লকডাউন: ত্রাণের রাজনীতি এবং দু’চার কথা
সুশীল ঠাকুর ও নির্ঝর মণ্ডলপ্রকাশিত : মে ১৮, ২০২০
যে কোনো সামাজিক–রাজনৈতিক গণআন্দোলন–গণসংগ্রামের মধ্যেই দু’ধরনের লাইন, দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। একটি সঠিক লাইন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী তথা সর্বহারার শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি সজ্জিত লাইন; অন্যটি বেঠিক লাইন তথা অদ্বান্দ্বিক, আধিবিদ্যক দৃষ্টিভিঙ্গি তথা অসর্বহারা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা শ্রেণি লাইন ও গণলাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। যা বস্তুকে উপর উপর না দেখে, তাকে তার অন্তর্বস্তু অর্থাৎ ‘বিপরীতের ঐক্যের নিয়ম’ দিয়ে দেখে থাকে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত যে কোনো আন্দোলন তার কর্মসূচি–পদ্ধতি–প্রকরণের ক্ষেত্রে সেগুলোকে জনগণের ভেতর থেকেই উঠে আসা শিক্ষাগুলোকে তুলে নিয়ে এসে তাকে আরও সুসমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত রূপ দেয়। কমরেড মাও যাকে বলেছেন ‘জনগণ থেকে নেয়া এবং জনগণের মধ্যেই তা ফিরিয়ে দেয়া’। কোনো বস্তুর বস্তুগত অবস্থানটাকে সঠিকভাবে বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে গেলে এই ‘জনগণের কাছ থেকে শেখার’ কোনো বিকল্প নেই। যারা মনে করেন সংগ্রামের পদ্ধতিগুলো জনগণের মধ্যে থাকে না, থাকে ‘বুদ্ধিমান’ মানুষের ‘উর্বর মস্তিষ্কে’; জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করে না, ইতিহাস সৃষ্টি করেন কিছু সুপারম্যান; তারা আসলে জ্ঞানতত্ত্বের ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। ব্যক্তিবাদের প্রভাবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে, তারা কোনো যৌথ মতের ধার ধারে না; মনে করে ‘স্টুপিড জনগণ’ থেকে কিই বা শেখার আছে! ফলত তারা গণলাইন থেকে যেমন বিচ্যুত হয়, তেমনি বিচ্যুত হয় শ্রেণি লাইন থেকেও।
ইতিহাস দেখাচ্ছে, সর্বহারা শ্রেণির আন্দোলনে এই অধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গী দু’ধরণের রূপ নিয়ে আসে। একটি ‘দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ’, অপরটি ‘বাম দুঃসাহসিকতা’। কমরেড লেনিন এই দুই অসর্বহারা বিচ্যুতিকে ‘যমজ ভাই’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কেন তারা যমজ ভাই? কারণ, তাদের মধ্যে কয়েকটা প্রশ্নে খুব সাদৃশ্য আছে। প্রথমত, পরিস্থিতির বিচার–বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অপারগতাই তাদের এই দুই বিচ্যুতির কোনো একটার দিকে ঠেলে দেয়। মাও নেতৃত্ব প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার সময় আমাদের দেখিয়েছেন, সঠিক নেতৃত্ব তারাই দিতে পারেন, যারা ‘সাধারণের সঙ্গে বিশেষকে’, অর্থাৎ ‘দ্বন্দ্বের সর্বজনীনতার সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতাকে’ মেলাতে পারেন। বস্তুগত পরিস্থিতি এবং নিজেদের বিষয়ীগত শক্তি– এ দু’টিকে মাথায় রেখে যারা সংগ্রামের রূপ–পদ্ধতি–শৈলী–প্রকরণকে দিশা দিতে পারেন; একমাত্র তারাই পারেন একটা সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিতে। সাধারণভাবে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা কিংবা ‘বাম’ বিচ্যুতির ক্ষেত্রে এখানেই সমস্যা। তারা পরিস্থিতিকে হয় কমিয়ে দেখেন, নয়ত বাড়িয়ে দেখেন। কমিয়ে দেখার ফলে তারা ‘সংগ্রামের পরিস্থিতি নেই’ বলে সংগ্রামকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার লাইনকে খারিজ করে দিয়ে তাকে পেছনে টেনে ধরেন এবং তার থেকে আন্দোলনে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী লাইনের নানারূপের তারা জন্ম দেন। আর বাম বিচ্যুতি হলে তারা পরিস্থিতিকে অনেক বাড়িয়ে চড়িয়ে দেখিয়ে সংগ্রাম যতটা দাবি করছে, তার চেয়েও উচ্চতর শ্লোগান এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের চেতনার চেয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে গিয়ে তারা ভাবেন এবং তার ফলে জনগণ থেকে অতি শীঘ্রই তারা বিছিন্ন হয়ে যান। কখনো বা জনগণ থেকে আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে তারা কিছু অ্যাকশনধর্মী কার্যকলাপ করে ‘নিজের পিঠ নিজে চাপরে’ আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো– কখনোই তারা জনগণের মধ্যে লেগে পড়ে থেকে, একাত্ম হয়ে, ধৈর্য ধরে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে, দীর্ঘস্থায়ী পরিপ্রেক্ষিতে সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজটা করেন না, বা করার কথা ভাবতেই পারেন না। মোদ্দা কথা হলো বাম এবং দক্ষিণ– এই দুই বিচ্যুতি সম্পন্ন প্রতিনিধিরাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ‘এক ভেঙ্গে দুই’–এর নিয়ম না মেনে; ‘সাধারণের সঙ্গে বিশেষের মেলবন্ধন’ না ঘটিয়ে; বস্তুগত পরিস্থিতি এবং নিজেদের বিষয়ীগত শক্তির মধ্যেকার সামঞ্জস্যকে মাথায় না রেখে; সমগ্র পরিস্থিতিকে তদন্ত–অনুসন্ধান না করে; সংগ্রামের ধরণ, রূপ ইত্যাদি ঠিক করেন এবং স্বতঃস্ফূর্ততায় ভেসে গিয়ে পরিস্থিতির উপর নিজেদের মনোগত ভাবনাকে চাপিয়ে দেন।
তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সাদৃশ্য হলো– তারা জনগণের শক্তিকে কখনোই গুরুত্ব দেন না। অর্থনীতিবাদী–সংস্কারবাদীরা এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ‘জনগণ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত নন’– এই যুক্তিতে তারা সংগ্রামের রাশ টেনে ধরতে চান, আর বামবিচ্যুতি সম্পন্নরা মনে করেন জনগণ নয়, বীর/ সুপারম্যানরাই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই কারণে যৌথ নেতৃত্ব, যৌথ সিদ্ধান্তকে তারা অস্বীকার করেন– কিছু চমকপ্রদ এ্যাকশান করে ফুটেজ খাওয়া তাদের অন্তিম লক্ষ্য হয়ে যায়। ব্যক্তিস্বার্থ তখন এতোই প্রাধান্য পায় যে, বিপ্লবী আন্দোলনের সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থ তখন আর তাদের মাথায় কাজ করে না।
দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা যেখানে অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া/ সংস্কার/ আশু দাবি ইত্যাদীরা মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন, যেকোনো বিপ্লবী জঙ্গী কাজকর্ম দেখলেই তারা ‘শিশু সুলভ বিশৃঙ্খলার ভুত’ খুঁজে পান; তেমনি, বাম দুঃসাহসিকতাবাদীরা সেখানে যে কোনো অর্থনৈতিক দাবি/ সংস্কারমূলক দাবির মধ্যেই ‘অর্থনীতিবাদ’, ‘সংস্কারবাদ’ খুঁজে পান। তারা আবার আশু দাবি নিয়ে তত ভাবিত নন– এক লাফে অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছতে চান। যার গতিমুখ আসলে ধীরে ধীরে জমি দখলের আন্দোলন, মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বিরোধী আন্দোলন, এমনকি বন্দি মুক্তি আন্দোলনের মতো যে কোনো গণআন্দোলনকেই নাকচ করার দিকে এগোয়। তারা এ ধরনের আন্দোলনকে অর্থনীতিবাদ/ সংশোধনবাদ বলে তকমা দেন। এ ধরণের চিন্তাভাবনা অতিবাম অভিমুখে যেতে বাধ্য। এর উৎস দুটো। হয়, জনগণ থেকে বহুদূরে ঘরের এক কোনে বসে বিপ্লবের তত্ত্ব নিয়ে কেতাবী চর্চাসুলভ পেটিবুর্জোয়া বিচ্যুতি, নয়ত দীর্ঘদিনের শোধনবাদী অনুশীলনের ফলে বিপ্লবের কাজ যেহেতু দীর্ঘায়িত হচ্ছে– তাই, সেখান থেকে আসা তাড়াহুড়োবাদ। দুই ক্ষেত্রেই শ্রেণী উৎস পেটিবুর্জোয়া। অতীতে এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনে এই সমস্যা আমরা দেখেছি। সত্তরের এই বিচ্যুতির কারণ ছিল দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা শোধনবাদের নিগড় থেকে বেরুনোর জন্য একটা তাগিদ, একটা তাড়না, – তা থেকে উদ্ভূত তারাহুড়োবাদ বা জলদিবাজী। এর মধ্যে হয়ত স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল; কিন্তু বিপ্লবের প্রতি আন্তরিকতা জনগণের স্বার্থে আত্মত্যাগের মানসিকতায় কোনো খামতি ছিল না। তবে এর মধ্যে বাম দুঃসাহসিকতা তো ছিল নিশ্চয়ই। আবার মনে আছে, ২০০০ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে নতুনভাবে কৃষিবিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে উঠছে এবং সেই আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছে। বহু রাজনৈতিক কর্মী কারারুদ্ধ হয়েছেন। তখন ‘আন্দোলনের সাথী’ পত্রিকার একটি লেখা এবং শান্তিপাল গোষ্ঠী আর মহাদেব মুখার্জী গোষ্ঠীর দু’টি লিফলেট হাতে এসেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, “যে রাষ্ট্র নিজেই বন্দি করছে তার কাছে আবার নিঃশর্ত বন্দিমুক্তির দাবি তুলবো কেন? এটা তো সোজা সংশোধনবাদ।” এই যুক্তির শ্রেণী উৎস হচ্ছে গণলাইন না বোঝা এবং জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে কেতাবী তত্ত্বচর্চার পেটিবুর্জোয়া বিচ্যুতি। এটার মধ্যে দিয়ে পত্রিকা চালানো বা অনলাইন পোর্টাল চালানো যেতে পারে; কিন্তু বিপ্লব করা যাবে না। এ ধরণের বক্তব্যগুলোকে আমরা বাম দুঃসাসিকতা বলব না, কারণ বাম দুঃসাহসিকতাবাদীদের যে বিপ্লব এবং জনগণের প্রতি আত্মত্যাগের মানসিকতা; বিপ্লবের প্রতি আন্তরিকতা থাকে, তাদের এটা নেই। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়ই নেই। তারা হচ্ছেন মুখে ‘বাম’ সংকীর্ণতার বুলির আড়ালে আদতে প্রবল দক্ষিণপন্থী। বাম এবং দক্ষিণ উভয় বিচ্যুতির দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে শ্রেণী লাইন এবং গণ লাইনের মধ্যে তালমিল রাখতে না পারা। অর্থনীতিবাদী/ সংস্কারবাদীরা যেখানে শ্রেণী লাইন ছেড়ে গণ লাইনে আটকে থাকেন; অতিবামরা সেখানে ‘গণলাইন সদা পরিত্যাজ্য’ এই ভাবনা নিয়ে চলেন। যেহেতু তারা ‘যমজ ভাই’ তাই প্রায়শই দেখা যায় তারা একে অপরে রূপান্তরিত হয়। এখানে যেমন দেখানো হলো– কখনো কখনো একসাথে দুটোই তাদের মধ্যে সহাবস্থান করে। চীনে লিন বিরোধী সংগ্রামে লিন পিয়াওয়ের শ্রেণী অন্তর্বস্তু ব্যখ্যা করতে গিয়ে মাওবাদীরা তাকে ‘মুখে বাম অন্তর্বস্তুতে দক্ষিণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
আজকের লকডাউন, করোনা সংকটের সময় দাঁড়িয়ে যখন এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীরা নানারকম কর্মসূচি নিচ্ছেন, তখনো আমরা দেখতে পাবো উপরোক্ত দু’ধরনের কর্মসূচিও সমান্তরালভাবে ক্রিয়াশীল। কেউ কেউ তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুধুমাত্র ত্রাণ কার্য করাটাই প্রধান এবং একমাত্র মোক্ষ বলে মেনে নিয়েছেন। নয়া–নৈরাজ্যবাদীদের ‘স্বাধীন–স্বতন্ত্র’ ধারার প্রতিনিধিরা তথা ‘না–সংগঠনের’ প্রতিনিধিরা হচ্ছেন সেই ধারার প্রতিনিধি। বিপ্লব যেহেতু একটা ‘গ্র্যান্ড ন্যারেশান’ আর বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা মানে আবার সেই রেজিমেন্টেড সংগঠন বানানো– তাই তারা এসবের থেকে দশ হাত দূরে। ইতিহাসের বস্তুবাদী শিক্ষা থেকে তাদের শিক্ষিত হওয়ার দায় নেই; তারা মুখে বলেন সংগ্রাম গড়ে তোলো; কিন্তু ধারণ করে– সংগঠন গড়ে তোলার দরকার নেই; মুখে স্বীকার করে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ইত্যাদি চিত্তাকর্ষ শব্দ; কিন্তু কাজে করে ঠিক তার উলটো। কোথাও আন্দোলন একটু আইনের গণ্ডি অতিক্রম করলেই তারা ‘সামাল’, ‘সামাল’ রব তোলে। বাস্তবটা হলো– তারা সংগ্রাম না গড়ে তুলে সংগ্রামী আন্দোলনগুলো নানা উপায়ে হাইজ্যাক করে, অন্তর্ঘাত করে এবং দায়িত্ব নিয়ে যেটা করে তা হলো– সংগ্রামকে ধ্বংস করা এবং নিজেদের সংগঠনটা গড়ে তোলা। মুখে তারা রেজিমেন্টেড সংগঠনের ঘোর বিরোধী হলেও কার্যত তারা খুবই রেজিমেন্টেড। সামনে দেখানো জিবির ভরংয়ের আড়ালে অল্প কিছু জনের কোর বডিতেই যাবতীয় ঠিক হয়। পুরনো নৈরাজ্যবাদীদের বিতর্ককেই তারা নতুন মোড়কে হাজির করছেন। সেদিক দিয়ে দেখলে বিপ্লবী আন্দোলনে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে তারা হচ্ছেন বাকুনিনের আধুনিক অবতার। আজকের করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাদের ত্রাণ কর্মসূচিগুলোতেও একই দৃষ্টিভঙ্গী এবং কর্মসূচির প্রকাশ ঘটছে। যদিও এটাও ঠিক– বহু মানুষ, যাদের কিছুটা আর্থিক সহায় সম্বল আছে, তারা একেবারে মানবিক কারণেই নিরন্ন, বিপন্ন মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যাদের কাউকে কাউকে তারা তাদের ত্রাণ কর্মসূচিতে সামিলও করতে পারছেন।
তাদের বাইরে আজ আমরা সেই দলকেও দেখতে পাব, যারা মুখে বাম, অন্তর্বস্তুতে দক্ষিণপন্থী। তারা একদিকে যেমন, যারা ত্রাণ কর্মসূচি নিচ্ছেন, তাদের আক্রমন করছেন ‘জনগণকে ভিক্ষে দেওয়ার’ অভিযোগ তুলছেন; অন্যদিকে গোটা আন্দোলনটাকে রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জঙ্গী কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটার মধ্যেই বিপ্লবী মোক্ষ দেখছেন। প্রথমটা যদি বাম সংকীর্ণতা হয় তবে, তাদের দ্বিতীয় বক্তব্যটা অন্তর্বস্তুতে অর্থনীতিবাদ। অধিবিদ্যাও। কারণ তারা শুধু বৃক্ষকে দেখছেন। অরণ্যকে দেখছেন না। শুধু রেশন সমস্যাকে দেখছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, কাজ হারানোর সমস্যা, শ্রমিকদের ১২ ঘণ্টা করে কাজ করানোর শাসকদের ষড়যন্ত্রমূলক অভিসন্ধি, শ্রমিকদের এবং কর্মচারীদের স–বেতন ছুটির দাবি, কৃষকদের এবং ছোট ব্যবসায়ীদের ফসলের দাম না পাওয়ার সমস্যা এবং ব্যবসা লাটে ওঠার সমস্যা, ছাত্র–ছাত্রীদের বিপন্নতা এগুলোকে তারা হয় দেখছেন না, নয়ত গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যদিও অতীতে তারাও বিপ্লবী কর্মীদের সঙ্গে ভূমিকম্প বা বন্যা দূর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ত্রাণ দিয়েছিলেন। সেদিন তারা ওই বিপন্ন মানুষকে ভিক্ষে দিতে গিয়েছিলেন কি–না, এই প্রশ্ন তাদের দিকে তোলাই যায়; কিন্তু এতে তাদের চিন্তার দৈন্যতার মূল বিষয়টা থেকে আমরা সরে যেতে পারি। তাই আপাতত এই চর্চা মুলতুবি থাক। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ত্রাণ দেওয়া মানে জনগণকে ভিক্ষা দেওয়া– গণলাইন সম্পর্কে ভাবনার কি দৈন্যতা! এটুকু তারা বোঝেন না যে, বিপ্লবী কর্মীরা জনগণের কাছে যখন যান, নিছক ত্রাণ দিতে যান না, সংগঠিত করতে যান। পাশে দাঁড়াতে যান। এটা জরুরি। মাও যেমন বলেছেন, “আমরা কি ব্যপক জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে চাই? আমরা কি চাই জনসাধারণ তাদের সমস্ত শক্তি যুদ্ধফ্রন্টে নিয়োজিত করুক? যদি তা–ই হয়, তবে আমাদের অবশ্যই জনসাধারণের সঙ্গে থাকতে হবে, তাদের স্বার্থের জন্য আন্তরিক এবং অকপট হিসেবে কাজ করতে হবে এবং তাদের উৎপাদন ও দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি সমস্যা, অর্থাৎ লবণ, চাল, বাসগৃহ, কাপড়, শিশুজন্ম সমস্যার সমাধান করতে হবে, অন্য কথায় জনসাধারণের সমস্ত সমস্যারই সমাধান করতে হবে। আমরা যদি এভাবে কাজ করি, তাহলে ব্যপক জনগণ নিশ্চয়ই আমাদের সমর্থন করবেন। বিপ্লবকে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় পতাকা বলে মনে করবেন।” (জনসাধারণের জীবনযাত্রার প্রতি মনোযোগ দিন। কর্মপদ্ধতির প্রতি মনযোগ দিন)
দ্বিতীয়ত, তারা যখন বলতে চাইছে ‘তৃণমূল কর্মীদের মারের ভয়ে’ রাস্তায় নেমে রেশন আন্দোলন থেকে বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীরা বিরত থাকছেন (সরাসরি বিপ্লবী কর্মীদের নাম না বললেও ইঙ্গিতটা সেদিকেই), তখনই বোঝা যায় তারা জনগণ থেকে কতোটা বিছিন্ন এবং তদন্ত অনুসন্ধান না করেই আক্রমণের অমার্ক্সবাদী নীতি দ্বারা কতটা পথভ্রান্ত। কারণ, প্রথমত লক–ডাউনের একেবারে শুরুর দিন থেকেই আমরা দেখবো পুলিশী সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করেই বিপ্লবী কর্মীরা রাস্তায় নেমেছিলেন। পুলিশের সন্ত্রাস, লাঠিবাজির বিরোধিতা করে শুরুর দিনই প্রহৃত হয়েছিলেন সংগ্রামী শ্রমিক মঞ্চের নেতা সুশীল ঠাকুর। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার খবরের দৌলতে তা দেখেছি। বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্টের (আরএসএফ) মতো বিপ্লবী ছাত্র–ছাত্রীদের সংগঠন এবং বিপ্লবী যুবরা যেসব গ্রামে গ্রামে এবং কলকাতার শহুরে বস্তি এলাকায়, মফস্বলে এনআরসি বিরোধী কর্মসূচি নিয়েছিলেন এবং আগে থেকেই তাদের রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে যেতেন, সেখানে ত্রাণ কার্য শুরু করেছিলেন। যে প্রক্রিয়া এখনো জারি আছে। প্রথম দিকে পুলিশের রক্তচোখ উপেক্ষা করেই তারা সেগুলো সংঘটিত করেন। সংগ্রামী শ্রমিক মঞ্চ এবং সংগ্রামী কৃষক মঞ্চসহ একাধিক সংগঠনও একই কাজ করেন। এগুলো সবই শ্রেণী লাইন এবং গণলাইনের উপর দাঁড়িয়েই শুরু হয়। কারণ এক্ষেত্রে গোটা ত্রাণকার্যটা শ্রমজীবী মানুষদের নিয়েই পরিচালিত হয়; শ্রমজীবী মানুষরাই এই ত্রাণকর্মসূচি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেন। এটা ছিল তাদের শ্রেণী লাইনেরই অংশ। পাশাপাশি শ্রমজীবী জনগণ ছাড়াও ব্যাপক সাধারণ মানুষ, গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরাও তাদের এই ত্রাণ কার্যে ব্যপকভাবে সহায়তা করতে হাত বাড়িয়ে দেন। এটা ছিল তার গণলাইনের দিক। প্রায় প্রতিটাই গ্রামে–বস্তিতেই মিটিং করে এবং নানা লেখাপত্র, অনলাইন সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে করোনা–লকডাউন ইত্যাদি নিয়ে এবং কোন জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে তা সৃষ্টি হয়েছে; এর পিছনে বিশ্ব পুঁজিবাদের ভূমিকা; ভারতীয় শাসকশ্রেণীর ষড়যন্ত্র; লকডাউনে কোন শ্রেণীর লাভ, কোন শ্রেণীর ক্ষতি; অতি–ধনিদের উপর করোনা–ট্যাক্স চাপানোর দাবি কেন তোলা দরকার; মজুতদারি–কালোবাজারি নিয়ে শুরু থেকেই প্রচার করা; রেশনের দাবি; পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারি খরচে ঘরে ফেরানোর দাবি; শ্রমিকদের সবেতন ছুটির দাবি; শ্রমিক ছাঁটাই না করার দাবি; অন লাইনে পরীক্ষার শ্রেনী অন্তর্বস্তুকে উন্মোচন করা; গণ–চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করার দাবি; শ্রমিকদের মজুরি কমানো এবং ১২ ঘণ্টা করে কাটানোর সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার, হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং অপবিজ্ঞান প্রচারের বিরোধিতা এবং নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবই কেন একমাত্র মুক্তির পথ– এইসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিক সমস্যাটা তুলে ধরে বিপ্লবের দিশাও দেখানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুধু ত্রাণ সাহায্যই নয়, সেই সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতি প্রচার করা হয়। পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গায় রেশনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। সরকারি বরাদ্দ খাদ্যদ্রব্য রেশন ডিলারকে দিতে বাধ্য করা হয়। সরকারি প্রতিটি স্কিম যে ভিক্ষা বা সরকারি দয়া নয়, মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার– সেটা নিয়ে জনগণকে সচেতন করা হয় এবং তা আদায় করতে সাধ্যমতো উদ্যোগ নেওয়া হয়। ত্রাণের অনুদানের জন্য আপিল করার স্বার্থে কিছু কিছু ত্রাণ কর্মসূচির ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা প্রদর্শিত করা হয়নি, কারণ আত্মপ্রচার বিপ্লবীদের শোভা পায় না। আর একথা কে না জানে যে ফুল তার নিজের সৌরভেই পরিচিত হয়। করোনা–লকডাউন পরিস্থিতিতে জনগণের সামনে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং দেবে, সেগুলো নিয়ে বিপ্লবী গণসংগঠনগুলো ব্যপক সচেতনতা কর্মসূচি নিচ্ছে। এর মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য তারা ব্যপক কর্মসূচি নেয়। এখনো অবধি কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে; তাদের ঘরে ফিরতে সাহায্য করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; তাদের জঙ্গী বিক্ষোভগুলোকে সাহায্য করা এবং সর্বসমক্ষে তুলে ধরার জন্য বিপ্লবী কর্মীরা; বিশেষত ছাত্র–ছাত্রীরা ব্যপক উদ্যোগ নিয়েছেন। এর জন্য একদিকে তারা যেমন বহু শুভাকাঙ্ক্ষীকে পাশে সমাবেশিত করেছেন; বেশ কিছু বিজ্ঞান ক্লাব/ সাংস্কৃতিক দলকে নিয়ে জোট বেঁধেছেন; পাশাপাশি তারা দিল্লি–বিহার–রাজস্থান–হরিয়ানা–পাঞ্জাব–মহারাষ্ট্র–তামিলনাড়ু–কেরালা–তেলেঙ্গানা–উড়িষ্যার গণতান্ত্রিক ছাত্র, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোর সাহায্যও নিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন রাজ্যজোড়া এক বিস্তির্ণ প্রশস্থ মঞ্চও, পরিযায়ী শ্রমিক এবং কৃষি মজুরদের নিয়েও গড়া হয়েছে আলাদা মঞ্চ, যা বিপন্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের লড়াইগুলোতে ব্যপক প্রেরণা যুগিয়েছে। দেশজুড়ে গড়ে ওঠা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভে–আন্দোলনে এই উদ্যোগগুলো এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের ক্ষুদ্র বিষয়ীগত শক্তির কারণে, এটুকু কাজ করতেই তাদের রাত–দিন পরিশ্রম করতে হচ্ছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্যই। আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই। তবে ঘটনা এটাই যে, যতটুকু এই কাজ করা হয়েছে, তা শ্রেণী লাইন এবং গণলাইনকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তা পরিচালিত হচ্ছে বিপ্লবের দিশাতেই।
বিপরীতে, আজ যারা এই কাজগুলোকে ‘ভিক্ষা দেওয়া’ ইত্যাদি বলছেন এবং নিজেরা একটা দুটো ছোটখাটো উদ্যোগ নিয়ে, সেটাকেই বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা এবং আত্মপ্রদর্শনে ব্যস্ত। তাদের বক্তব্য শুনতে ‘বাম’ লাগলেও অন্তর্বস্তুতে তা দক্ষিণপন্থী। কারণ, আগেই বলেছি সংস্কারবাদী দাবি নিয়ে বা অর্থনৈতিক দাবি–দাওয়া নিয়েই আন্দোলন করা মানেই সংস্কারবাদ বা অর্থনীতিবাদ– এটা একটা ভুল ধারণা। অর্থনীতিবাদ বা সংস্কারবাদ হলো নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দাবি বা সংস্কারমূলক দাবির গণ্ডির মধ্যেই আটকে থাকা। আর বিপ্লবী আন্দোলন মানে হলো– যে কোনো আন্দোলনের মধ্যে বাইরে থেকে বিপ্লবী চেতনাটা নিয়ে যাওয়া। প্রতিটি আশু দাবি নিয়ে ছোট ছোট আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রটাকেও উন্মুক্ত করার কাজটা চালানো, যাতে ক্রমশ আন্দোলনটা রাষ্ট্র বিরোধী চরিত্র লাভ করে। তার জন্য আন্দোলনের প্রতিটি ইস্যুকে একত্রিত করা। তার সঙ্গে সামগ্রিক শাসকশ্রেণীর স্বার্থের সম্পর্কগুলো তুলে ধরা; জনগণের শোষণ–বঞ্চনার প্রতিটি দিক তুলে ধরা; এবং তার থেকে মুক্তির দিশা দেখানো। তার জন্য নীতির প্রতি দৃঢ় থেকে নমনীয় কৌশল গ্রহণ করা; সংগ্রাম এবং সংগঠনের যত ধরনের রূপ আছে, সব কিছুকে কাজে লাগানো– এটাই বাম এবং দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতিকে হারিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেনিনীয় শিক্ষা। এই কাজটা না করে শুধু ত্রাণ দেওয়া কিংবা শুধু রেশনের দাবিতে আটকে থাকা; গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির উপর দাঁড়িয়ে যৌথ নেতৃত্ব–যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বদলে উগ্রগণতন্ত্র বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদ– দু’টিই অন্তর্বস্তুতে দক্ষিণপথী সুবিধাবাদ– মুখে যত বাগাড়ম্বরই থাকুক না কেন।।
লেখকদ্বয়: পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলন কর্মী