লাল জুতো শাদা মোজা

চিত্রনাট্য

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮

দৃশ্য : ১.
সকাল। রাস্তা।
সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে।

দৃশ্য : ২.
সকাল। ডাস্টবিন।
সবুজ।
এক দঙ্গল কাক জটলা করছে ডাস্টবিনে। তার ভেতর বস্তা কাঁধে সবুজ কাগজ-ঠোঙা টোকাচ্ছে। হঠাৎই সে পেয়ে যায় একজোড়া পুরনো আর ছেঁড়া লাল জুতো। হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। কাঁধের বস্তা পাশে নামিয়ে রেখে জুতোর ভেতর-বাইরে হাতিয়ে সে দেখতে থাকে। জুতোর ভেতর থেকে বের করে আনে ছেঁড়া শাদা মোজা। মোজা আর জুতো পায়ে পরে সবুজ। এরপর বস্তা কাঁধে তুলে নিয়ে নায়কের ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায়।

দৃশ্য : ৩.
সকাল। শাহানার বাড়ির গেট।
সবুজ, শাহানা, শাহানার বাচ্চা ও ড্রাইভার।
হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সবুজ। দেখতে পায়, শাহানা তার বাচ্চার হাত ধরে গেটের কাছে রাখা প্রাইভেটের দিকে হেঁটে আসছে। বাচ্চার পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম এবং কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। পায়ে লাল জুতো শাদা মোজা। চকচকে চোখে বাচ্চাটার পায়ের দিকে চেয়ে থাকে সবুজ। তারপর তাকায় তার নিজের পায়ের দিকে।
শাহানা বাচ্চাসহ গাড়ির কাছে এলে দরজা খুলে দেয় ড্রাইভার। উঠে বসে তারা। ড্রাইভার গিয়ে নিজের সিটে বসে গাড়িটা স্টার্ট দেয়। ধোঁয়া ছেড়ে চলে যায় গাড়ি।

দৃশ্য : ৪.
রাত। সবুজের বস্তিঘর।
সবুজ ও তার মা।
সবুজ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কী যেন এক গভীর চিন্তার ছাপ ওর চোখ-মুখে। ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে মা।
সবুজ : ঘুমায় গেলি মা।
    কথা বলে না মা।
সবুজ : কতা কস না, ও মা।
মা : কী অইছে।
সবুজ : আমারে লাল জুইতা কিইনা দিবি মা? আমার হাউস অইছে লাল জুইতা পিন্দনের, দিবি মা?
    কথা বলে না মা। পাশ ফিরে মায়ের কাঁধে ধাক্কা দেয় এবার সবুজ।
সবুজ : কথা কস না ক্যান, দিবি না?
    সবুজের দিকে পাশ ফিরে শোয় মা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মায়ের আরেকটু কাছে ঘেঁষে যায় সবুজ।
সবুজ : লাল জুইতা আর শাদা মুইজা পিইন্দা আমি ইসকুইলে যামু সক্কাল  অইলেই। হাউস অইছে আমার, দিবি মা কিইনা?
    সবুজের মাথায় হাত বোলায় মা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মা : ঘুম যাও তো বাজান হাউসের কতা বাদ থুইয়া।
সবুজ : দিবি না তাইলে?
মা : ক্যামনে দিমু, বোজস না তুই?
সবুজ : আইচ্ছা মা, আমগোর টেকা-পয়সা নাই ক্যান?
মা : আমরা যে গরিব।
সবুজ : গরিব ক্যান?
    মায়ের মেজাজ এবার একটু তেতে ওঠে।
মা : ঘুমো তো ছ্যাড়া, পাকনা কতা আর ভাল্লাগে না।
পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে মা। সবুজ চিৎ হয়ে শুয়ে চেয়ে থাকে ওপরে। মুখে গভীর ভাবনার ছাপ। একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

দৃশ্য: ৫.
সকাল। শাহানার বাড়ির গেট।
সবুজ ও দারোয়ান।
শাহানাদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে বস্তা নিয়ে ভেতরে উঁকিঝুকি মারছে সবুজ। পায়ে সেই ছেঁড়া লাল জুতো আর শাদা মোজা। ভেতর থেকে তেড়ে আসে দারোয়ান।
দারোয়ান : ওই পিচ্চি ওই, মতলব কী। ফোট, যা যা।
সবুজ : আইচ্ছা, এই বাড়ির পুলাডা ইসকুলে চইলা গেছে?
দারোয়ান : তারে দিয়া তোর কি? যা, ভাগ ব্যাটা।
    মন খারাপ করে সবুজ চলে যায়।

দৃশ্য : ৬.
দিন। জুতোর দোকানের সামনে।
সবুজ ও জুতোর দোকানের কর্মচারী।
জুতোর দোকানে শোকেসের সামনে বস্তা কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ। জুতো দেখছে। হঠাৎই চোখ পড়ে শোকেসে সাজানো লাল এক জোড়া জুতোর ওপর। শোকেসের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে চকচকে চোখে জুতোটার দিকে চেয়ে থাকে সে। দোকানের একজন কর্মচারীর চোখ পড়ে তার দিকে। কর্মচারী এগিয়ে আসে।
কর্মচারী : কীরে ব্যাটা, যাহ।
    কথা বলে না সবুজ। কর্মচারীর মুখের দিকে একবার চেয়ে আবার জুতো দেখতে থাকে।
কর্মচারী : ওই পিচ্চি, সইরা দাঁড়া দরজা থেইকা।
সবুজ : ও ভাই, ওই যে লাল জুইতাডার কত দাম?
কর্মচারী : তোরে বেচলেও হবে না, বুজলি? এখন রাস্তা মাপ।
    অসহায় চোখে কর্মচারীর মুখের দিকে চেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলে যায় সবুজ।

দৃশ্য : ৭.
দিন। শাহানার বাড়ির গেট।
সবুজ ও সবুজের মা।
সবুজের মা সবুজের হাত ধরে গেটের কাছে রাখা প্রাইভেটের দিকে হেঁটে আসছে। সবুজের পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম এবং কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। পায়ে লাল জুতো শাদা মোজা। সবুজের মা সবুজসহ গাড়ির কাছে এলে দরজা খুলে দেয় ড্রাইভার। উঠে বসে তারা। ড্রাইভার গিয়ে নিজের সিটে বসে গাড়িটা স্টার্ট দেয়। ধোঁয়া ছেড়ে চলে যায় গাড়ি।
কাট টু

দৃশ্য : ৮.
রাত। সবুজের বস্তিঘর।
সবুজ ও সবুজের মা।
    ঘুম ভেঙে উঠে বসে সবুজ। তাকায় মায়ের মুখের দিকে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

দৃশ্য : ৯.
সকাল। শাহানার বাড়ির গেট।
সবুজ।
    লাল জুতো শাদা মোজা পায়ে গেটের কাছে ঘুরঘুর করছে সবুজ। আজ তার কাঁধে বস্তা নেই।

দৃশ্য : ১০.
দুপুর। সবুজের বস্তিঘর।
সবুজ ও তার মা।
    বিছনায় চুপচাপ শুয়ে আছে সবুজ। ঢোকে মা। মায়ের হাতে পুটলিতে বাঁধা খাবার।
মা : কী রে, কামে গেলি না আইজ।
    কথা বলে না সবুজ।
মা : কী হলো, কতা কস না ক্যান?
    কথা বলে না সবুজ। মা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে তার কপালে হাত রাখে।
মা : কী অইছে, শইল খারাপ?
সবুজ : আমি আর কাগজ টুকাইতে যামু না। টুকানের কাম করে ছুডোলোকে। আমি ছুডোলোক না।
মা : (মুখ ভেংচি কেটে) তয় আফনে কি, লাটসাবের বেটা?
    সবুজ কথা বলে না। পাশ ফিরে শোয়।
মা : (পুটলা খুলে খাবার বের করতে করতে) অহন লাটসাবের বেটা উটেন, কয়ডা খায়া লন।
   সবুজ চুপচাপ উঠে বসে খাবারের প্লেট টেনে নেয়।

দৃশ্য : ১০.
দিন। ফুটপাথ।
সবুজ ও তিন টোকাই।
লাল জুতো শাদা মোজা পরে একটু ভাব নিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসছে সবুজ। দেখা হয়ে যায় তিন টোকাইয়ের সঙ্গে।
প্রথম : আরে কই যাস সবুইজ্যা, কামে যাবি না?
সবুজ : (দাঁড়িয়ে পড়ে) ছুডোলোকের কাম আমি আর করুম না।
দ্বিতীয় : তাইলে কি করবি?
তৃতীয় : আরে দ্যাহোস না ক্যামন গেলেজ দিতাছে আমগোর সবুইজ্যার। সিনমার শাকিব খান অইব হেয়, তাই নারে সবুইজ্যা?
দ্বিতীয় : সবুইজ্যা দেহি লাল জুইতা পিনছে। ইপডিসি যাইতাছস নাহি সবুইজ্যা ছুডোলোকি কাম ফ্যালায়া থুইয়া?
    সবুজ কথা বলে না। চুপচাপ হেঁটে চলে যায়।

দৃশ্য : ১১.
রাত। শাহানার বাড়ির গেট ও বারান্দা।
সবুজ, দারোয়ান, বাড়ির লোকজন ও কুকুর।
    গেট বেয়ে ওপরে ওঠার নানা রকমের কসরত করছে সবুজ।  
    কাট টু
    বারান্দা দিয়ে খুব সাবধানে চারপাশে চোখ রেখে চোরের মতো হেঁটে যাচ্ছে সবুজ আর কী যেন খুঁজছে। হঠাৎ চোখ পড়ে সামনের একটা দরজার কাছে রাখা জুতোর র‌্যাকের ওপর। সেখানে শাহানার বাচ্চাটার লাল জুতো জোড়া রাখা। ধীর পায়ে র‌্যাকের কাছে গিয়ে জুতো তুলে নিয়ে ফিরে যেতে থাকে সবুজ। ঠিক সেই মুহূর্তে ভয়ংকর রকমে কুকুরের গর্জন শোনা যায়। চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখতে পায়, বারান্দার কোণায় তাগড়া দেখতে এক বিদেশি কুকুর তার দিকে গর্জন করতে করতে ছুটে আসতে চাইছে। কুকুরটা শেকল দিয়ে বাঁধা। মুহূর্তে জুতো জোড়া বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে সবুজ ছুট লাগায়।
    কাট টু
    গেট বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য নানা রকমের কসরত করছে সবুজ। কিন্তু উঠতে পারছে না হাতে জুতো থাকার কারণে। কুকুর ডেকেই যাচ্ছে। বাড়ির লোকজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।
লোকজন : কে... কে... কে...
মহিলা : আরে পুলিশে কল দাও দাঁড়িয়ে না থেকে।
    দারোয়ান ছুটে আসছে চিৎকার করতে করতে।
দারোয়ান : ধর... ধর... চোর... চোর...
    মরিয়া হয়ে ওঠে সবুজ। একহাত দিয়ে জুতো বুকের কাছে আগলে রেখে আরেক হাত দিয়ে কলাসিপল গেটের তালা টানাটানি করতে থাকে। এরপর গেট ধরে ঝাঁকাতে থাকে। পেছনে তাকাতে থাকে বারবার। ফ্রেম আউট হতে থাকে আস্তে-ধীরে। গেটের শব্দ, কুকুরের গর্জন, দারোয়ানের চিৎকার এবং বাড়ির লোকজনের চিৎকার দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে।