারলো একসাথে।
সুপ্রিয়া ও তাদের বন্ধুরা ভীষণ ক্লোজ। প্রতি সপ্তাহে এর ওর বাড়ি দাওয়াত, চা-পান, ওয়ান ডিস্পার্টি, পিঠাপুলি, আর বাচ্চাদের জন্মদিন বা বড়োদের বিয়েবার্ষিকী তো লেগেই আছে। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে ইংল্যান্ডে লকডাউনের চতুর্থ মাস শেষ হচ্ছে প্রায়। আচমকা এই করোনাফরোনা এসে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। এখন জুম আর ফেস টাইম করে দেখা সাক্ষাৎ হয় সবার।
প্রবালের সাথে সুপ্রিয়ার সুখের সংসার। দুটিতে মতের অমিল হয় খুব কম। তাই তারা যৌথজীবনের সকল সিদ্ধান্ত দুজনে মুখোমুখি বসে আলাপ করে ঠিক করে সবসময়। ঘরের দেয়াল, মনের দেয়াল, আর শরীরের দেয়ালের রং নির্বাচন করে দুজনে একসাথে মিলিয়ে মিলিয়ে।
সকালে প্রবাল অফিসে আর বাচ্চারা স্কুলে চলে যাবার পর সুপ্রিয়া বাড়িতে একা। এটা তার একার সময়, নিজের সময়। সিডিতে শ্রীকান্তের গান হালকা ভলিউমে অন করে গরম চায়ের কাপ নিয়ে জানালার পাশে বসে সুপ্রিয়া। ভাবছে, আগামীকাল পার্কে শাড়ি পরবে নাকি জিন্স পরে যাবে। এখন যদিও জুন মাস, হিসেব অনুযায়ী সামার হবার কথা কিন্তু ব্রিটিশ আবহাওয়া, কয়েক দিন থেকেই যা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে!
তোহা ভাইদের পার্টিতে কাল শ্যামলীদিও আসবে নিশ্চয়ই। শ্যামলীদি— লম্বা, শুকনো, গায়ের রং কালো, দাঁত উঁচু, খুবই সাধারণ মুখের মানুষ। তবে খুব মিষ্টি করে কথা বলেন, কণ্ঠে যেন মধুমাখা। কিন্তু রূপের অভাবে বিশেষ করে না তাকালে তার দিকে কারুর চোখ পড়ে না। অথচ এই অসুন্দর মানুষটিকে নিয়েই সুপ্রিয়ার মতো দারুণ স্মার্ট, সুদর্শনার ভীষণ অস্বস্তি।
সিডিতে শ্রীকান্তের কণ্ঠে গান বাজছে, মেঘ কালো আঁধার কালো আর কলঙ্ক যে কালো... এই গানটিই তো বাজছিল সেদিন সুপ্রিয়ার বাড়িতে, ছেলের দ্বিতীয় জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। ঘরভর্তি মেহমান, সুপ্রিয়া ছুটছিল সবখানে, সবাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে চোখ পড়েছিল ঘরের দরোজায়, ঘরে ঢোকার মুখে ছোট্ট যে কর্নারটি আছে সেখানে বুকশেল্ফের পাশে মোড়াতে বসে আছেন শ্যামলীদি, আর প্রবাল হাঁটু গেড়ে বসে,মুখোমুখি, হাত নেড়েনেড়ে কথা বলছে। ঘরভর্তি মানুষের আড্ডার শব্দে প্রবালের কোনো কথা শুনতে পায়নি সুপ্রিয়া। কিন্তু চোখের দৃষ্টি দেখেছে।
প্রবালের চোখের সেই দৃষ্টি এখনো মনে আছে সুপ্রিয়ার। এত প্রশংসা, এত ভালোবাসা, এত আদর আহ্লাদ, এত সমঝোতা যে সুপ্রিয়ার সাথে, কই তার জন্য তো এমন আলো জ্বলতে দেখেনি কোনো দিন প্রবালের চোখে। লোডশেডিংয়ের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ধপ করে জ্বলে ওঠা একটি ম্যাচের কাঠির মতো তীব্র অথচ ভীষণ কোমল সেই আলো।
বুক জ্বলে যায় সুপ্রিয়ার। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে, আর এখনই দুই মিটার কমিয়ে এক মিটার করতে হলো তার! থাকতো কড়া লকডাউন আরো কয়েকটা মাস। ভীষণ মাথামোটা হ্যান্ডসাম বরিস জনসন।
মডেল
শিল্পীকে যে ভালোবাসে, সে নিজেও একরকম শিল্পী— তমালের মুখে কথাটা শুনে মন ভরে যায় কণার। যদিও সে কথাটির অর্থ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। কণ্ঠে আহ্লাদ মাখিয়ে বলে, বুঝিনি, বুঝিয়ে বলো।
তমাল তার আঁকিয়ে হাতের আঙুলে ঢেউ তুলে শব্দের মালা গাঁথে, আমার তো সেই একটাই মাত্র চাওয়া তোমার কাছে, সোনা। কেন রাজি হচ্ছে না? একটা পোর্ট্রেট, আর তো কিছু চাইনি।
দুই বছরের প্রেম কণার সঙ্গে তমালের। প্রতিদিন একবার দেখা করা চাই যে করেই হোক। তমাল ছবি আঁকে। ক্যানভাসে রঙের খেলায় নেশা ধরে গেছে ওর। বিচিত্র ছবিতে ঠাসা মনের দেয়াল। এখন শুধু বাকি আছে একটি নগ্ন নারী পোর্ট্রেট আঁকা। তমাল চায় এই পোর্ট্রেটটি সে আঁকবে তার ভালোবাসার মানুষের সত্যিকার শরীর দেখে। তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলবে চামড়ার নিচের রক্তধারাকে পর্যন্ত।
বিশ্বাস করো কণা, তোমার শরীরের প্রতি আমার কোনো লোভ হয় না। শুধু একটি পোর্ট্রেট আঁকব তোমায় দেখে দেখে।
রোজ রোজ তমালের এই ভিক্ষুকের মতো প্রার্থনা কণার ভেতর কোথায় গিয়ে যে আঘাত করে, তা সে বলে বোঝাতে পারবে না। জীবনের সব গল্পই বলা হয়েছে যে প্রাণের মানুষটিকে, তার কাছেও কি সত্যি সব বলা যায় খুলে?
অনেক ভেবে কণা রাজি হয়। আবক্ষ নগ্ন ছবির মডেল হবে সে।
পরদিন সকালে কণা উপস্থিত হলো তমালের ফ্লাটে। ক্যানভাস, ইজেল, রং, তুলি আর মনের ভেতর দারুণ উত্তেজনায় প্রস্তুত তমাল। স্বপ্নের ছবিটি আঁকা হবে আজ। সেট করে রাখা চেয়ারে নিয়ে বসায় তমাল কণাকে। উর্ধাঙ্গ ঢেকে রাখা চাঁদরটি ফেলে দিতেই আঁতকে ওঠে তমাল। ডান দিকের স্তনের জায়গাটি সমান, চামড়ার সেলাই সামান্য কুঁচকে আছে।
ক্ষমা প্রার্থনার কণ্ঠে কণা বলে, অনেক দিন চেষ্টা করেও তোমাকে বলতে পারিনি, জানো। কয়েক বছর আগে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণে এটাকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।