রেজা ঘটকের কলাম ‘আমরা আদতে এখন এআই এলিয়েন’
প্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০২৩
আমরা এমন একটি সমাজে বড় হয়েছি যখন আমাদের ছোটবেলায় আউটবুক পড়া এক ধরনের অপরাধ ছিল। ক্লাশের বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়লে তাদের নিয়ে নানান কিসিমের কানাঘুষা হতো। পোলাপান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কানাঘুষায় আউটবুক পড়া বন্ধ না হলে সরাসরি চোখ রাঙাতো মুরব্বিরা।
এরপর একাডেমিক পড়াশুনায় আসলো `এসো নিজে করি` যুগ। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেদিন থেকেই ধ্বংসের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে আসলো এমসিকিউ। পোলাপান আর পুরো বই পড়ে না। কাউরে কিছু জিজ্ঞেস করলে কয়, চারটা সম্ভাব্য উত্তর কও, একটা কইতাছি! তারপর দেশে আসলো মোবাইল ফোন।
মোবাইল ফোন চালু হবার পর পড়াশোনা জিম্মি হয়ে গেল মোবাইলের কাছে। তারপর চালু হলো স্যোশাল মিডিয়া। আর ঠেকায় কে। পড়াশোনা পুরোটা চলে গেছে মুঠোফোনের বাটনের মধ্যে। তারপর মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পর পড়াশুনার ষোলকলা খোয়া গেছে। খোয়া গেছে না বলে গোয়া মারা গেছে কইলে আবার একদল পণ্ডিত তেড়ে আসবেন! কইবেন, তোমার চোপা খারাপ!
ভাই, পড়াশুনা না করলে তো চোপা খারাপ হবার কথা! এখন পোলাপান এক জায়গায় হইলে নিজেরা আড্ডা না মেরে মুঠোফোনে ফেসবুক গুতায়। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যতটা ক্ষতি করেছেন তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করেছে এই মুঠোফোন আর স্যোশাল মিডিয়া।
তার মধ্যে আমরা হয়ে গেলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবার সকল তথ্য ডিজিটাল করা হচ্ছে। তার মধ্যে খবর আসলো সকল ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস। গোয়া মারা সারা। আপনার ন্যাশনাল আইডি নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল, ফিঙ্গার প্রিন্ট, চোখের মণি`র প্রিন্ট সব অন্য মানুষের কাছে। আপনার ডিজিটাল ব্যাংকিং এখন সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে।
আর এখন চলছে এআই যুগ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন আপনার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আপনি মনে মনে ভাবেন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা। এআই আপনার কম্পিউটারে কিংবা আপনার মুঠোফোনে সেসব জিনিসের বিজ্ঞাপন দেখাবে।
আপনি কলা খাবার কথা ভাববেন, আপনার সামনে কলার বিজ্ঞাপন আসবে। আপনি গোগল স্কলারে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর সার্চ করবেন, পৃথিবীর সেরা স্কলারদের গবেষণা আপনার মেইলে এসে জমা হবে।
আমাদের যুগে আমরা একটা চরম মহামামি কোভিড-১৯ দেখেছি। কোভিড-১৯-এর সময় আমি সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। দিনে অন্তত ১০ ঘণ্টার বেশি পড়াশোনা করতেই ভালো লেগেছে। তারপর স্বল্প সময়ে টিকা আসলো। টিকা দেবার পর কোনো বিষয়ে বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। অস্থির লাগে। টিকা আমাদের পুরোপুরি গোয়া মেরে দিছে।
হয়তো যারা টিকা নিছে তারা একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এই পৃথিবীর সবকিছু থেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। খাইতে ভালো লাগবে না। ঘুমাইতে ভালো লাগবে না। আড্ডা ভালো লাগবে না। পড়তে ভালো লাগবে না। ধীরে ধীরে আমরা সবাই এলিয়েন হয়ে যাচ্ছি।
মানুষ কী সত্যি সত্যি এলিয়েন?
খেয়াল করে দেখুন, যারা এই পৃথিবীর বাসিন্দা, অন্যান্য সকল প্রাণি, তারা কেউ খাবার সংরক্ষণ করে না। ক্ষুধা লাগলে তখন শিকার করে। আর আমরা? মানুষ খাদ্য সংরক্ষণ করার নানান কিসিমের উপায় বের করেছে। দেখুন অন্য প্রাণিদের শিকার করার জন্য শরীরে প্রয়োজনীয় রসদ আছে। কিন্তু মানুষের নাই।
তাহলে মানুষের কী আছে? এককথায় বুদ্ধি। মানুষের আছে বুদ্ধি। চুরি করার বুদ্ধি। বাটপারি করার বুদ্ধি। বিদেশে টাকা পাচার করার বুদ্ধি। ভোট চুরি করার বুদ্ধি। কর ফাঁকি দেবার বুদ্ধি। সম্পদ লুট করার বুদ্ধি।
একটা উদাহারণ দেই:
ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বের্লুস্কোনি এসি মিলান কেনার পর রাতারাতি রাজনীতিতে নামলেন। তারপর চারবার সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। কীভাবে টাকা বানাতে হয় সেই দক্ষতা তিনি ছাত্র জীবনেই বারবার দেখিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদের একটি ব্যান্ড দলে ডাবল-ব্যাজ গিটার বাজাতেন। সিলভিও`র গানের গলাও ভালো ছিল। বিভিন্ন নৈশ ক্লাব ও প্রমোদ জাহাজে তিনি পয়সার বিনিময়ে গান গাইতেন।
ছাত্র জীবনে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সেলসম্যানের কাজ শুরু করেন সিলভিও। বিশ্ববিদ্যালয়ে সতীর্থদের জন্য পয়সার বিনিময়ে অ্যাকাডেমিক রচনা-নিবন্ধ লিখে দিতেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি এডিলনর্ড নামে একটি নির্মাণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর মিলানের এক শহরতলীতে বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ করেন। ঐ প্রকল্পে কোথা থেকে সিলভিও টাকা পেয়েছিলেন তা অবশ্য এখনও রহস্য!
এরপর সিলভিও টেলিমিরানো নামে একটি স্থানীয় কেবল-টিভি কোম্পানি চালু করেন। ঐ কোম্পানি শুরুতে শুধু তার নির্মিত বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বা ভবনে টিভি সার্ভিস দিত। একসময় মিলানের কেন্দ্রে তৈরি করেন বিশাল এক টিভি স্টুডিও।
সিলভিও বের্লুস্কোনির মিডিয়াসেট কোম্পানি এখন ইটালির সবচেয়ে বড় মিডিয়া সাম্রাজ্য। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনেকগুলোর মালিকানা এই মিডিয়াসেটের হাতে। ইটালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থা মোন্ডাডোরির মালিকানাও মিডিয়াসেটের। ইতালির শীর্ষ ধনীদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে একজন ফুটবল ফ্যানের দেওয়া একটি স্লোগানের অনুকরণে নিজের দলের নাম দেন ফোরজা ইটালিয়া (এগিয়ে যাও ইটালি)। তারপর তো ইতিহাস। ইতালির চার বারের এই প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের শেষদিকে ক্ষমতা হারান।
২০ বছরে ১০৬টি মামলায় সিলভিও ২৫০০ বার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। ২০১২ সালের অক্টোবরে কর প্রতারণার মামলায় সিলভিও`র চার বছরের সাজা হয়। এছাড়া কোনো সরকারি পদে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু ততদিনে তার বয়স ৭৫ ছাড়িয়ে যায়। ফলে কারাদণ্ডের বদলে তাকে কমিউনিটি সার্ভিসে বিনা পয়সায় সামাজিক বিভিন্ন কল্যাণমুলক কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মিলানের কাছে ডিমেনশিয়া রোগীদের একটি দাতব্য হোমে সিলভিও সপ্তাহে চার ঘণ্টা কাজ করতেন। মিস্টার সিলভিও বের্লুস্কোনি কত কোটি টাকার সম্পদ রেখে গেছেন তা তার পরিবারও ঠিকমত বলতে পারে না। এলিয়েন ছাড়া কি এসব সম্ভব!
পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আমরা সবাই দিনদিন আরও এলিয়েন হয়ে যাচ্ছি। আমরা আদতে এখন এআই এলিয়েন!
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা