লতিফ জোয়ার্দারের গল্প ‘কবি’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০২০
দুপুরের খাবার খেতে বসেছি। এমন সময় বউ এসে বললো, খাবার খেতে বসে এমন তাড়াহুড়া করতে নেই।
অথচ আমি দ্রুত হাত চালালেও মুখ চালাতে পারি না। আজ আমি অজানা এক অস্থিরতায় ভুগছি। হঠাৎই ভাতের থালায় পানি ঢেলে উঠে দাঁড়ায়। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আবার আমাকে তৈরি হতে হবে।
আলনার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি, আজ কোন পোষাকে আমাকে মানাবে ভালো। কিছু সময়ের মধ্যে একটার পর একটা শার্ট চেঞ্জ করতে করি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, কোন শার্টে আজ আমাকে মানাবে ভালো।
সেই ছোটবেলা থেকেই পোষাক সচেতন আমি। কোন শার্ট পড়লে আমাকে বেশি স্মার্ট মনে হবে। কোন প্যান্টে আরো বেশি আর্কষণীয় হয়ে উঠবো আমি। এ সকল বিষয় আশয়ের সাথে আমি সকল সময়ই ছিলাম। তবে আজ আমার হৃদয়ে একটা লাল শার্টের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে। অথচ লাল অথবা কাছাকাছি রঙেরও কোনো একটি শার্টও আমার নেই।
জিন্সের সাথে মানান সই একটা হলুদ রঙের শার্টের উপর ধূসর জ্যাকেট পরে যখন বউয়ের সামনে এসে দাঁড়াই, সে খুটিয়ে খুটিয়ে আমাকে দেখতে থাকে। জিগেশ করে, ব্যাপার খানা কী বলো তো দ্বীপ। কি হয়েছে আজ তোমার? কোথায় যাচ্ছ আজ তুমি? এক নিশ্বাসে এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। তবে তাকে আমি প্রতিবারই বুঝাতে সক্ষম হই। আমি কোনো বাজে কাজে, বাজে আড্ডায় যাই না কখনও। মাঝে মাঝে এই ভেবে আমি আনন্দিত হই যে, সে আমাকে কখনও ভুল বুঝে না। তার মধ্যে কখনও কোনো নেগেটিভ চিন্তা নেই আমাকে নিয়ে। অনেকেই তাকে বোকা মনে করে। সে কারণে বারবার বেঁচে যাই আমি। তাকে বোঝাতে সক্ষম হই, আজ আমি ঈশ্বরদীতে যাচ্ছি, আমার এক বিদেশি বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য।
যেদিনই তার সাথে আমি এমন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছি, যেদিনই তাকে আমি ফাঁকি দেবার চিন্তা করেছি, সে দিনটা আমার কিছুতেই ভালো যায়নি। কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারিনি আমি। প্রতিনিয়ত আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয়েছে আমাকে। আমার বারবার মনে হয়েছে, তাকে নয় আমি আমাকেই ফাঁকি দিচ্ছি যেন।
আমাদের বাড়ির সামনের মাটির রাস্তাটা ইদানীং পাকা হয়েছে। এখন মাটিতে পা ছোঁয়ানোর কোনো জায়গা নেই আমাদের। বাড়ি থেকে সামান্য কিছুটা দূরে পাবনা-রাজশাহী-কুষ্টিয়া মহাসড়ক। একদিন যে রাস্তায় বসে আমরা বাঘ-বোরকি খেলতাম। সেই রাস্তায় এখন এপাড় থেকে ওপাড় যেতে বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ট্রেনের মতো যেন একটা গাড়ির সাথে আর একটা লেগে আছে। কোনোমতো রাস্তাটা পার হয়ে ওপারে দাঁড়াতেই একটা ঈশ্বরদীগামী সিএনজি চালিত অটোরিক্সা পেয়ে যাই। আমার পাশে আর একজন মাত্র যাত্রী। বোরকায় মুখ ঢেকে রেখেছে সে। আর এমন অবস্থায় কাউকে চেনা যায় না।
সিটে বসার কিছু সময়ের মধ্যে তার আর আমার মাঝে একটা ব্যাগ দিয়ে দুরত্ব সৃষ্টি করে সে। সে কারণে তার দিকে তাকানোর আমার কোনোই আগ্রহ নেই আর। শেখপাড়া পার হয়েছি মাত্র, তখনই একটা হিজড়া টাইপ কণ্ঠ ভেসে এলো।
দ্বীপ, তুমি আমাকে চিনতে পারোনি?
এইভাবে বোরকায় মুখ ঢাকা থাকলে কেউ কখনও কাউকে চিনতে পারে? আর বোরকা পরে থাকলেও আপনার কণ্ঠ শুনে আমি এখনও কনফিইজ্ড, আপনি পুরষ না মহিলা?
এবার এক ভয়ংকর হাসি আমার কানে এলো। জানো দ্বীপ, এখন তোমার মতো আমার কণ্ঠ শুনে অনেকেই কনফিউজ্ড হয়। আমাকে বুঝতে পারে না। আমাকে নির্ণয় করতে পারে না। আমাকে হিজড়া ভাবে। আমি হাবিবা গো, তুমি আমি একসাথে একক্লাসে পড়েছি পাঁচ বছর। একদিন তুমি আমাকে কতটা পছন্দ করতে, আমি জানি।
হ্যাপি তুমি?
হাবিবার আরেক নাম হ্যাপি। সত্যি সত্যিই একদিন আমি তাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু সেই পছন্দের কথা কেন কী কারণে বলা হয়ে ওঠেনি কোনেদিন তাকে এখন আর মনে পড়ে না। আমার কেন কী এমন কারণ ছিল তাকে বলতে না পারার। তবে তখনই হ্যাপি আমার চেয়ে বেশ লম্বা ছিল। শ্যামলা রঙের মেয়েটার প্রেমে তখন অনেকেই পড়েছিল। কত মিষ্টি করে কথা বলতো ও। সেই হ্যাপির একি অবস্থা!
দ্বীপ, তুমি মনে হয় আমাকে নিয়ে খুব ভাবছো। আমার কণ্ঠ এমন ছিল না! তা তুমি ভালোই জানো। হঠাৎ একবার অনেকদিন ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছিলাম আমি। বেশ কিছুদিন তো কথাই বলতে পারিনি। যখন আবার কথা বলতে শুরু করেছি, তখন থেকেই আমার এই অবস্থা।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আমরা ঈশ্বরদী শহরে প্রবেশ করবো। আলহাজ্ব মোড় পেরিয়ে এসেছি তখন। রেলগেটে এসে হ্যাপি নেমে গেল। অথচ যাওয়ার চলে সময় আমার সাথে একটি কথাও বললো না হ্যাপি। আমি কিছু সময় ধরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার গন্তব্য ঈশ্বরদী রেল জংশন। না, কোথাও যাব না আমি। যশোর থেকে লোকাল ট্রেনে একজন কবি আসছেন বলে, আমার এত তাড়াহুড়ো করে এখানে আসা। এই ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে আরো অনেকের মতো আজ দাঁড়িয়ে আছি আমি। আজ কারো হাতে কারো প্রিজনের জন্য কোনো একটি গোলাপ ছিল না। অথচ একজন কবির জন্য বেশ কিছু ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
এর আগে তার সাথে আমার দেখা হয়নি কখনও কোনোদিন! একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কখন যে বিকেল গড়িয়ে গেছে। ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে এর আগে কারো জন্য এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিনি কখনও আমি। একটি করে ট্রেন আসছে আর আমার উৎকণ্ঠা বাড়ছে। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হচ্ছে তার সাথে আমার। পাকশী থেকে ঈশ্বরদীর পথে না হলেও দশবার কথা হলো তার সাথে। কবি জানে না আর কত দূর ঈশ্বরদী। চেয়ে দেখছি অল্প সময়ের মধ্যে মধ্যে ৩ নং প্লাটফর্মে ছুটোছুটি করছে কিছু মানুষ। হয়তো আমার নিদিষ্ট লোকাল ট্রেন এসে পড়েছে। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর পর, পুরো ট্রেনটাকে দেখে আমার একজন লালটুপিওলা কবি মনে হলো। মনে হলো কুয়াশার চাদর পরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
একেবারে সামনের বগি থেকে একজন কবি নেমে এলো। আমি মধ্য প্লাটফর্ম থেকে লোকালয় ঠেলে ছুটে যাচ্ছি একজন কবির দিকে। কবিকে চিনতে আমার কোনোই কষ্ট হয়নি। শীতে জুবুথুবু হয়ে কোটপরা একটা পেঙ্গুইন পাখির মতো মনে হলো তাকে। তার হাতে ফুল তুলে দিতে গিয়ে মনে হলো, একটুও অপ্রস্তুত হয়নি সে। সে হয়তো ভেবেই নিয়েছিল, একজন কবির জন্য আরেক কবি এভাবেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে। ঈশ্বরদী ঐতিহ্যের সাথে কবি ও কবিতার হয়তো কোনো মিল ছিল না। কবি এলে ঈশ্বরদী শহর হেসে ওঠে। আমরা ওভারব্রীজ, ট্রেনের হুইসিল, সিঁড়ি পর সিঁড়ি পেরিয়ে চলে এলাম সিএনজি অটো স্ট্যান্ডে। সেখানে ঈশ্বরদীর আরেক কবি অপেক্ষা করছে তখন। আমাদের কাঙ্ক্ষিত কবি তখন বড় ক্লান্ত, বড় ক্ষুধার্থ।
আমরা তখন একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। সেখানে গরম রুটি তৈরি হচ্ছিল। আমাদের কবি চা আর সিগারেট ছাড়া কিছুই খেলেন না। আমাদের কবি এখান আবার থেকে পাবনা যাবেন, আরেক কবি নিকটে। এভাবেই আর কিছুক্ষণ পর, তাকে বিদায় দিয়ে আবার ফিরে আসবো আমি। কিন্তু কবি আমাকে ছাড়লেন না। ইচ্ছে না থাকলেও তাকে সঙ্গ দেবার জন্য তার সঙ্গী হতে হলো আমাকে। আমার পাশে তখন একজন সুন্দরী কবি। সিগারেটের সাথে সাথে আমাদের গল্প চলছে বেশ জমিয়ে। পাবনা পৌঁছানোর পরও সে আমাকে ছাড়লো না। সামন্য একটু ফ্রেস হয়ে রাত্রি আটটার পরে, আমরা পাবনা শহরে অপেক্ষমাণ কবিদের কাছে গেলাম। প্যারাডাইসে আমাদের আড্ডা আর মিষ্টি উৎসব চলছে তখন। অতঃপর আমি কবিকে নিয়ে তার বিশেষ ব্যান্ডের সিগারেটের খোঁজে বের হলাম।
রাস্তায় কবির সাথে তার এক সাংবাদিক বন্ধুর দেখা হলো। হঠাৎই তারা আমাকে রেখে কোথায় যে চলে গেল। আর খুঁজে পেলাম না তাদের। অনেকটা ক্লান্ত হয়ে রাত্রি দশটার পরে বাড়ি ফিরে এলাম আমি। এরপর থেকে কবি আমাকে প্রতিদিন ফোন দিতো। কিন্তু আর তার ফোন কখনও কোনোদিন ধরা হয়নি আমার। কারণ, যে কবির জন্য আমি ফুল নিয়ে অপেক্ষায় থাকি, সে আমার নয়! অন্য কারো জন্য এসেছে এই শহরে।