লুনা রাহনুমার গল্প ‘সুখের গন্ধ’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২০
মানুষ তার কোনো নেশাই ছাড়তে পারে না সারা জীবনে। নেশা বস্তুটির পরিবর্তন হয় শুধু। এই যেমন ধরুন যার মদ্যপানের নেশা, সে রাতারাতি মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে পারে না। সে হয়তো মদের বদলে সিগারেট খাওয়া শুরু করে। কিংবা কারো সিগারেট খাবার নেশা সে সিগারেটের নেশা ছাড়তে পান খাওয়া ধরলো। কিংবা পান ছাড়তে শুধু সুপারি বা কালি জিরা চিবানোর অভ্যাস করল। আবার যেমন বাল্যকালে কেউ সারাদিন গল্পের বই পড়তো, তার এই বই পড়ার নেশা বাড়তি বয়েসে গিয়ে ঠেকলো আইনের বইয়ের পাতায়। সারাদিন আইন-বই ঘেটে ভাবতে থাকে, প্রতিবেশীকে আর কিভাবে জব্দ করা যায়। মোদ্দা কথা, নেশার অবলম্বন একটি ছেড়ে আরেকটিকে আঁকড়ে ধরা।
জালাল মিয়ার নেশা ছিল টাকা গোনা। ছোটবেলা থেকে টাকা হাতে পেলেই শুঁকে দেখতো। নাকের সাথে মিলিয়ে গন্ধ নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে ফেলতো হুমম শব্দ করে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করতো টাকা চাবিয়ে খেয়ে ফেলতে। নতুন টাকা যখন ব্যাঙ্ক থেকে প্রথম হাতে আসে টাকাগুলো কেমন পিচ্ছিল থাকে, খুব ধার থাকে টাকার গায়ে, গন্ধটাও কি দারুণ সতেজ। আবার নতুন টাকাগুলো যখন মানুষের হাতে হাতে ঘুরে ঘাম, থুতু, খাবারের রং-সুবাস অথবা রোদবৃষ্টি গায়ে লাগিয়ে, একশো হাতের নোংরা ময়লা গায়ে মেখে, কিংবা অনেক হাত পরিভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে শরীরটা নরম হয়ে যেত তখন অন্য রকম আরেকটি গন্ধ পেত— সেটিও মাতাল করে দিতো জালালকে। জালালের কাছে নতুন বা পুরাতন সব টাকার গন্ধই ছিল দামি, যে কোনো পারফিউমের চেয়ে প্রিয়।
জালালের মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার মরে যাওয়ার কথা। বাবার মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে বাবার বন্ধুর সাথে গোপন প্রেমের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় জালালের মা। কথিত আছে, এই প্রেমের জন্যই নাকি জালালের মা কলার ভেতর বিষ মিশিয়ে খুন করেছিল তার স্বামীকে। মায়ের নতুন স্বামী জালাল আর তার ছোটভাইয়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে শুধু আকলিমা বিবিকে নিয়ে চলে গেল দূরের গ্রামে।
কারো মা যদি মরে যায়, অন্য মায়েরা তখন মাতৃহারা ছেলেদের মায়ায় বুকে টেনে নেয়। কিন্তু কারো মা যদি বিয়ে করে নাবালক সন্তান ফেলে চলে যায় নিজের সংসার সাজাতে, সেই মাকে সবাই খুব ঘৃণা করে। এত তীব্র সেই ঘৃণা যে, মাসহ তার অবুঝ বাচ্চাগুলো পুরো পৃথিবীতেই অপাংতেয় হয়ে যায়।
জালাল মেধাবী ছাত্র ছিল। দিনে স্কুল করে সন্ধ্যায় নিচের ক্লাসের বাচ্চাদের বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়াতো। মেট্রিক পাশের পর গ্রাম ছেড়ে শহরে কলেজে ভর্তি হলো। কলেজের পাশের পর এক মধ্যবিত্ত বাড়িতে থাকা খাবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। তাদের বাচ্চাদের লজিং স্যার। ছোট ভাইটি গ্রামেই থাকলো। বাবার ভিটে আর চারপাশে চাচা ফুপুরা সবাই রইলো মাথার উপর।
জালালের চাচা মনে মনে ঘৃণা করতো নিজের দুই ভাইপোকে। সামনে পেলেই গালি দিতো, সারাটা দিন আমার চোখের সামনে ঘুরিস কেন? আমি কি তোদের বাপ্লাগি?
মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সরে যায় দুই ভাই। বাবা ও মা এই দুটিই যাদের নেই, তাদের কোনো অপমানই আর গায়ে লাগে না। অনেক দুর্ব্যবহারেও ছেলে দুটি চাচার দিকে তাকিয়ে থাকে আড়াল থেকে। তাদের বাবা বেঁচে থাকলে দেখতে তো এমনই লাগতো। বিকেলে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে জালাল বলেছিল, চাচাজি, আমি কলেজে ভর্তি হবো। কলেজ পাশ করলে সবাই ভালো চাকরি পায়।
চাচা কপাল কুঁচকে তাকায় জালালের দিকে। কষ্ট করে গিলে ফেললো কুৎসিত আরেকটি গালি। এদের দেখলেই কেমন খিচড়ে যায় মেজাজ। জজ বেরিস্টার হবি? তোর মাতো ভাগছে দুই পোলারে আমার কান্ধে দিয়া। এখন তুইও যা, আমি তো আছিই। তোর ভাই আমার জুতা টানবো।
জালাল চাচার পায়ে সালাম করে গ্রামের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় শহরে। পিছন থেকে শুনতে পায় চাচাজির কণ্ঠ, বড় চাকরি করে উনি টাকা রোজগার করবেন। টাকা গাছে ধরে? আমি পয়সা খেয়ে পায়খানা করবো আর তোরা দুই ভাই আমার পায়খানা ঘেটে পয়সা তুলবি। বলে রাখলাম, দেখিস তোরা।
মেধা আর বুদ্ধির সাথে তীব্র জেদ মিশে জালালের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল দশ বছরের মধ্যে। ঢাকা শহরে নিজের একটি থাকবার মতো বাড়ি, একটি ভালো চাকরি, সংসারে সুখসাচ্ছন্দ, এলাকায় সৎ-মানুষ হিসেবে সুনাম সুখ্যাতি মিলেছে। কিন্তু শৈশবের সেই মাতাল করা টাকার নেশা মনের ভেতর চনমন করে জেগে ওঠে যখন তখন। খেতে বসে গরম ভাতের থালায় উথলে ওঠা সাদা কুয়াশার মতো সুঘ্রাণ মিশে যায় এক বান্ডিল টাকার গন্ধে।
দাম্ভিক চাচাজির বয়স বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল শরীরে অসুস্থতা। মৃত্যুর আগেপর্যন্ত তিনি বছর দুই বিছানায় পড়েছিলেন। চিঠি লিখে, ফোন করে জালালের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। পিতাসম চাচার চিকিৎসার সব খরচ জালাল একা বহন করেছে। আয়ার বেতন, ডাক্তারের ফি, রান্না করা আর মুখে তুলে খাওয়ানোর লোক খরচা সব দিয়েছে। আর মুমূর্ষু চাচা যেন পেশাব পায়খানায় বেশিক্ষণ পড়ে থেকে কষ্ট না পান, তার জন্য কড়া নির্দেশ দেয়া ছিল কাজের লোকদের।
বিনিময়ে জালাল শুধু চাচার থাকার বাড়িটি আর ত্রিশ বিঘা ধানি জমি নিজের নামে টিপ্সই করে নিয়েছিল। কারণ, জাদরেল চাচার তখন কলম ধরে সাক্ষর করার ক্ষমতা ছিল না। কারণ, চাচার ছেলেমেয়েরা ভাবেনি যে, জালাল আপন চাচার স্থাবর সব সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। কারণ, জালাল অনেক আগেই হিসেবে কষেছিল, চাচাজির সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে— অনেক পয়সা!
বিস্তীর্ণ গ্রামের মেঠো পথের আলে হেঁটে চলে জালাল মিয়া। চোখের চশমার কাচ ঘোলা হয়ে যায় বুকের ভালোবাসার উৎসরণে। এই তো সেই গ্রাম, এই সেই মাটি, মাটির কাদামাখা পথ। ঝাপসা চোখে জালাল দেখে দূরে একটি সাত কিবা আট বছরের ছেলে মাথায় সবজি নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে। সেগুলো বিক্রি করে চাল কিনে বাড়ি ফিরতে হবে যত জলদি সম্ভব।
চোখ বন্ধ করেও জালাল জানে বালকের ওড়ার মধ্যে কি কি সবজি আছে— কয়েকটি মিষ্টি কুমড়ার ডগা, দুটি ছোট্ট কুমড়া, কিছু পুঁইশাক আর পুকুর পাড় থেকে তুলে আনা মালঞ্চ শাক। চোখ ভিজে যায় জালালের, মা কত আশা করে বসে আছে তার অপেক্ষায়। সবজিগুলো বিক্রি করে যদি এককেজি চাল কিনতে পারে তবেই আজ ভাত খাবে তারা চারজন।
কোটি টাকার গন্ধ ছাপিয়ে জালালের নাকে লাগে খড়ির আগুনে রান্না হওয়া সেই ভাতের বলকের গন্ধ। গরম ভাতের গন্ধ ছাপিয়ে উঠে আসে মায়ের গায়ের ঘামের গন্ধ। মায়ের গা ঘেঁষে, বুকের ভেতর লেপ্টেসেপ্টে আকুলি-বিকুলি স্নেহের উষ্ণতায় পরিপূর্ণ সুখের গন্ধ।