রেজা ঘটকের গদ্য ‘বইমেলা থেকে ফিরে খুচরা প্যাচাল’

প্রকাশিত : মার্চ ০৩, ২০২২

বইমেলা কোনোভাবেই বারোয়ারি মেলা নয়। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পীঠস্থান। সেখানে হবে লেখক, প্রকাশক, শিল্পী ও পাঠকদের মিলনমেলা। এটাকে অনেকে বারোয়ারি মেলার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। যারা বই কিনবে না, বই নিয়ে কথা পর্যন্ত বলবে না, বই নিয়ে কোনো ধরনের আগ্রহই দেখাবে না, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে অযথা ভিড় করবে, তাদের আমি বইমেলায় দেখতে চাই না।

এই যে ছুটির দিনে বইমেলায় কয়েক লাখ মানুষ যায় মেলা দেখতে, কেউ বইয়ের জন্য যায় না। আজব একটা দৃশ্য। বইমেলা থেকে বের হবার সময় গড়ে দুই তিন শতাংশ মানুষের হাতেই কেবল আমি বই দেখি। বাকি যারা তারা যায় আদতে ঢাকা শহরে একটি ঘোরার জায়গায় কিছুটা সময় কাটাতে, বইমেলায় ঘুরতে। বইমেলা কোনো ঘোরার জায়গা নয়। এখানে বই সংক্রান্ত কারবারি হবে। লেখক-পাঠক-প্রকাশক আড্ডা হবে। বই সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার থাকবে।

যাদের বই নিয়ে কোনো আগ্রহ নাই, তাদের আমি বইমেলায় দেখতে চাই না। এই লোকগুলো ফাও ফাও মেলায় ঢুকুক, আমি চাই না। বইমেলায় স্মারক টিকিট চালু করা হোক। দশ টাকার স্মারক টিকিট কেটে সবাই মেলায় ঢুকবে। কোন বছর কোন ডিজাইনের স্মারক টিকিট, সেটা তখন আমরা ডাকটিকিট সংগ্রহের মতো নিজেদের সংগ্রহে রাখতে পারি। বাংলা একাডেমি এই স্মারক টিকিটের নম্বরগুলো লটারি করে বিজয়ীদের মধ্যে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার বই পুরস্কার হিসেবে দিতে পারে। প্রতিদিন লটারি বিজয়ী অন্তত ১০১ জনকে বই পুরস্কার দেওয়া হোক। এই ১০১ জন মানুষ বই পুরস্কার হিসেবে পেয়ে বই পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এভাবে আমরা একটি বই পড়ুয়া সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ বইমেলায় যায়, কিন্তু বই ছুঁয়েও দেখে না এমন মানুষের সংখ্যাও কয়েক লাখ। তাদের উপস্থিতি বইমেলায় আমার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এসব খামাখা ভিড় এড়িয়ে আমার পক্ষে ভালো বই খুঁজে দেখার আনন্দটুকু নষ্ট হয়। ভালো বই খুঁজে দেখা আমার একটি নেশার মতো কাজ। সেই কাজে সবচেয়ে বড় বাধা এই বারোয়ারি দর্শক।


বইমেলার মাঠের আয়োজন এত বড় করার প্রয়োজনীয়তাও আমি দেখি না। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রকাশনা সংস্থার কোনো দরকার দেখি না। প্রকাশনা একটি শিল্প। এই শিল্পের মর্যাদা যিনি বোঝেন না, তার প্রকাশক হওয়ার কোনো দরকার নাই। সে আমার কাছে সমাজের জন্য বোঝা। সে এই সাজানো বাগান নষ্ট করা মানুষ। প্রকাশনা শিল্পকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই টিকিয়ে রাখতে চাই, আমাদের প্রফেশনাল হতে হবে। সারা বছর বই প্রকাশ করতে হবে। ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক বই প্রকাশ বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক প্রকাশকের প্রফেশনাল সম্পাদনা পরিষদ থাকতে হবে। যাদের সম্পাদনা পরিষদ থাকবে না, তারা বইমেলায় অংশ নেবার অযোগ্য হবে, এমন নীতিমালার বাস্তবায়ন চাই।

আজকে আমি বইমেলায় কয়েকজন আইসক্রিম বিক্রেতার সাথে কথা বলেছি। বইমেলার মাঠে তারা বাংলা একাডেমিকে আট ফুট বাই আট ফুট জায়গার জন্য দেড় লাখ টাকা করে ভাড়া দিয়েছে। তারা সবাই দাবি করেছেন, তারাও বইমেলায় প্রকাশকদের মতো জায়গা ভাড়া নিয়েছেন বাংলা একাডেমি থেকে। এই যে বাংলা একাডেমি বইমেলার জন্য প্রকৃত অর্থে যা প্রয়োজন তা নিয়ে কোনো আয়োজন নাই, কোনো কাজ নাই, কিন্তু বইমেলাকে ঘিরে নানান কিসিমের ব্যবসা পেতে বসেছে, এটা আমাদের বইমেলার জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতির কারণ। বাংলা একাডেমি কোনো সরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, যে ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বইমেলা আয়োজনের নামে বারোয়ারি ব্যবসা করবে।

বাংলা একাডেমির কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। বইমেলা আয়োজন করা মোটেও তাদের কাজ নয়। তাদের কাজ গবেষণা করা। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাথে বাংলা ভাষার যোগসূত্র ঘটানো তাদের কাজ। কিন্তু এখানে সেই কাজটি যথাযথভাবে হচ্ছে না। তারা ১১ মাস সরকারি বেতন তোলে আর ঝিমায়-ঘুমায়। কখন ফেব্রুয়ারি মাস আসবে সেই অপেক্ষায় শীতনিদ্রায় কাটায়। ফেব্রুয়ারি আসলেই তখন তারা এসব বারোয়ারি ব্যবসা করবে। তখন একাডেমির কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ডাবল, বোনাস ডাবল, একটা রমরমা ব্যাপার স্যাপার।

বইমেলার আয়োজনের দায়িত্ব দেশের প্রকাশকদের হাতে দিতে হবে। বাংলা একাডেমিকে তাদের গবেষণা কাজে ফিরে যেতে হবে। যদি তারা সেই কাজ না করে কেবল অমর একুশে বইমেলা নিয়ে সারা বছর অপেক্ষা করে, তাহলে বুঝতে হবে এখানে নানান কিসিমের ব্যবসাপাতি আছে। বাণিজ্য আছে। অমর একুশে বইমেলার নামে বাংলা একাডেমি ব্যবসা করতে পারে না। সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে নীতি নির্ধারণী মহলে নতুন করে আলাপ আলোচনা করা। বাংলা একাডেমি কী কী কাজ করবে আর কী কী কাজ করবে না, সেসব নীতিমালা গোটা জাতির সামনে প্রকাশ করা এখন জরুরি। বইমেলার আয়োজকের দায়িত্ব নিয়ে একাডেমি বছরের বাকি এগারো মাসের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এটা ৫০ বছর ধরে চলতে পারে না। এর অবসান হওয়া জরুরী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বাংলা একাডেমির কী কী দায়িত্ব তা নতুন করে জাতির সামনে প্রকাশ করা হোক। বইমেলার গোটা ব্যাপারটি প্রকাশকদের কাজ। সেখানে বাংলা একাডেমির কার্যত কোনো কাজ নাই। উদ্যানের ভাড়া কেন বাংলা একাডেমি নেবে? এটা যাবে সরাসরি সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটা সমন্বয় করবে। হ্যাঁ, বাংলা একাডেমিকে ভালো বইয়ের খবরদারির দায়িত্বটুকু দেওয়া হোক। প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলা শেষে একাডেমি তিন মাসের মধ্যে যাচাই বাছাই করে ১০০টি ভালো বই নির্বাচন করুক। প্রয়োজনে ওই ১০০টি ভালো বইয়ের প্রকাশক ও লেখকদের একাডেমি পুরস্কার প্রদান করুক।

বইমেলার নামে বাংলা একাডেমির পুলিশিং মোটেও দেশের লেখক-প্রকাশকদের পক্ষে নয়। পৃথিবীর কোথাও এরকম একাডেমি বইমেলার আয়োজন করে না। বইমেলার আয়োজন করে প্রকাশকদের সম্মিলিত সংগঠন। এসব বিষয় নিয়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা