হাফেজ রেজাউল

হাফেজ রেজাউল

রেজাউল ঊনমানুশ, এই নাগরিক সমাজে

তুহিন খান

প্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০২৩

ফেসবুকে সেদিন একটা পোস্ট চোখে পড়ল, হুমায়ুন আজাদের একটা বক্তব্যের প্যারোডি: আ. লীগরে বিশ্বাস কইরেন না, যদি সে ‘শান্তি’ নিয়া আসে, তবু।

 

এই যে দ্যাখেন, আ. লীগের ‘শান্তি সমাবেশে’র বলি হইল হাফেজ রেজাউল। শেরপুরের ছেলে রেজাউল যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসায় পড়ে। তার বাপ বর্গাচাষী, কৃষক। পুব বাঙলার আদিম কৃষক ভূমিপুত্রদের প্রতিচ্ছবি এই রেজাউল। আ. লীগ তারে চিরকালের জন্য ‘শান্তি’ দিয়া দিল। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিয়ুন।

 

২.
অনেক মিডিয়ায় রেজাউলের মরনের খবর আসেই নাই। যেগুলায় আসছে, বেশিরভাগই খবরটা ছাপছে হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামি দলের প্রতিবাদের সূত্রে। ‘মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুতে হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ’— এই থিমে খবরটা আসছে মিডিয়াগুলায়। যেন রেজাউলের খুন আলাদাভাবে নিউজ করার মত কিছু না; এখন ইসলামি দলগুলা যে প্রতিবাদ করতেছে এই খুনের, এইটাই যেন মেইনলি হাইলাইট করার ব্যাপার। যুগান্তর, বিডিনিউজ, সমকাল আর প্রথম আলো— এই পত্রিকাগুলা এই থিমের বাইরে গিয়াও দুই একটা নিউজ করছে দেখলাম।

 

৩.
এই খুন নিয়া কোন ‘নাগরিক উদ্বেগ’ বা ’বিবৃতি’ নাই, খেয়াল করলাম। পলিটিকাল কর্মী খুন হইলে সুশীল সমাজ পলিটিক্সরে দায় দিয়া চুপ থাকেন। কিন্তু রেজাউল তো সাধারণ জনগণ; আম পাব্লিক। সে বায়তুল মোকাররমে গেছিল হয়ত নামাজ পড়তে, হয়ত একটা পাঞ্জাবির কাপড় দেখতে, আতর কিনতে। ফিরল লাশ হইয়া। সাধারণ মানুশের ‘দুর্ভোগ’ নিয়া অনেক পত্রিকাই সিরিজ জার্নালিজম করতেছে। কই, রেজাউলের খুন নিয়া তারা এত দায়সারা কেন?

 

রেজাউলের জন্য ’নাগরিক উদ্বেগ’ কেন নাই? রেজাউল কি এদেশের নাগরিক না? আশলে ইকুয়েশনটা সিম্পল। রেজাউলের জানের দাম কম। এই জায়গায় কোন নামকরা কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র খুন হইলে অনেক প্রতিবাদ হইত। যারা নির্বাচনের টাইমে এইসব খুনরে আ. লীগের বিপক্ষে ইউজ করতে নারাজ, তারাও অ্যাটলিস্ট ‘উদ্বেগ’ জানাইতেন। কিন্তু রেজাউল তো কিছুটা ঊনমানুশ, এই নাগরিক সমাজে। সে মাদ্রাসায় পড়ে, কৃষকের পোলা, চেহারা সুরতে বিন্দুমাত্র ‘নাগরিক’ ছাপ নাই। ফলে তারে নিয়া কোন নাগরিক উদ্বেগও নাই।

 

৪.
হাফেজ রেজাউল এদেশের সেইসব সাধারণ মানুশের প্রতিনিধি, যারা কোন রাজনীতি না কইরাও আ. লীগের দুঃশাসনের বলি হইতেছেন প্রতিদিন। রেজাউল যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার ছাত্র। যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সাধারণত সরকারবিরোধী অবস্থান নেন না। বরং অ্যাপলিটিকাল থাইকা সরকারের চোখে তুলনামূলক ‘সেফ’ একটা ইমেজ তৈয়ার করছেন উনি। ফলে উনার মাদ্রাসা থেকে এ ব্যাপারে কোন কড়া পদক্ষেপ আসবে না, এইটা অনুমেয়।

 

ওদিকে বৃহত্তর কওমি সমাজ এই ইস্যুতে এখন কোন বড় পদক্ষেপ নিলেই ইস্যুটা ঘুইরা যাবে। বিএনপি-জামায়াতের স্বার্থ উদ্ধার করতেছে কওমিরা— এমন একটা ভাইব তৈয়ার করবে মিডিয়াগুলা; শেষমেশ জিনিশটা হয়ত একটা ম্যাসাকারে গিয়া শেষ হবে। ফলে অ্যাপলিটিকাল, অসংগঠিত কওমি সমাজের এই ইস্যুতে কোন বড় পদক্ষেপ নেওয়া মূলত এক ধরনের আত্মঘাত, আজকের এই বাঙলাদেশে। তবু যারা এই ঝুঁকি মাথায় নিয়াও প্রতিবাদ করতেছেন, আমি তাদের সাধুবাদ জানাই।

 

৫.
কিন্তু বিএনপি বা আন্দোলনরত অন্য দলগুলা কি রেজাউলরে নিয়া একটা বিবৃতিও দিতে পারেন না? রেজাউলের খুনের বিচারের দাবি উঠাইতে পারেন না? পারেন, এবং এইটা তাদের করাও উচিত বইলা আমি মনে করি। বাকশালি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যে লড়াই চলমান, রেজাউল সেই লড়াইয়ের একজন শহিদ। এই স্বীকৃতি যদি আমরা দিতে না পারি, তাইলে বোঝা যাবে, আমরা এখনও সভ্য হইতে পারি নাই। সমাজে ‘নাগরিক অধিকার’ নিশ্চিত করতে পারি নাই। গণমানুশের আকাঙ্ক্ষা, অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও ম্যান্ডেটরে ধারণ করা লাগবে বিএনপিসহ সমমনা গণতন্ত্রকামী দলগুলার। নাইলে নতুন দেশ গড়ব কেমনে আমরা?

 

চলমান লড়াই তো খালি আ. লীগ সরকাররে ফেলে দেওয়ার লড়াই না। দেশ পুনর্গঠনেরও লড়াই। মানুশের মানবিক মর্যাদা সমুন্নত করার লড়াই। বাঙলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকরে তার মর্যাদা ও অধিকার ফিরায়ে দেওয়ার লড়াই। ফলে রেজাউল গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠেন।

 

রেজাউল সেই সমাজের প্রতিনিধি, যাদের নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার এই দেশে এখনও স্বীকৃত না। ‘স্বীকৃতি’ নামের একটা পলিটিকাল মুলা দিয়া যে মানুশরে তার মানবিক মর্যাদা ফিরায়ে দেওয়া যায় না, আ. লীগের হাতে জান দিয়া রেজাউল সেইটাই প্রমাণ করলেন।

 

৬.
বিভিন্ন ইস্যুতে যারা সমাজে ইসলাম কায়েম কইরা ফ্যালে, মিনিটে মিনিটে শাহবাগি ধরে, খেলাফতের স্বপ্ন দেখে, আবরার ফাহাদদের মরনরে নিজেদের ইডিওলজিকাল প্রোপাগাণ্ডার পক্ষে কাজে লাগায়, এরাও রেজাউলের খুন নিয়া চুপচাপ। এর কারণ প্রথমত এই যে, এদের অনেকেই তো চায় গণতন্ত্র না ফিরুক; আ. লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকুক। সেইটা তাদের ইডিওলজিকাল প্রজেক্টের জন্য খুব জরুরি। ফলে, চলমান ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে এরা রাজি না; বরং আ. লীগরেই ইনায়ে বিনায়ে জাস্টিফাই করতে মরিয়া এরা।

 

আবার, রেজাউল তো এদের প্রোপাগাণ্ডার স্বার্থপূরণে কোন কাজেও আসবে না। রেজাউল ভার্সিটি বা কোন নামকরা কলেজের ছাত্র না। তার পক্ষে আলাপ কইরা তো কলেজ ভার্সিটির ইয়ং পোলাপানরে ‘আকৃষ্ট’ করা যাবে না। ভাল সরকারি চাকরি নিয়া, ক্যারিয়ার কইরা, তারপর আ. লীগের আন্ডারে খেলাফত কায়েমের স্বপ্নপূরণে রেজাউল তো কোন কাজেই আসবে না। তার জানের পক্ষে দাঁড়াইলে ‘শাহবাগি’দেরও দায় দেওয়া যাবে না; কারণ রেজাউল তো নীরিহ পথচারী হিশাবে লীগের গুণ্ডাদের হাতে মারা গেছে; কোন ইডিওলজিকাল কারণেও মরে নাই। তার খুনের দায় ডিরেক্ট লীগের।

 

ফলে, রিয়েল পলিটিক্সরে ওভারলুক কইরা ইডিওলজিকাল প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায় যারা, যারা লীগরে সেফসাইড দিয়া ‘শাহবাগি’ নামক একটা ভেগ শত্রুর সাথে ইডিওলজিকাল ওয়ার চালায়, যারা এই ওয়রের মূল শক্তি হিশাবে টার্গেট করে কলেজ-ভার্সিটির কমবয়সী পোলাপানরে, তাদের জন্য রেজাউল লস প্রজেক্ট। তাই রেজাউলের মৃত্যুতে এই পুরা সার্কেলটার, খেয়াল কইরেন, কোন হায় হুতাশ নাই।

 

৭.
রেজাউল চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একজন শহিদ। দেশের কোন পলিটিকাল, সোশাল বা ইন্টেলেকচুয়াল গোষ্ঠীর কাছে রেজাউলের জানের হয়ত কোন দামই নাই। রেজাউল এই দেশের একজন উন-নাগরিক। কিন্তু, আমরা যারা দেশের প্রত্যেকটা নাগরিকরে তার নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা ফিরায়ে দেওয়ার লফাইয়ে লিপ্ত, আমাদের জন্য লড়াইটা আরো বিগার, আরো গ্রেটার।

 

ফলে রেজাউল আমাদের এই আন্দোলনের একজন শহিদ। রেজাউলদের লাশের স্মৃতি আমরা ইতিহাস থিকা মুইছা ফেলতে দেব না। এই দেশের মাটিতে রেজাউলদের খুনের বিচারের দাবিও একদিন সমস্বরে উঠবে। আমরা সেইদিন পর্যন্ত রেজাউলদের অতৃপ্ত আত্মার স্মৃতি দিল ও দেমাগে নিয়া ঘুরব।
শহিদ রেজাউল জিন্দাবাদ।
ইনকেলাব জিন্দাবাদ।

 

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

 

লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে। মতামতের জন্য ছাড়পত্র কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। `মনের জানালা’ পাঠকের মত প্রকাশের প্লাটফর্ম