রিফাতের রক্তাক্ত শার্ট আমাদের বিব্রত করে

শামীমা জামান

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০১৯

প্রকাশ্য দিবালোকে একটা ছেলেকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলা হচ্ছে। দুজন ছেলে ভয়ংকর হিংস্রতায় কুপিয়ে যাচ্ছে। বাকি ছেলেগুলো কানে হেডফোন লাগিয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করছে। তারা নির্লিপ্ত। স্বাভাবিক। বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো খুনিদেরই লোক। মেয়েটি অথবা আয়েশা আক্তার প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছিল স্বামীকে বাঁচাতে। পারেনি। পারার কথাও না।

অসহায় ফেরিঅলা দাঁড়িয়ে ছিল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঈমানের সর্বনিকৃষ্ট অবস্থায় অবস্থান করে মনে মনে ঘৃণা করছিল হত্যাকারীদের। সে শুনেছে, অন্যায় দেখলে প্রথমে হাতের দ্বারা বাধা দিতে হবে, নয়তো মুখের দ্বারা। আর সেটাও না পারলে মনে মনে ঘৃণা করতে হবে। আর যে মনে মনে ঘৃণা করল সে সর্বনিকৃষ্ট ঈমানদার। বাসার জানালা থেকে ভাইরাল হওয়া ভিডিও করা মানুষগুলোও ঈমান রক্ষা করেছিল। আমরা ফেসবুকনিবাসীরাও নিজ নিজ স্টাটাস প্রসব করে ঈমানি দায়িত্ব শেষ করি।

মেয়েটি পাগলের মতো স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। কেউ একজন লিখলেন, ‘মেয়েটি স্বার্থপর, স্বামী বলেই বাঁচাতে গেছে। অন্য কেউ হলে রাস্তার মানুষের মতোই তার আচরণ হতো।’ হয়তো। কিন্তু ওই ধারালো রামদার এলোপাতাড়ি রক্তাক্ত পরিবেশে নিজের প্রাণের ভয় ছেড়ে স্বামীকে বাঁচাতে যাওয়াও কম সাহসের কথা নয়। মেয়েটিকে ক্রেডিট দেয়া বড় কথা নয়, একটু পরেই ওর দিকে সমাজের, পরিবারের আঙুল উঠতেও দেরি হবে না। কারণ বিয়ের দু’মাস না যেতেই সে স্বামী খেল।

ঘটনার পিছনে তার প্রতি ঘাতক নয়নের প্রেমাসক্তিই দায়ী, এমনটাই নিহত রিফাতের বন্ধু-বান্ধবেরা বলছে। নিরাপত্তার কারণে মেয়েটিকে তার স্বামী রিফাত কলেজে পৌঁছে দিত। বিষয়টি প্রেমিক বাবু নয়নের ভালো লাগেনি। এই ছেলেকে বিপুল পরিমান মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে একাধিকবার, কোপাকুপিও তার প্রথম নয়। সেই হিসেবে এ ধরনের নৃশংস ঘটনার দায় শুধুমাত্র ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক হয় না, রাষ্ট্রের ঘাড়েও বর্তায়। যে রাষ্ট ইয়াবা সম্রাট বদিকে লালন পালন করে। বখে যাওয়া সন্তানের মতো হজ করিয়ে খুচরো, ক্ষুদ্র অপরাধী একরামদের ক্রসফায়ারে দেয়।

বিশ্বকাপের উত্তাল চার ছয়ের ডামাডোলের মাঝে হঠাতই এক রক্তাক্ত শার্ট এসে বিরক্ত করে আমাদের। আমরাতো ভালোই থাকি সব ভুলে। খুন ভুলে। ধর্ষণ ভুলে। আগুন, ট্রেন দুর্ঘটনা সব আমাদের ভুলিয়ে রাখে সাকিব মাশরাফিরা। আমরা বেশ থাকি। আড্ডায়। চায়ের কাপে, কফির চুমুকে ভালো থাকি। জগতের সবটুকু ভালো আমরা ভাসিয়ে দেই নিউজ ফিডে। এর মাঝে এই রক্তাক্ত শার্ট আমাদের বিব্রত করে। আজ সারাদিন এই রক্তাক্ত রিফাতের শার্টের মাঝে জামা কাপড় বিক্রি করতেও আমাদের লজ্জা লাগে।

দুদিন আমরা খুব প্রতিবাদী হবো ফেসবুকের ময়দানে। ফের খেলায় ডুবে যাব। খুনিদের কেউ ধরা পড়েছে। বাকিরাও পড়বে। আবার বেরিয়েও যাবে অচিরেই। এই হত্যাকাণ্ড জেল থেকে বেরিয়েই ঘটিয়েছে নয়ন বন্ড। এই নয়ন বন্ড নিহত রিফাত শরীফকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠিয়ে তার স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক করে, এমন কথাও বলছে প্রত্যক্ষদর্শী কেউ কেউ। ঘটনার আড়ালের ঘটনা যাই হোক, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এইসব ধারাবাহিক ঘটনাগুলো নিয়ে ভাববার প্রয়োজন আছে। টকশো জীবিরা তা ঘাটেনও বটে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠান পর্যন্তই। এই যে একটা প্রজন্ম, নির্বিকার নৃশংস প্রজন্ম, এদের কে তৈরি করল?

কিভাবে ঐশীর মতো একটি কিশোরী মেয়ে বুকের ওপর চেপে বসে বাবা-মাকে খুন করে?  রক্তাক্ত শার্ট তো এই প্রথম নয়। অভিজিতের রক্তাক্ত শার্ট দেখেও আমরা এমনই শিহরিত হয়েছিলাম। খুনীরা জামিনে জীবনযাপন করে যায়। বনানী রেইন ট্রি ধর্ষক সিফাত কোথায়? সেও জামিনে আয়েশ করে খায়েশ মেটায়। সাথে আছেন রাঘব বোয়ালেরা। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রই আমাদের দিয়েছে। শুধু পরিবারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কোনো খুনীর মা-ই তার সন্তান কে খুনী হতে শেখায় না। কিন্তু রাজনৈতিক দল খুনী হতে সাহস যোগায়। আর শক্তি যোগায় এখন ইয়াবা।

আপনি সেই ইয়াবার সাথে সমুদ্রে হাঁটেন রাষ্ট্র, একটা নোবেলের আশায় আপনি রোহিঙ্গা বোনেন ঘরে। বাংলার দামাল ছেলেরা আজ বুঝে গেছে, তাদের সাত খুন মাফ শুধু দলের ছায়াতলে থাকলেই। ক্ষমতার আরশের ছায়া আজ বাংলার ঘরে ঘরে। সবাই আজ রাজা। গ্যাংস্টার। বাকিরা নিরীহ দর্শক। একজন দর্শকের ধারালো অস্ত্রের মুখে এগিয়ে যাওয়া হয়তো কঠিন। কিন্তু দলবেঁধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে গণপিটুনির সংস্কৃতি এক্ষেত্রে ফলপ্রসু হতেই পারে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কিম্বা বিচারহীনতা যখন দেশকে বর্বর রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ, জেগে ওঠা খুবই জরুলি।

এই যে ফেসবুকের হাউকাউ একে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। প্রতিবাদে দ্রুত ধরা পড়ছে অপরাধী। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা প্রতিনিয়ত নতুন ইস্যুতে থাকতে চাই। পুরনো ইস্যু আমাদের টানে না। তাই চাপা পড়ে থাকে তনু, ফ্যালানি, সাগর-রুনী। আর এদিকে আমরা আরামসে টিভি খুলে মাহফুজের বেসুরো গান শুনি।