রেজা ঘটকের ছোটগল্প ‘ধলাই’
প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২১
ঘুম ভেঙে গেলে তুমি কী করো? প্রথমে এক গ্লাস পানি খাও নাকি একটা সিগারেট ধরাও! যদি পানি খাও তাহলে বুঝব তোমার বাঁচার বড় সাধ! আর যদি সিগারেট ধরাও তাহলে বুঝব এই তুচ্ছ জীবন নিয়ে তোমার কোনো টেনশন নাই। শোনো মিঞা, টেনশনের কিছু নাই। আসো একখান গল্প শোনাই। রাজায় কইছে চুদিরভাই, আনন্দের আর সীমা নাই। আমাগো ধলাই, কয় দিন ধইরা মহানন্দে একটু আউলা ঝাউলা!
মুন্সী গেছিলো ধলাইরে `পড়া পানি` খাওয়াইতে। মুন্সীর `পড়া পানি` খাইয়া এর আগে এলাকার যুবতী মেয়েদের ঠিকঠাক সন্তান প্রসব হইছে। চ্যাংরা মেয়েদের ঘাড় থেকে জ্বীন নামছে। দুষ্টু পোলাপাইন ঠিকঠাক পড়াশুনায় মন দিছে! মুন্সী`র `পড়া পানি` নিতে চৌদ্দ গ্রাম থেকে রোজ মানুষ আসে। যারা যে ইচ্ছা নিয়া আসে তারাই সফল হয়! তাই সাহস কইরা মুন্সী `পড়া পানি` লইয়া যেই না ধলাই`র কাছে গেছে, অমনি ধলাই লুঙি উঠিয়ে মুন্সীর গায়ে সাঁ সাঁ কইরা হিসু কইরা দিছে। সেই হিসু সামলাইতে গিয়া মুন্সীর হাতের গ্লাস থাইকা পানি গেছে পইড়া!
ব্যাস, এইবার ধলাই মহানন্দের নতুন একটা অছিলা পাইছে। খেলারও নতুন একটা মাত্রা পাইছে। কেউ ধলাই`র কাছে ভিড়তে গেলেই লুঙি উচিয়ে হিসু কইরা ভিজাই দেওয়ার ভয় দেখায়। এরপর মুন্সী বাড়িতে আইসা সেই রাতে পুকুরে নাইমা গোছল কইরা তারপর ধলাই`র বাপের কাছে গিয়ে একখান বড়সড় নালিশ পাড়লেন। এত্ত বড় দামড়ারে অহোনো মুসলমানি করান নাই? এইডা কিছু হইলো মাতবর সা`ব!
তাই তো! ধলাই`র বয়স হইলেও সময়মতো মুসলমানি করানো হয় নাই। এতে অবশ্য মাতুববরের তেমন কোনো দোষ নাই। দোষ সব ধলাই`র। গ্রামে হাজাম আইছে শুনলেই ধলাই কোন ফাঁকে যেন লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু মুন্সী সেই কথায় কাতর হবার লোক না। মুন্সীর সাফ কথা, এই দামড়ার মুসলমানি না করাইলে রোজ কিয়ামতের দিন আপনি কী জবাব দিবেন মিঞা?
মাতবর জিগাইলো, তাইলে উপায়?
জবাবে মুন্সী কইলো, কেসটা আমার হাতে ছাইড়া দেন। দেহি এই দামড়া ক্যামনে মুসলমানি না কইরা থাকতে পারে!
পরের সপ্তাহে মুন্সী আমাগো মতো চ্যাংরা পোলাপাইনদের লইয়া একটা গোপন মিটিং করলেন। মিটিংয়ের সারমর্ম মোটামুটি এইরকম, মুন্সী হাজাম লইয়া জব্বার মিঞার কাচারিতে অপেক্ষা করবেন। আমরা যেন ধলাইরে যুতমতো ধইরা আটকাই। এমনিতে ফাল্গুন মাস ছাড়া গ্রামে কেউরে মুসলমানি দেওয়ার রেওয়াজ নাই। তখন মাত্র কার্তিক মাস। সেদিন আবার আমাগো ইশকুল ছুটি। আমরা সকাল সকাল মুন্সীর বুদ্ধি মতো খালপাড়ে মাছ ধরার ভান করতে লাগলাম। যথারীতি ধলাই সেখানে মাছ ধরা দেখতে হাজির। আমরা চোখেচোখে নিজেরা ইসারায় কথা কইলাম। তারপর সুযোগ মতো ধলাইরে পাকরাও করতে চারদিক থেকে ঘেরাউ করলাম। কিন্তু রোকন্যাই`র একটু ভুলের কারণে ধলাই রোকন্যাইরে চিৎপটাং কইরা দিছে ছুট।
তারপর ঘণ্টা দেড়েক ধলাইরে ধাওয়া কইরা চাঁনমিঞার মরিচ ভিটায় আমরা হারামজাদারে কুপোকাত করলাম। পারলে আমরাই তখন ধলাই`র মুসলমানি কইরা দি। কিন্তু আমরা ওই কামে কেউ পারদর্শী না। তাই ধলাইরে চ্যাংদোলা কইরা ধইরা মাতবরের উঠানে আইনা ফেলাইলাম। আমাদের তখন উৎসাহের শেষ নাই। মুন্সীও তখন সেখানে যথারীতি হাজাম লইয়া হাজির। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, গোটা গ্রামের মানুষ ততক্ষণে মাতুববরের উঠানে ভিড় করেছে।
মুরব্বি গোছের কে যেন কইলো, হারামজাদারে আচ্ছামতো চুবাইয়া গোছল করা। কিন্তু সেই রিস্ক কেউ আর নিতে চায় না। আবার যদি ধলাই ছুইটা যায়। মাতুববরের উঠানেই বালতি ভইরা পানি আইনা ধলাইরে গোছল করানো হলো। গোটা বাড়িতে পোলাপাইনের চেয়েও মাইয়া মাইষের ভিড় যেন আরো বেশি। সবাই দামড়া ধলাই`র মুসলমানি দেখতে আইছে। হাজাম ব্যাটা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে কইলেন, কেউ একটা মশারি দেন।
যথারীতি মশারি আসলো। হাজাম সাহেব বাঁশের ছুড়ি, পোড়া কাপড়, সাদা কাপড়, কলার পাতা, পান পাতা সব নিয়ে ততক্ষণে রেডি। চারজন মশারির চারকোণা ধরলো। চারজনে মশারির ভেতরে ধলাইরে চার হাতপা চ্যাংদোলা কইরা ধরলো। একটা কাঠের ছোট্ট চৌকির উপর ধলাইরে বসানো হইছে। ধলাই`র দুই হাত দুই পায়ের নিচ থেকে প্যাঁচ দিয়ে এমনভাবে ধরা হলো যে, দামড়া ধলাই`র আর নড়নচড়নের বালাই নাই। অনেকটা কোরবানির গরু জবাই দেবার মতো ধলাই তখন ভারি অসহায়। ধলাই`র চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। ধলাই`র ঠিক সামনে হাজাম সাহেব পিঁড়ি পেতে বসলেন। টিপুর বাপ দুই হাতে দুইটা পান নিয়ে ধলাইর চোখ চেপে ধরলো। এইবার আর হারামজাদা কই যায়!
কয়েক মিনিটের মধ্যে ধলাই চিৎকার কইরা উঠলো, শুয়ারের বাচ্চা, তোর মায়রে বাপ!
আমরা যারা মাতবরের উঠানে খাঁড়াই এই আড়ং দেখছিলাম, ততক্ষণে বুইঝা গেছি, ধলাই দামড়ার কম্ম খতম!