রিফাহ সানজিদার গদ্য ‘কহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট’
প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২৩
জগতে প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব চিন্তা। রয়েছে চিন্তাপ্রসূত দর্শন। বস্তুত দর্শনের ভিত্তিতেই তৈরি হয় মানুষের সম্ভাবনা। এ কারণে পঠন-পাঠনের কোনও বিকল্প নেই। কহলিল জিবরান যারা পাঠ করেছেন তারা জানেন, কী গভীর আত্মোপলব্ধি তিনি তুলে আনেন তার প্রতিটি লেখায়। জিবরানের রচনায় দর্শন ও কাব্য জড়াজড়ি করে আছে।
‘দ্য প্রফেট’ জিবরানের সেরা সৃষ্টি। এ রচনাটি এখনও সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। আমেরিকান-লেবানিজ এ লেখক ও দার্শনিকের এ বইট প্রকাশের প্রায় শতবর্ষ পরেও কেন এত জনপ্রিয়, এর জবাব আছে বইটির ভেতরেই। অরফালেস নামক এক স্থানে সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝে থাকা একজন মনোনীত আর দয়িত নবি ১২ বছর পর ফিরে যাচ্ছেন তার নিজ বাসভূমে।
তার অনুসারীদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় তাদের প্রশ্নোত্তরে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব এক জীবনদর্শন। আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে ধাপগুলো আমরা পেরোই, তা-ই জিবরানের নিজস্ব জীবনবোধের দর্শনে হয়ে উঠেছে আরও বেশি অর্থপূর্ণ। নবির জবানবন্দিতে জিবরান একের পর এক বলে গেছেন কর্ম-জীবন-সম্পর্ক থেকে প্রত্যেকটা সূক্ষ্ম বিষয়ে, বইটি পড়তে গেলে যাবতীয় সহজ কিংবা কঠিন যত ধাপ কিংবা চলমান প্রক্রিয়ার ভেতর একজন মানুষ যায়, সেগুলো হয়ে ওঠে গভীর থেকে গভীরতর।
মানুষের আবেগ-ভালোবাসা আর কর্মকে কহলিল দেখেছেন গভীর সুফিবাদের দৃষ্টি থেকে। নিজ ধর্ম ‘ম্যারোনাইট’ ছাড়াও ইসলামের প্রভাবও ছিল তার লেখায়। সুফিবাদ যে উদার দৃষ্টি রাখে সব কর্মের ব্যাখ্যায়, সেটিই দ্য প্রোফেট পড়লে বারবার অনুভূত হবে। তবু জীবনকে বোঝার জন্যে কহলিলের নিজস্ব যে চিন্তা তা সত্যি সাধারণ একজন মানুষের জন্য অভাবনীয়। অনুসারীরা বিদায়বেলায় নবিকে জীবনের ২৬টি ধাপ নিয়ে প্রশ্ন করে। এর জবাবে নবি তাদেরকে জানান, জীবনের প্রত্যেকটা সত্য শুধু দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। যেমন ভালোবাসা বিষয়ে নবির জবাব, ভালোবাসা কেবল তার নিজের স্বার্থই চরিতার্থ করার মনোবাসনায় থাকে।
ভালোবাসাকে আলাদা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন্ত অনুভূতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জিবরান। তেমনি সন্তান বিষয়ে নবির বলেন, তারা তোমারই, কিন্তু তোমার সম্পত্তি নয়। সমাজের যে একজন ব্যক্তিকে কিংবা তার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নিজের নিজস্ব বোধে বিচার করার প্রবণতা, তা কহলিল তার দর্শনে ভেঙে দিয়েছেন। বারবার এটাই দেখিয়েছেন যে, জীবনের অর্থ আর প্রাপ্তির অর্থ বহু রকম হতে পারে। কোনও কিছুই নির্দিষ্ট নয়। প্রত্যেক অনুভূতির আলাদা প্রতিক্রিয়া রয়েছে, কোনও কিছুই যে শুধু ভালো কিংবা খারাপভাবে আমাদের জীবনে আসে, তা নয়। আর এখানেই এই যে চতুর্মাত্রার চিন্তায় কহলিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা, তা স্পষ্ট।
কহলিলের ভাষ্য, ‘তোমার আনন্দগুলো হচ্ছে তোমারই মুখোশহীন দুঃখগুলো... যত বেশি গভীরভাবে দুঃখকে সইতে পারবে, তত বেশি আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা বাড়বে।’ সুখ-দুঃখ যে একই অনুভূতি, কেবল সময়ের দাবিতে তারা ভিন্নরূপে নিজেকে প্রকাশ করে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কহলিলের ভাষায়। দ্য প্রোফেটের ভাষা কাব্যিক, সম্পূরক শব্দে ভরা, আর তাতে জীবনের মুদ্রাকে শূন্যে ছুঁড়ে বারবার এপিঠ-ওপিঠ দেখিয়েছেন এ দার্শনিক। বইটি পড়লে জীবন ধরা দেবে অন্যভাবে। তবে আগের চেয়ে সহজে। হতাশা আর দুঃখের মানে পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে উৎসাহ দেবে।
সুখের জন্য যারা হা-হুতাশ করে, তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, সুখ আর দুঃখের স্বরূপ। ভেবে দেখুন, সুখই মূলত দুঃখকে সাথে রাখে সবটা সময়। আলাদা করে কোনোটা পেতে চাইলে তা হবে বোকামি। সুখের অপ্রাপ্তিই দুঃখের জায়গা করে দিচ্ছে। ভালো আর মন্দ নিয়ে যদিও সম্পূরক কিছু পাওয়া যায় না, তবে কহলিল বলেছেন, ‘তুমি অসংখ্য উপায়ে ভালো, এমনকি তুমি যখন ভালো নও, তখনও তুমি শয়তান নও।’ মন্দ কে? আর কি, তা নিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তবে ভালোর বিপরীত যে কখনোই মন্দ হতে পারে না, এ-ই হচ্ছে কহলিলের ভাষ্য।
ধর্ম নিয়ে তার দর্শন আরও স্পৃহা জাগায় ভাবতে, ‘তোমার জীবনের প্রত্যেকটা দিন তোমার ধর্ম আর উপাসনালয়, তুমি যখন সেখানে ঢুকবে, তোমার যা আছে সবটা সাথে নিয়েই ঢুকো।’ আর ঈশ্বরের রূপ তিনি খুঁজেছেন প্রকৃতিতে, তার সৃষ্টিতে, তাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে নয়, বরং সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখেছেন তিনি। ১১ বছর ধরে দ্য প্রফেট সম্পাদনা করেছেন কহলিল। তাই জীবনের একেকটি সম্পর্ক আর ধাপ নিয়ে যখন তিনি কাব্যিক উপগাথাটি রচনা করেন, একেক ধাপের প্রত্যেকটা বাক্য সেখানে নিজের অর্থে স্বকীয়তা লাভ করে। তাই, বোঝাই যায় তার চিন্তার ব্যাপ্তি আর স্ফূরণ কতটা গভীর।
কহলিল জিবরান দ্য প্রোফেটে একেকটা বিষয়ে যতগুলো বাক্য বলেছেন, তার সবটাই বিশ্লেষণধর্মী। আর প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে তার নিজস্ব মতবাদে একটা পূর্ণ প্রবন্ধ লেখার মতো ব্যাখ্যাপূর্ণ। লেখকের দর্শন যদি জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়, তবে যাপনের প্রত্যেক ক্ষুদ্রতা হয়ে ওঠে মহান।