রেজা ঘটক
রেজা ঘটকের গদ্য ‘ডোডোর গল্পের পেছনের গপ্পো’
প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২৪
তখন ঢাকায় কোভিড-১৯ এর সময় চলছে। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হলো। রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করা হলো ২৩ মার্চ। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। লকডাউন চলছে। এমন সংকটে কীভাবে বাঁচব, কোনো উপায় দেখছি না।
সন্ধ্যায় উজ্জ্বল আর আমি লকডাউন পর্যবেক্ষণ করতে বের হয়েছি। ইস্টার্ন প্লাজার সামনে কলাবাগান থানার পুলিশ আমাদের গতি রোধ করলো। আমরা বললাম, হাতিরপুল কাঁচাবাজারে যাচ্ছি। পুলিশ আমাদের যেতে দিল। হাতিরপুল সিগন্যালে বাজারের রাস্তা বাঁশ দিয়ে প্রতিরোধ করা হয়েছে। সেখানে নিউ মার্কেট থানার পুলিশ বসে আছে।
আমরা বললাম, কাঁচাবাজার করতে আসছি। সুতরাং পুলিশ আমাদের আর আটকালো না। আমরা বাজারে কিছু জিনিসপত্রের দাম যাচাই করলাম। তারপর কিছু শশা আর গাজর দুটি পলিথিন ব্যাগে নিয়ে, তার মধ্যে পানি ঢেলে আমরা হাঁটা ধরলাম। আমরা শশা আর গাজর খাই। গপ্পো করি আর হাঁটি। কাঁটাবন মোড় থেকে আমরা লেফট টার্ন করে শাহবাগের দিকে হাঁটা ধরি। একদম ফাঁকা রাস্তা। আমরা ঠিক করলাম রোজ সন্ধ্যায় এরকম সময় আমরা হাঁটতে বের হব।
পরীবাগের রাস্তায় (গুণ`দা যেটাকে নাম রেখেছেন `লাভ রোড` আর আমরা বন্ধুরা ওটাকে বলি `আহমাদ ছফা রোড`) শাহবাগ থানার পুলিশ আমাদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এরপর আমরা হাঁটি আর পুলিশের গাড়িটা আমাদের পেছন পেছন চলা শুরু করল। একদম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের রাস্তার মুখ পর্যন্ত পুলিশের গাড়ি আমাদের পেছন পেছন অনুসরণ করল। আমরা গলিতে ঢুকে বুঝতে পারলাম, সামনের দিনগুলোতে এটুকু হাঁটাহাঁটি করাও কঠিন হয়ে যাবে।
মামুন মামুর দোকান থেকে কয়েক দিনের সিগারেট নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে স্নান করি। সাবান দিয়ে গোটা শরীর কয়েক দফা ঘষামাজা করি। মুখে হাত লাগলে বাথরুমে গিয়ে আবার ওয়াশ করি। নিজের হাতকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হওয়া শুরু হলো। কিছু একটা ধরলেই হাত ধোয়ার একটা বাতিক শুরু হয়েছে তখন। কী করব নিজের হাতকে পর্যন্ত বিশ্বাস হচ্ছে না। এই বুঝি হাতের ভেতর দিয়ে শরীরে করোনার ভাইরাস ঢুকে যায়!
সে এক অবিশ্বাস্য সময়। সে এক কঠিন পৃথিবী। সে এক চিন্তাময় সময়। সে এক করোনা মহামারি কাল। বাঁচার কোনো আশা দেখি না। চিকিৎসা হাসপাতাল এসব তো পরের হিসাব। কে কারে কখন নিয়ে হাসপাতালে যাবে! কার থেকে কার করোনা হবে সেই অবিশ্বাস সারাক্ষণ কুড়ে কুড়ে খায়। আমরা দূরত্ব বজায় রেখে টুকটাক গলিতে বের হবার কৌশল করলাম। কিন্তু কার থেকে যে কে ভাইরাস নেব, সেই হিসেবে কোনো আস্থা ও বিশ্বাস হয় না। সারাক্ষণ এক কঠিন সন্দেহ। নিজেকে সন্দেহ। অন্যকে সন্দেহ। করোনা ভাইরাস কখন ধরে বসে কিচ্ছু বলা যায় না। একবার ধরলেই খেইল খতম!
আমি স্থির করলাম, এই সময়টা ঘরে বসে কাজে লাগাতে হবে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ! কিন্তু মনেপ্রাণে কোনো কনফিডেন্স কাজ করছে না। মনকে মিথ্যা এক সান্ত্বনা দিয়ে জীবনকে ফাঁকি দেবার মতো করোনা ভাইরাসকে ফাঁকি দেবার চেষ্টায় রত তখন। ঘরে বসে কী কী কাজ করা যায়, এসব নিয়ে কয়েক ঘণ্টা পার করলাম। করোনা ভাইরাসকে আমি মনে মনে বিশ্ববিদ্যালয় ভাবা শুরু করলাম। জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো। নিজেকে করোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভাবতে শুরু করলাম।
শেষরাতের দিকে আমি `ডোডোর গল্প` লিখতে শুরু করলাম। গল্পের একদম মূল ভাবনাটা একটা স্টাকচার আকারে প্রথমে লিখলাম। গল্পটা যতবার পড়ি ততবার এটা একটু একটু করে বড় হতে লাগল। পরদিন উজ্জ্বলকে গল্পের কথা বলি। উজ্জ্বল বলল, লিখতে থাকুন। পরদিন লিখলাম একটা শর্ট ফিল্মের চিত্রনাট্য। `ওয়েটিং ফর সান ডে`।
ঘরে বসেই `ওয়েটিং ফর সান ডে` কীভাবে বানানো যায় সেই বুদ্ধি করতে থাকলাম। জেদ্দায় তখন রিন্টু ভাই। রিন্টু ভাই প্রায়ই রাতে ভিডিও কল দিয়ে আমার সাথে কথা বলেন। রিন্টু ভাইকে একটা চরিত্র দিলাম। শর্ত হলো- যার যার অভিনীত অংশ সে নিজে অথবা কাউকে দিয়ে মোবাইল ফোনে শ্যুট করে আমাকে পাঠাবে। আমি ঘরে বসে টুকরো টুকরো জোড়া দিয়ে শর্ট ফিল্মটা বানাব।
রিন্টু ভাই তার পার্ট শ্যুট করে ফুটেজ দিলেন। ওটা আমি এডিট শুরু করলাম। এরপর মিজানকে বললাম। মিজান একটি চরিত্র শ্যুট করে পাঠালো। আমি ভয়েজে কিছু কারেকশন দিলাম। মিজান আবার শ্যুট করে পাঠালো। ববিকে বললাম কুয়াকাটার কিছু আউটডোরের শট দিতে। ববি কিছু শট পাঠালো। সেলিমকে কিছু শট দিতে বললাম। সেলিম কিছু শট দিল। সেলিমের মেয়ে সাঁজবেলা একটা ক্যারেক্টার করবে। প্রণব সেলিমের বাসায় গিয়ে সেই অংশ শ্যুট করবে। এভাবে `ওয়েটিং ফর সান ডে` শর্ট ফিল্মের কিছু শ্যুট হলো লকডাউন পর্বে।
ফয়সল একজন মাস্টারের চরিত্র করবে। পিয়েতা মোবাইলে শ্যুট করে দেবে। কিন্তু ফয়সলের মোবাইলে ভালো ভিডিও হচ্ছে না, এমনটা আমাকে জানালো। রিমুকে একটা চরিত্র করতে বললাম। রিমু যা ব্যস্ততা দেখাল। বিশাল ব্যস্ত তিনি। এভাবে শর্ট ফিল্ম `ওয়েটিং ফর সান ডে` কিছুটা কাজ হয়ে তারপর আটকে থাকলো।
হাতে কোনো টাকা নাই তখন। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রিয় আনিস ভাই একটা কাজ দিলেন বাংলা টাইপ করার। তা করে দিলাম। আনিস ভাই বিকাশে টাকা পাঠালেন। লিকু ফোন করে জানতে চাইলেন, রেজা ভাই আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে? কইলাম আমার নম্বরটা বিকাশ করা। কেন টাকা পয়সা দিবি নাকি। লিকু হেসে হেসে কইলো, না জাস্ট জেনে রাখলাম।
সে রাতে রিন্টু ভাই জেদ্দা থেকে আমাকে একটা কাজ দিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `তাসের ঘর`কে চিত্রনাট্য করার। তাসের ঘরের গল্প ঠিক রেখে সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্ব যুক্ত করে ক্যারেক্টার ডেভলপ করলাম। যতটুকু লিখি, রিন্টু ভাইকে পড়ে শোনাই। ভিডিও কলে রিন্টু ভাই ফিডব্যাক দেন।
পরদিন আমার বিকাশে কিছু টাকা আসলো। লিকু ফোন করে জানতে চাইল, রেজা ভাই আপনার বিকাশে কোনো টাকা গেছে। আমি চেক করে কইলাম, হ্যাঁ। কে টাকা দিলো রে লিকু? লিকু মুচকি মুচকি হাসে। কইলো, টাকা লাগলে আবার পাবেন। রহস্য রেখেই লিকু আলাপ শেষ করলো।
এরপর লেখা শুরু করলাম `ফলিং দ্য ট্রুথ`। একটা ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্য। এটা লিখলাম সরাসরি ইংরেজি ভাষায়। সিনেমার লোকেশান চারটি ভীনদেশে। কলাম্বিয়া, গুয়েতেমালা, ম্যাক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আমি ডোডোর গল্পের চিত্রনাট্য করা শুরু করি। আর ঘরে বসে অ্যাডব প্রিসিয়ার প্রো-তে এডিটিং প্রাকটিস করি।
করোনাকালীন সময়ে ঘরে বসে বসে অনেক কাজ করেছি। চারটি ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখেছি। সাতটি শর্ট ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখেছি। বেশ কিছু সিলেক্টেড বই পড়েছি। তার মধ্যে আলবেয়ার কাম্যু`র `দ্য প্লেগ` পড়েছি পাঁচবার। প্লেগের মতো করোনা ভাইরাস নিয়ে কিছু একটা লেখার ইচ্ছা তখন। কিন্তু গল্পটা কী হবে মাথায় আসে আবার আসে না। গল্প ধরা দেয় না।
তখন করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস নিয়ে যত ধরনের গবেষণা রিপোর্ট পাই, তা পড়া শুরু করলাম। আর লিখতে শুরু করলাম, `সত্য বলা যাবে না`। হযরত আলী দাদু কিছু অ্যাডভান্স টাকা দিয়ে বললেন, এবার আমাকে একটা বই দেন। পরের বছর `সত্য বলা যাবে না` মুক্ত গদ্যের বই আকারে প্রকাশ পেল পাললিক সৌরভ থেকে।
করোনা ভাইরাস আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। আমার কাছে করোনা ভাইরাস একটা আস্ত বিশ্ববিদ্যালয়। গোটা পৃথিবীর মানুষকে অনেক কিছু শিখতে বাধ্য করেছে করোনা ভাইরাস। ধরিত্রীর পরিবেশ করোনা কালীন সময়ে আবার ভারসাম্য পেতে শুরু করলো। মানুষের হাত থেকে পরিবেশ ধ্বংস কিছুদিন তখন বন্ধ থাকলো। করোনা ভাইরাস কন্ট্রোলে আসার পর আবার আমরা দলবেধে পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলাম!
১৬ মে ২০২৪