লতিফ জোয়ার্দার: প্রান্তিক জীবনের শিল্পী
সোলায়মান সুমনপ্রকাশিত : মে ১২, ২০২২
প্রান্তিক জীবনকে অনুভব করতে হলে সেই জীবনের কাছাকাছি থাকা জরুরি। একজন সৎ লেখক ব্রাত্যজনের হৃদয়ের উষ্ণতাকে অনুভব করেন, তারপর সে জীবনকে চিত্রিত করেন শৈল্পিক বয়ানে। যারা দূর থেকে দেখে সাহিত্য দিয়ে জীবনকে স্পর্শ করতে চান তাদের সেই নির্মাণ হয় মেকি, জীবন থেকে বহুদূরের। লতিফ জোয়ার্দার সেই শ্রেণির লেখক যারা প্রান্তিক মানুষের মাঝে বসবাস করে তাদের সুখ-দুঃখকে বিশ্বস্ততার সাথে নির্মাণ করেন। মিডিয়ার এই ফেরেকবাজির কালে তিনি আমার দেখা একজন সৎ লেখক। তিনি সস্তা বাণিজ্যিক চকমকে, ঝকঝকে, প্রচার সর্বস্ব তথাকথিত সাহিত্যের মোড়কে নিজেকে উপস্থাপন করেননি কখনো। যথার্থ মূল্যায়ন না পাওয়ার কারণে তার ভেতর ক্ষোভ ও অভিমান থাকতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষোভ বা অভিমান বারবার শক্তিরূপে ফিরে এসেছে তার শিল্প সাধনায়।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আমি একটি গল্পসঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, লেখকের নামকে নয় তার লেখাকে মূল্যায়ন করব। সেই সংকলনের প্রথম গল্পটি ছিল শাহীন আখতারের। আর শেষ লেখাটি ছিল সাদাত হোসাইনের। বয়সের ক্রম অনুযায়ী সূচি সাজানো হয়েছিল। এই গ্রন্থের সাত নম্বর গল্পটি ছিল লতিফ জোয়ার্দারের। গল্পটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছিল, এই একটি গল্প দিয়েই কথাসাহিত্যিক লতিফ জোর্য়াদারের শক্তিকে চেনা সম্ভব। তিনি এই গল্পে প্রান্তিক কৃষক সমাজের দারিদ্রপীড়িত জীবনের নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন অসাধারণ শিল্প শৈলীতে।
গল্পটির নাম ‘ঘূণপোকার বাসা’। একজন সাধারণ কৃষক ও তার স্ত্রীর জীবন সংগ্রামের গল্প এটি। গল্পের শুরুটা এমন,এবারের মতো খাইয়ে লে বাপ। দু’দিন গেলি পরে হাটবার। তখন আর শুইদি ভাত খাতি হবিলানে। ভেজা মাইঝির উপুর মাদুর পাইতি সকালের বাসি পান্তা লিয়ে বসে আলেকা। তার উপুর কার্তিক মাস হালকা শীতের আমেজ, সারারাতে ভাত একটুও মজে না। ডেব ডেব করে চোখ মেলে তাকায়ে থাকে, ভাত মুখে লিতি লিতিই কয়ডা পইড়ি যায় পাতের উপুর। কাঁচা মরিচ একটা জুটলিও চড়া দামের কারণে পিঁঁয়াজের দেখা মিলে না।
এই হলো কৃষকদের অবস্থা। যারা সারা বছর রোদে জ্বলে, ঝড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয় সেই কৃষকের ঘরে খাবার থাকে না। দারিদ্র সম্পর্কে চার্লাস ডিকেন্সের বাক্যটি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়, ‘শহরের একপ্রান্তে অনেক খাবার। কিন্তু ক্ষুধা নেই। শহরের আরেক প্রান্তে অনেক ক্ষুধা কিন্তু খাবার নেই।’ আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি আবার আমরাই সমাজে এই বৈষম্য দিন দিন বাড়িয়ে চলেছি। গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী হচ্ছে আরও ধনী। এই মাটির কষ্টের টাকা রাতারাতি পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এবং এই কাজটি করছে কারা, যারা নিজেদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে দাবি করে। যারা মিটিংয়ে মিছিলে দেশ গেল, দেশ গেল বলে বুক চাপড়ায়। রাষ্ট্রের প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। আর যারা নিজের শরীরের রক্তকে পানি করে মাটির বুকে সোনা ফলায় তাদের ঘরে খাবার নাই।
মায়ের এত চেষ্টার পরও সেই সুদা ভাত কুরবানের খাওয়ার প্রচেষ্টা সফল হলো না। ভাতের মধ্যে লাল কেন্না পড়ে যায়। আলেকা তবু যুক্তি দেখায়, খাওয়া যাবিলা ক্যারে বাপ! কেন্না তো আর তেলাপোকা লা যে ভাত খাওয়া যাবি না। কেন্নি তেলাপোকার চায়েও ভালো।
আলেকাদের বাড়ির বর্ণনা দিয়েছে লেখক এভাবে, কুসুরের পাতার সাথে খেড়ের ছাওনির ঘর। বর্ষা আসলি গাছের পাতা পইড়ি, সমস্ত ঘরের চালে কেন্নির হাট বসে। কত রাতে বৃষ্টির মত চাল থেকে কেন্নি পড়তি থাকে, মশারি একটা ছিলি বলে বাঁচা।
এই হলো তাদের বাড়ির অবস্থা। ছেলে কুরবানের অনাহারী দেহ শুকনো, বুকের হাড়গুলো পর্যন্ত গোনা যায়। এই হল কৃষক দুলালের পরিবার। দুলাল গেছে জমিতে। দুপুর গড়িয়ে গেলেও দুলালের ফেরার নাম নেই। আলেকা বিড়বিড় করতে থাকে, ঘরের সব কাম শেষ হলিও মানুষটার আসার সময় হয় লাকো। তাড়াতাড়ি না আসলি ভাত খাবানি ককুন। দশ সের ধানের চারা ফেলাতি বোলে এত সময় লাগে। দু’দিন ধইরি জোলার মদ্দি কলমি পরিষ্কার কইরি আইল বাইধি, কলা গাছে দড়ি বাইধি মই দিতি দিতি আর ধান ফেলানি গেলো লাকো।
দুলাল কাদা মেখে জমি থেকে ফিরে একটু সাবান দিয়ে গোসল করতে চায় কিন্তু সাবান থাকবে কোথা থেকে। দুমাস ধরে সাবান কেনা হয়নি। দুলাল অভাবের তাড়নায় বাড়ির সব কিছু বেচে ফেলে। এমনকি আলেকার বিয়ের কোনো স্মৃতিই সে রাখেনি। কানের দুল, গলার চেইন, পিতলের থালা সব কিছু সে বেচে ফেলেছে। এখন তার নজর পড়েছে বাড়ির ফলজ আম গাছটার দিকে। এবার আলেকা বুক পেতে দাঁড়িয়েছে। সে কিছুতেই গাছটা বিক্রি করতে দিবে না। কিন্তু সে কি পারবে তার সন্তানের মতো গাছটা বাঁচাতে?
একদিনের কথা, দুলাল কুড়াল আর করাত নিয়ে এসে বারান্দায় বসল। আলেকা বলে, ‘দ্যাকেন আমি কিন্তু কইলাম গাচে হাত দিলি আমাক হারাতি হবে। ও গাছ তো আমার আরাক ছাওয়াল আলাল। নারে বউ গাচ কাটপো লা। হারিতে যে চাল ডাল কিচুই নাই। তাই ভাবলিম কয়ডা ডাল কাইটি বেচি দি।’ সেদিন আলেকা গাছে হাত দিতে দেয়নি কামলাদের।
এভাবে সংসার টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত আলেকা। আলেকা চায় দুলাল সংসারি হোক। আয় রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করুক। কিন্তু সে আছে বিক্রির ধান্দায়। আলেকার কোনো কথায় সে কানে নেয় না। স্বামী তার কথা শুনবে কেন। একটা বাচ্চা হবার পর তার সব রূপ যৌবন হারিয়ে গেছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আকর্ষণ না থাকলে তার কথা কেন শুনবে স্বামী। তাই আলেকা সিদ্ধান্ত নেয় নিজেকে বদলাবে। গোসল করে আলেকা লাল শাড়িটা বের করে। ‘...মিয়া ভাইয়ের দেয়া লাল শাড়িডা একবার ঈদে পইড়ি আর পড়া হইলি না। আজ আবার একটু পড়লি, দুলাল খুশিই হবির পারে। ঘরের ঘুণ পড়া দরোজাডা বন্দ কইরি কুপ বাতির আলোয় শাড়ি পইরি, গামছা দিইয়ি চুলঝারতি থাকে।
তারপরও দুলালের আসার নাম গন্দ নাই। কুরবানের একঘুম শেষ হওয়ার যো। বাকসো থ্যাইকি গোল আয়না আর ভাঙা লার লিপিস্টিকের শুকনা মাথা থুথু দিইয়ি ভিজিয়ি ঠোঁটে ঘোসপির লাগে আলেকা। বারবার আয়নায় দ্যেকপির থ্যাকে ঠোঁট লাল হলি কিনা।...’ এই হলো চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের রমণী যারা জীবনের শুরুটা স্বামী দিয়ে শেষ হয় স্বামী দিয়েই। তারা অসহায়। তাদের ইচ্ছেগুলো সমাজের কাছে কখনো মর্যাদা পায় না। স্বামী যেমনই হোক সেই তার কাছে ইশ^র। যার জন্য আলেকার এত সাজ সেই দুলাল রাতে আর ফিরে না। কোথায় গেল সোয়ামি কার কাছে, কার ঘরে এই সব ভাবতে ভাবতে রাত পার হতে থাকে আলেকার। ‘ফযরের আযানের সমুয় কুয়ার পাড়ে যাইয়ে অজু কইরি, ঘরে আইসি মাদুর পাইরি নামাজে বসে আলেকা। কান্নাকাটি করতি থাকে আল্লার কাচে। আমি তোর কাচে কিচ্চু চাইনি দয়াময়। শুদু আমার শুয়ামিক ভালো কইরি দে মামুদ। ও যেনি কুনু খানে নিকি বিয়ি না করে। আলেকার চোক থেকি ফুটা ফুটা পানি গরাইয়ি পড়ে।’
সকাল হয়ে যায় অলেকা ফিরে না। দুলাল ফিরে দুপুরের পর। রাগে আলেকা কচমচ করতে থাকে। সে কোনো কথা বলে না দুলালের সাথে। দুলাল বলে, ‘ কীরে বউ রাগ করিচু? রাগ করবো ক্যা, আমি আর কুনুদিন আপনাকে আর কিছু কোতি যাবলা, আপনার যতদিন ইচ্চা যেখেনে খুশি থাকপির পারেন! যা খুশি কোরবির পারেন আমি আর কিচ্চু কবোলা কো। খালি মেইল ট্রেনের সামনে যায়য়ি ছাওয়ালেক লিয়ে দাঁড়াবো আজ...হঠাৎই বাড়ির পিছনে আমগাছের নীচে বেশ কয়জন মানুষের আওয়াজ ভাইসি আসে। আলেকার বুকের ভিতর কাঁপতে থাকে। কুনু কতা বলতি পারে লা। দুলাল বলতি থাকে... ভালো দাম পালিম রে বৌ, গঞ্জে গিছিলিম ব্যাপারি আনতি। আম গাছটা আর না বেচি পারলিম না।’ এভাবেই বির্সজন ঘটে আলেকার স্বাদ-আহ্লাদ-ইচ্ছার। পরিবারের জন্য যে নারী খেটে মরে সেই পরিবারের কাছে নারীর মতামতের যেন কোনো মূল্য নেই।
লতিফ জোয়ার্দার আমাদের কৃষক সমাজের নারীদের অবস্থাকে বিশ্বস্ততার সাথে তুলে ধরেছেন। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে তার দক্ষতা প্রসংশার দাবি রাখে। তিনি নিভৃতে বসে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন নিষ্ঠার সাথে। তার এই সাধনার পাঠক সমাজে একদিন সমাদৃত হবেই হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক