রুচির দুর্ভিক্ষ আর একজন হিরো আলম

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২৩

রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানা রকম আলোচনা সমালোচনা বিতর্ক চলছে। হিরো আলমের পক্ষে অনেকে কলম ধরেছেন, কথা বলেছেন। কখনো কখনো তারা এ বিষয়ে দীর্ঘদিনের শিল্পকলার জগতের অবক্ষয় নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেটা খুব সঠিকভাবেই করেছেন। কারণ সেটা মামুনুর রশীদের বক্তব্যের পক্ষেই যায়। মামুন ভাই হঠাৎ করে রুচির দুর্ভিক্ষ দেখছেন আর তারা দেখছেন তা আরো দীর্ঘদিন ধরে। বহুজন মামুন ভাইকে ভুল বুঝেছেন, তার অনেক বক্তব্যের মূল কথাটা বাদ দিয়ে সমালোচনা করেছেন। মামুন ভাই যদি তার বক্তব্য সরাসরি দিতেন, রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে কাউকে না জড়াতেন তাহলে বিতর্কগুলো এভাবে আসতো না। বরং তার বক্তব্য এসময়ের বহু সত্য দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ পেত। খুব স্বাভাবিক তার বক্তব্যর মধ্যে অন্যকে আক্রমণ করা হয়েছে বলেই, তিনি যাকে আক্রমণ করেছেন তিনিসহ অনেকেই মামুন ভাইকে আক্রমণ করেছেন। যদি কেউ অশ্লীল ভাষায় মামুন ভাইকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে থাকেন সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। মামুন ভাইয়ের আক্রমণের প্রেক্ষিতে হিরো আলম নিজে যে উত্তরটি দিয়েছেন সেটা যথেষ্ট পরিশীলিত ও যুক্তিপূর্ণ। হিরো আলমের মনোবেদনা ও অভিমান দুটোই সেখানে আছে। মামুন ভাইর কথার জবাব দিয়েছেন হিরো আলম যুক্তিসঙ্গতভাবে মামুন ভাইকে সামান্য অসম্মান না করে।

 

মামুন ভাই যা বলতে চেয়েছেন, দেখা যাচ্ছে ঠিক সেই ধরনের একটি বক্তব্য দিয়েছেন পঞ্চাশ বছর আগে দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকার জন্য সম্মানিত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন। তিনি কি বলেছেন? তিনি বলেছিলেন, ‘এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ। এ দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’ তিনি তার বক্তব্য দেয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ করেননি। তিনি খুব স্পষ্ট করে সেখানে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুচিন্তার অভাব মানেই সুরুচির অভাব। ভিন্ন দিকে `একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ` কথাটা বলার জন্য সরকার বা কেউ তাকে বলেনি যে, আপনি আমাদের স্বাধীনতাকে খাটো করেছেন। মনে হয় তখন খাটো লোকের সংখ্যা কম ছিল তাই তিনি বেঁচে গেছেন, মনে হয় তখন চেতনাবাজদের বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু বোঝা গেল, রুচির দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়।

 

নানা প্রশ্ন এখন করা যেতে পারে? পঞ্চাশ বছর আগে রুচির দুর্ভিক্ষ দেখেছিলেন জয়নুল আবেদীন। কিন্তু তারপর রুচির দুর্ভিক্ষ কি দূর হয়েছিল? রুচির দুর্ভিক্ষ কি তারপর থেকে পঞ্চাশ বছর ধরেই চলছে? নাকি কখনো বন্ধ হয়েছিল? জয়নুল আবেদীন রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলার পর পঞ্চাশ বছরে কখনো কি তা দূর হয়েছিল? দূর হয়ে থাকলে কারা কবে দূর করেছিল? পুনরায় তাহলে কারা আবার রুচির দুর্ভিক্ষ ঘটালো? বাংলাদেশে কারা রুচি সৃষ্টি করে আর কারা তার দুর্ভিক্ষ ঘটায়? যদি পঞ্চাশ বছর ধরেই রুচির দুর্ভিক্ষ চলে থাকে তাহলে বলা যায় রুচির দুর্ভিক্ষ নতুন করে আরম্ভ হয়নি। দিনে দিনে সেটা বেড়েছে। মামুন ভাই বলেছেন, রুচির দুর্ভিক্ষের উদাহরণ হিরো আলম। কারণ তার সৃষ্টি নিম্নমানের।

 

সম্পূর্ণভাবে আমি মামুন ভাইর সঙ্গে একমত, হিরো আলমের সৃষ্টি নিম্নমানের। কিন্তু হিরো আলম কি কখনো দাবি করেছেন তার সৃষ্টিকর্ম উঁচুমানের? হিরো আলম বাঁচার জন্য তার জনগোষ্ঠীর জন্য বহু কিছু সৃষ্টি করেন এবং তার জনগোষ্ঠী তা গ্রহণ করে। হিরো আলম এভাবেই তার জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় একজন মানুষ। কিন্তু সেখানে হিরো আলমের দোষটা কোথায়? কথাটা সত্যি, ধনীরা আর ভদ্রলোকরা যাদের শোষণ করে হিরো আলম সেই জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছেন। শেক্সপিয়র সেইরকম জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছিলেন, কিন্তু উচ্চমানের শিল্পকলা আর সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সেইজন্য জগৎ বিখ্যাত। হিরো আলম তা পারেননি। পারেননি বলেই তার সৃষ্টি নিয়ে কেউ বড় বড় প্রশংসার কথা বলে না। হিরো আলম নিজেও বলেন না। হিরো আলম তার জনগোষ্ঠীর কাছে তবুও জনপ্রিয়। কারণ তার জনগোষ্ঠীর রুচি বা চিন্তা তার মতোই। ভদ্রলোকরা তাদেরকে এর চেয়ে উঁচুমানের রুচি গড়বার সুযোগ দেয়নি। ভদ্রলোকরা দেশের সম্পদ লুটপাট করে উন্নত জনবিচ্ছিন্ন বহুজাতিক রুচি সৃষ্টির জন্য নিজেদের সন্তানকে লুটপাটের টাকায় পশ্চিমে পড়ালেখা করতে পাঠায়। কিন্তু হিরো আলম যে জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছেন তাদেরকে ভদ্রলোকরা প্রয়োজনীয় শিক্ষাটা দিতে রাজি নয়।

 

কারণ তারা আশা করে হিরো আলমের জনগোষ্ঠী তাদের এবং তাদের সন্তানদের ফুটফরমাস খাটবে। কথায় কথায় উঠতে বসতে তাদের লাথি খাবে, গালমন্দ শুনবে। কিন্তু ভদ্রলোকদের বিচারে আবার এসব গালমন্দ করাটা রুচিহীন কাজ নয়। কিন্তু এই সব মহান ভদ্রলোকরাই শিল্পকর্ম সৃষ্টির সময় এসব নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে বড় বড় গল্প ফাঁদবে, তাদের নিয়ে কাঁদুনি গাইবে, নাটকে তাদের দিয়ে বিপ্লব ঘটাবে; অতঃপর গৃহে ফিরবার সময় গাড়ির চালকের ‘স্যার’ হয়ে বসবেন, গৃহে ফিরে তিনি যে টেবিলে বসে খাবেন সেখানে গৃহকর্মীর তার সঙ্গ বসবার অধিকার থাকবে না। কিন্তু একটু আগে মঞ্চে এই দরিদ্র আর শোষিত মানুষদের বেচেই তিনি সমাজের কেউকেটা হয়েছেন। নিশ্চয় সেইজন্যই তিনি একজন রুচিবান মানুষ। আর হিরো আলম রুচিবান নয়। কারণ হিরো আলম দ্বিচারী নয়।

 

বামপন্থী রাজনীতির মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে চান তেমন একজন প্রশ্ন তুলেছেন, "হিরো আলম কি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, আবদুল করীম, আরজ আলী মাতুব্বরসহ বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যপূর্ণ সৃজনশীল সংস্কৃতির বাহক?" প্রথম কথাটা হলো, সংস্কৃতি এক বিষয় আর শিল্পকলা ভিন্ন বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি আর লালন, আরজ আলীর সংস্কৃতি এক নয়। দুই অর্থনৈতিক পরিবেশে তারা মানুষ, সংস্কৃতি তাই আলাদা হবেই। ভিন্ন দিকে হিরো আলম কি দাবি করেছেন সে রবীন্দ্রনাথ, লালনদের সংস্কৃতির বাহক? বাংলাদেশের শিল্পকলা অঙ্গনে কারা রবীন্দ্রনাথ, লালন আর আবদুল করিমের সংস্কৃতির বাহক? আবদুল করিম শাসকদের পদলেহন করেছেন কখনো? লালন? রবীন্দ্রনাথ অনেকবার করেছেন কিন্তু নজরুল করেননি। বর্তমান আলোচনায় সে বিতর্কটা বড় নয়। বড় বড় সৃষ্টিশীল মানুষরাও শাসকদের পদলেহন করে সে উদাহরণ ইতিহাসে অনেক আছে। কদিন ধরে বাধ্য হয়ে হিরো আলমের কিছু মন্তব্য পড়লাম। তাতে বুঝলাম তিনি কোনো বিপ্লবী নন, নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান শক্ত করার লড়াইয়ে ব্যস্ত। সবাই আমরা কম বেশি সেই লড়াইটা আগে করি। যখন শ্রেণি সংগ্রামের নাটক করি, সবার আগে ভাবি বিপ্লব হোক আর না হোক আমার গাড়ি আর বিলাসভবন কবে হবে। সেটা হয়ে গেলে বিপ্লব না হলেও চলবে।

 

হিরো আলম কিন্তু বলছে না যে, সে শ্রেণিসংগ্রাম করতে চায়। হিরো আলম শ্রেণিসংগ্রাম বিক্রি করে না। শ্রেণিসংগ্রাম করার ভণ্ডামি সে করছে না। নিজেকে কোথাও সে সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে দাবি করেনি। অনেক সময় দেখেছি, তার বক্তব্যে বিনয় আছে এবং যুক্তি আছে। নিজের দুর্বলতাগুলো তিনি খুব ভালো জানেন ও বোঝেন। হিরো আলম সৃষ্টিশীল মানুষ নন; রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল প্রমুখের সৃষ্টিশীল প্রতিভা তার নাই। তাতে কি হয়েছে? বাংলাদেশের বর্তমান শিল্পকলার অঙ্গনের কেউই রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতো সৃষ্টিশীল নন। শেক্সপিয়র যে জনগোষ্ঠীর মানুষ, হিরো আলম ঠিক তাই; কিন্তু শেক্সপিয়ারের প্রতিভার ধারে কাছে নাই সে। বাংলাদেশের কয়জন নাট্যকার শেক্সপিয়ারের ধারে কাছে আছেন? ইবসেন, আর্থার মিলার প্রমুখের ধারে কাছে আছে নাকি কেউ? নাই তো কী হয়েছে? প্রতিভা কখন কীভাবে ধরা দেয় বলা কঠিন। কিন্তু হিরো আলমের মতো সস্তা শিল্পকলার চর্চা সবসময় সবদেশে হয়েছে। হয় বাণিজ্যিক কারণে না হলে মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে। সেগুলো আবার হারিয়ে গেছে। মহৎ শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি সেজন্য বন্ধ থাকেনি। সবকালেই মহত শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে খুব কম। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের রচিত নাটকের কয়টা টিকে থাকবে সেটাই প্রশ্ন ।

 

অনেক নাটক এখনই সবরকম আলোচনার বাইরে চলে গেছে। ফলে হিরো আলমকে দাবার ঘুঁটি বানিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সমস্যা বাড়বে। হিরো আলম মহৎ শিল্প সৃষ্টি না করেও কেন এত আলোচিত? কারণ হিরো আলম যে জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছে তাদের সংখ্যা অনেক, সেটাই হিরো আলমের একটা শক্তি। হিরো আলমের জনপ্রিয়তার পুঁজি। বিরাট একটা জনগোষ্ঠীর সে প্রতিনিধিত্ব করে, সেটাই তার পরিচয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বর্তমানে হিরো আলমের সমর্থক আছে। সেটা এজন্য নয় যে, হিরো আলমের সৃষ্টির তারা ভক্ত। বরং হিরো আলম যে কঠিন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে সেটার জন্য। হিরো আলমের লড়াই তাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। নাট্য জগতের অনেকে সে খবরটাই রাখেন না। রাখেন না বলেই হিরো আলমকে আক্রমণ করার সময় ভাবেনি তার পক্ষ নেবার মতো অনেক লোক আছে। কিন্তু প্রমাণিত সমাজে তার সমর্থক ছিল এবং মামুন ভাইকে তারা প্রতিউত্তর দিতে দেরি করেনি। কারণ সংগ্রামী হিরো আলমের সম্মান রক্ষা তাদের কাছে একটা দায়িত্ব বলে মনে হয়েছে। সব সমাজেই এমন ঘটনা ঘটে।

 

প্রশ্নটা হলো, রুচির দুর্ভিক্ষের সঙ্গে হিরো আলমের সম্পর্ক কোথায়? নাট্যকলার মানুষের কাছে কেন হিরো আলম আক্রমণের শিকার হবেন? তিনি তো নাটকের জগতের লোক নন। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। মামুন ভাই যদি রুচির দুর্ভিক্ষের উদাহরণ টানতে চান, নাটকের জগৎ থেকে টানলেন না কেন? হিরো আলমকেই খলনায়ক বানালেন কেন? হিরো আলমের জন্ম সেদিন হয়েছে। কিন্তু তার আগে কারা রুচির দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছে? তাদের পরিচয় কি পেতে পারি? যখন হিরো আলম ছিল না, তখন রুচির দুর্ভিক্ষ কারা ঘটিয়েছিল? হিরো আলমের নাম উচ্চারণ করা গেলে তাদের নাম উচ্চারণ করা যাবে না কেন? কারা কারা এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী তার একটা হিসাব নেয়া হোক। বাংলাদেশে কারা রুচিমান আর কারা রুচিমান নয়, সেটা বিচারের মানদণ্ড কাদের হাতে? হিরো আলমকে মামুন ভাই আক্রমণ করার পর মামুন ভাইকে অনেক আক্রমণ করেছে। মামুন ভাই হিরো আলমকে যে আক্রমণ করেছে, সত্যি বলতে সেটা মামুন ভাইর মূল বক্তব্যের খুব ছোট অংশ। মামুন ভাই সেখানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। কিন্তু সেই যে প্রবাদ, দুধের মধ্যে একফোটা চোনা....। খুব ঠাণ্ডা মাথায় সেটাও সামলানো যেত, যদি পরে কাউকে আর আক্রমণ না করে মামুন ভাইর মূল কথাগুলো সকলের সামনে আনা হতো।

 

মামুন ভাইর গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোই সামনে আসা দরকার ছিল। কিন্তু বহুজন মামুন ভাইর পক্ষ নিতে গিয়ে জল আরো ঘোলা করেছেন। মামুন ভাইর মূল বক্তব্যের প্রচারের চেয়ে হিরো আলমকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে, মামুন ভাই সম্পূর্ণ সঠিক। তিনি যেন সামান্য ভুল করতে পারেন না। সম্মানিত একজন বলেছেন, মামুন ভাইর সমালোচনা করাটাই নাকি প্রমাণ করে রুচির দুর্ভিক্ষের সঙ্গে আমাদের বসবাস। কী আশ্চর্য! মামুন ভাই ফেরেস্তা নাকি? তিনি কি ভুল করতে পারেন না? তার কি সমালোচনা থাকতে পারে না? মামুন ভাই যখন হিরো আলমকে আক্রমণ করছেন সেটা দোষের নয়, কিন্তু মামুন ভাইর সমালোচনা করলে নাকি রুচির দুর্ভিক্ষ প্রমাণিত হয়। বাহ, এসব কথা বলে এখন আবার নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করা হলো। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কারা অন্যকে বাক্যবাণ ছুঁড়লে রুচির অভাব ঘটে না? কারা কাকে বাক্যবাণ ছুঁড়লে রুচির অভাব ঘটে? মনে হচ্ছে আমরা যেন এখনো বর্ণপ্রথার মধ্যে বাস করছি। ব্রাহ্মণ শূদ্রকে আক্রমণ করতে পারবে, কিন্তু শূদ্র ব্রাহ্মণকে আক্রমণ করলেই মহাপাপ। বহুকাল অনেকে নাট্য জগতের ব্রাহ্মণ সেজে বসেছিলেন। নিজেদের এখনো ব্রাহ্মণ মনে করেন, বাকিদের মনে করেন শূদ্র। অনকটা অন্যায়ভাবেই মনে করতেন তাদের মুখের কথাই আইন।

 

কিন্তু ইতিহাসের নিয়মে অবস্থা পাল্টে গেছে। পুরানো ব্রাহ্মণরা এখন নতুন ব্রাহ্মণের কাছে মার খাচ্ছে, ক্ষমতা ছেড়ে আসতে হচ্ছে। সেখানে রুচির দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলবার সাহস নেই তাদের। তাই যত দোষ নন্দ ঘোষ হিরো আলম। কাকে আক্রমণ করা হচ্ছে? নাট্য জগতের বাইরের একজনকে। মামুন ভাইকে অনেকের সমালোচনা করার কারণ সেটাও। কামাল বায়েজীদ যখন অন্যায়ভাবে বাদ পড়লো কী প্রতিবিধান দিয়েছেন তারা? পুরান ব্রাহ্মণদের আস্ফালন ছাড়া আর ক্ষমতা যে কতটা আছে তা এরই মধ্যে দেখা গেছে। দয়ালাভের মতো একটা পদক লাভের জন্য ছুটছে সবাই। কামাল বায়েজীদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার করার মতো মেরুদণ্ড দেখা যায়নি কারো। ভয়াবহ অন্যায় যখন মেনে নিয়েছেন তারা, সেটাও কি রুচির দুর্ভিক্ষ নয়? যখন জয়নুল আবেদীন মন্তব্য করেছিলেন যদি তখন থেকেই, মানে পঞ্চাশ বছর ধরেই রুচির অভাব চলে আসে, রুচির অভাবের জন্য তাহলে নতুন করে কি আর কাউকে দায়ী করা চলে? পঞ্চাশ বছর ধরেই রুচির অভাব দেখা গেছে নানাভাবে, মহারথীরাই তারজন্য দায়ী। চাইলে শাক দিয়ে সে ইতিহাস ঢাকা যাবে না। দূরে বসে তাদের কাণ্ডকারখানা পুরো জাতি দেখেছে। বরং প্রশ্ন তোলা যায়, সরকার সংস্কৃতির পিছনে এত টাকা ঢেলে এত লোককে পুরস্কার দিয়ে কী লাভ হলো, যদি তারা রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে না পেরে থাকেন।

 

যারা সংস্কৃতি জগতের পুরস্কার পায়নি, তাদের দায় নেই রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করার। দায় নেই হিরো আলমের। হিরো আলম পুরস্কার পাননি। কিন্তু যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের দায় আছে। পুরস্কার পেলেন কিন্তু রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারলেন না কেন? কী কারণে তাহলে নেতৃত্বের জায়গায় বসেছিলেন এতকাল? মামুন ভাই সেদিন তার চমৎকার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে হিরো আলমকে টানতে গেলেন কেন, আমি এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। মামুন ভাই শ্রেণিসংগ্রামের নাটক করেন, তিনি বিপ্লব করতে চান কি সব সুশীল ভদ্রলোকদের নিয়ে? না হলে হিরো আলমের প্রতি তার এত তীব্র ক্ষোভ কেন? তিনি কি বুঝতে পারেন না, তিনি যাদের পিছনে হাঁটছেন তারা কোন শ্রেনির আর হিরো আলম কোন শ্রেণির? মার্কস কেন বিপ্লব ঘটাবার জন্য শ্রেণি প্রশ্নটাকে এত গুরুত্ব দিতেন, বুঝতে হবে। মুখে বিপ্লবের কথা বললেও আমরা অনেকে অন্য শ্রেণিতে অবস্থান করি। হিরো আলমকে সব আলোচনায় কারা টানছে এবং কেন টানছে? মামুন ভাই বলেছেন, হিরো আলমকে একজন একটা গাড়ি উপহার দিয়েছেন, মামুন ভাই তা নিয়েও ক্ষিপ্ত। মামুন ভাই কি কারো কাছ থেকে সামান্য উপহার নেন না? তাহলে হিরো আলমের ব্যাপারে অবাক হবার কি আছে?

 

ভিন্ন আরেকজন বলেছেন, হিরো আলম খারাপ। কারণ স্বর্ণ চোরাচালানকারীর দোকান উদ্বোধন করেছেন। হিরো সমালোচনা করছেন এজন? যখন বসুন্ধরার মালিক পক্ষ ছবি নির্মাণে টাকা দেয়, তখন যারা টাকাটা নেয় তাদের কি সমালোচনা করা হয়? নাকি তাদের টাকা গ্রহণে আপত্তি থাকে? চোরাচালানীর স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করার ডাক পেলে কি আমাদের তথাকথিত নাট্য বা চলচ্চিত্র তারকারা তা বর্জন করতেন? অতীতে কি কেউ বর্জন করেছেন? তাহলে হিরো আলমের ক্ষেত্রে এসব দোষ বলে চিহ্নিত হয় কেন? হিরো আলমের চেয়ে আর কাউকে কি বাংলাদেশে আরো ভয়াবহ খারাপ উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যায়নি? স্মরণ রাখতে হবে, মামুনুর রশীদ ভাইর মূল বক্তব্যের সঙ্গে কেউ দ্বিমত করছেন না। তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে হিরো আলমকে নিয়ে যে বিষোদগার করেছেন এবং তার সম্পর্কে ভালো না জেনেই; সেকারণেই সবাই তার সমালোচনা করছেন। মাসুম রেজা এক বার্তায় সুন্দর বলেছেন, মামুন ভাইর বক্তব্য সঠিক ছিল, তিনি তার সঙ্গে একজনের নাম না জড়ালেই পারতেন।

 

ভিন্ন একজন লিখেছেন, হিরো আলম সাংসদ নির্বাচন করার কারণে তার সব হাঁড়ির খবর নিতে হবে। কারণ সবার রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। খুব ভালো কথা। যদি তাই হয় তাহলে অন্য সাংসদ বা রাজনীতিকদের বেলায় নিচ্ছি কি? হিরো আলমের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই ভদ্র সমাজে আপাতত সে বেমানান, এলিট ক্লাসের সংস্কৃতি তার নেই। হিরো আলম যদি অনেক টাকা কামাই করে কাল সংস্কৃতি জগতের একে ওকে স্পনসর করতে শুরু করেন, তাহলে খুব সম্মানিত মানুষ হয়ে যাবেন। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে, বড় বড় ঋণখেলাপী হয়ে যারা আর্টকালচারকে টাকা দেয় তাদের সবাই ভদ্রসমাজে খুব সম্মানিত। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চাইরা দেখেছি তাদের হুজুর হুজুর করেন। বহু নামিদাদি প্রয়াত অধ্যাপকরা তাদের পিছন পিছন হাঁটতেন। আমাদের আসল সত্য বলার সাহস নাই দেখে হিরো আলমের মতো দুর্বলকে নিয়ে টানাটানি করছি। যখন এই হিরো আলম আরো বেশি ক্ষমতাধর হবেন আমরাই আবার তার পেছনে গিয়ে লাইন দেব।

 

সব শেষে মামুন ভাইর প্রতি আমার সম্মান জানাই এই কারণে, নাট্য জগতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে তিনিই প্রথম রুচির দুর্ভিক্ষ আর রাষ্ট্রের দুর্নীতি ও অনিমের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। তিনি নাট্য কর্মীকে এক নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। নাট্যকর্মীর দায়িত্ব কী এটা নিয়ে তারা সচেতন হবার সুযোগ পাবে। তিনি একটি বক্তব্য দিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, সেকারণেই নানাভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি শুভ সৃচনা। মাসুম রেজা তার পারাপার নাটকের ভিতর দিয়ে এ ব্যাপারে আরো আগেই আরো সুস্পষ্ট প্রশ্ন সামনে এনেছেন। যাদেরকে দায়ী করবার তাদেরকেই দায়ী করেছেন। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্ববহ বিশেষ সংযোজন। মাসুমের নাটক আর মামুন ভাইর মূল বক্তব্যকে মাথায় রেখে নকল শত্রুকে নিয়ে আর মাতামাতি না করে সুরুচির সুচিন্তার পথের বাধা আসল শত্রুর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই আরম্ভ করি।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক