রোহিঙ্গা: কিছু প্রশ্ন ও আশঙ্কা

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০১৯

১. এই দেশে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল তো বটেই, অন্য যে কোনো ধরনের সংগঠনও সমাবেশ করতে গেলে প্রশাসনের অনুমোদনের দরকার হয়। এবং অনুমোদন নেবার পরেও অনেক সময় শেষ মুহূর্তে সমাবেশ বাতিল করার হুকুম আসে। গত বছর উদীচী-র কয়েকটি শাখার সম্মেলন করার সময় এমন ঘটনা ঘটেছে। এখন শাহবাগে দাঁড়াতে গেলেও পুলিশ এসে মাইক কেড়ে নিয়ে যায়।

সেখানে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা এমন সমাবেশ করতে পারে কীভাবে? এমন একটি সমাবেশ হঠাৎ করে আয়োজন করা যায় না। বেশ কয়েকদিন ধরেই নিশ্চয়ই প্রচার এবং আয়োজন চলছিল। মিডিয়া তা দেশের মানুষের গোচরে আনেনি। এদিকে প্রশাসন বলছে তারা সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। তাহলে সমাবেশের আয়োজনে বাধা দেয়নি কেন? সমাবেশের পরেও আয়োজকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

২. মহিবুল্লা নামের রোহিঙ্গা নেতা ও সমাবেশের বক্তা প্রিয়া সাহার সঙ্গী ছিল ট্রাম্পের কাছে দরবার করার সময়। প্রশ্ন-- সে কোন দেশের পাসপোর্ট ধারী হিসাবে আমেরিকায় গিয়েছিল?

৩. মোবাইলের সিমকার্ড নেবার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। রোহিঙ্গারা কোন পরিচয়পত্র দেখিয়ে সিম কিনছে? ইন্টারনেট ব্যবহার করছে?

৪. সরকার বলছে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাতে না যেতে পারে, সেদিকে তীক্ষ্ন নজর তারা রাখছে। তাহলে দলে দলে রোহিঙ্গা ইয়াবা এবং অস্ত্র চোরাচালানের সাথে কীভাবে যুক্ত হচ্ছে? তারা এই ব্যবসার প্রতিযোগিতায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকী সরকারী দলের লোকদেরও খুন করছে। আবার পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে(!) রোহিঙ্গা মারাও যাচ্ছে। এসব ঘটছে কীভাবে? হয় পুলিশ-বিজিবি টাকা খেয়ে তাদের বাইরে আসতে-যেতে দিচ্ছে, অথবা নিশ্চয়ই তারা পুরোপুরি অথর্ব বা দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখাচ্ছে?

৫. ২২ আগস্ট প্রথম দফায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা ছিল। এটি ঘটছিল চীনের মধ্যস্থতায়। অর্থাৎ এই প্রত্যাবর্তনকারী রোহিঙ্গাদের গ্যারান্টার ছিল চীন। অন্তত এদের দেশে পাঠিয়ে দেখা যেত মিয়ানমার তাদের সাথে ঠিক কোন ধরনের আচরণ করে। সরকার এবং বিশ্ব সংস্থাগুলোও দেখতে পেত, রোহিঙ্গারাও নিজেদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই লোকগুলোকে মনিটর করতে পারত।

৬. রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরা হয়নি কখনো। মিয়ানমারের আইনে বলা হয়েছে, যেসব পরিবার ১৯৪৮ সালের আগে থেকে আরাকানের বাসিন্দা, তাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নহীন। আর যেসব পরিবার ১৯৪৮ সালের পরে আরাকানে গেছে, তারা নির্ধারিত ফরমে আবেদন করবে। সেগুলো যাচাই-বাছাই এর পরে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু রোহিঙ্গারা, এনজিওরা, বা আমাদের সরকার, কেউ-ই এই কথাগুলো পরিষ্কার করে জানাচ্ছে না।

রোহিঙ্গারা নিজদেশে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে এসেছে এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের সহানুভূতিও তাদের প্রতি ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মিয়ানমার যেমন তাদের ফেরত নিতে চায় না, আমাদের সরকারের ভেতরেও তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তেমন তাগাদা নেই।

বাংলাদেশ নানামুখি ষড়যন্ত্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের সরকারের প্রধান ভরসা ভারত কোনো সহযোগিতা তো করেইনি উপরন্তু ভারতে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরও বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। চীন-রাশিয়াকে এত ব্যবসা দেওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের পাশে পায়নি। এদিকে বিজেপি নেতা খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত অঞ্চলটি ভারতকে দিয়ে দেবার দাবি তুলছে। ত্রিপুরায় চাকমারা সমাবেশে করে দাবি তুলছে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের হাতে তুলে দেবার। পাহাড়িদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করায় পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে।

টেকনাফে বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ, আর রোহিঙ্গা ১৩ লাখ। আরাকান এবং চট্টগ্রাম নিয়ে রোহিঙ্গাল্যান্ড তৈরির পুরনো পরিকল্পনার কথাও আমরা জানি।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে আমরা গভীর থেকে গভীরতর সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক