রিফাত বিন সালামের কলাম ‘ফ্রান্স আবারও পুরনো পথে’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২০

ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ফ্রান্স ছিল অন্যতম। শুধুমাত্র ২০১৯ এর শুরুতেই ন্যাটো ও আফগান সরকার মিলে দেশটিতে যৌথভাবে তালিবানদের চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি আরব যে পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করেছে, তার ৭৩ শতাংশ অস্ত্র এসেছে আমেরিকা থেকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রিটেন। তারা বিক্রি করেছে সৌদিতে মোট আমদানি করা অস্ত্রের ১৩ শতাংশ এবং তৃতীয় স্থানে থাকা ফ্রান্স বিক্রি করেছে ৪.৩ শতাংশ।

এসব অস্ত্রের অধিকাংশই ব্যবহার হয়েছে ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের উপর। ইয়েমেনে বেসামরিক মানুষের উপর সৌদির চলমান আগ্রাসনে ফ্রান্সের অবদান যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং দুনিয়ার বর্তমান চিত্রের জন্য ফ্রান্সের মতো প্রতিটা প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাই দায়ী। ফ্রান্স একদিকে অসংখ্য দার্শনিকের জন্ম দিয়েছে, আবার অন্যদিকে কলোনিগুলাতে গণহত্যাও চালিয়েছে। মাত্র কয়েক দশক আগে আল জেরিয়াতেই কলোনিকালে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫% অর্থাৎ প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ফ্রান্স (অনেকের মতো এ সংখ্যা আরো বেশি/কম)।

ফ্রান্সকে বোঝার ক্ষেত্রে এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। মোট কথা, ফ্রান্স শত শত মহান দার্শনিকের জন্ম দিয়েছে বলেই ফ্রান্স রাষ্ট্র ফেরেশতা হয়ে যায়নি, সে যা করবে তার সবটাই ঠিক করবে, বিষয়টা এমন না। এবারও তারা ভুল করছে। একদিকে যুদ্ধ জারি রেখে আরেকদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না, ফ্রান্স সেই চেষ্টাই করছে। একদিকে অস্ত্র সাপ্লাই করে অন্যদিকে শান্তির বয়ান শোনাচ্ছে। যদিও এসব তথ্যের ভিত্তিতে কোনোভাবেই একজন মুসলমান তরুণের হাতে শিক্ষক সেমুয়েল প্যাটি খুন হাওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করা যায় না। কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স সরকারের অবস্থান সমস্যাজনক।

প্রথমত শিক্ষক সেমুয়েল প্যাটির খুনি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত না। কিন্তু ফ্রান্স সরকার যেভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে, বিশেষ করে মুসলমানরা। চলতি সপ্তাহে প্যারিসে দুই নারীকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে মুসলমান হওয়ার কারণে। দেশটিতে মসজিদ বন্ধের আওয়াজ উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে গণমাধ্যমে ইসলামোফোবিয়ার প্রচার আরো বেড়েছে। ফরাসি মানবাধিকার কর্মী ইয়াসের গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, মুসলিমরা এমনিতেই আক্রমণের হুমকিতে। এখন মি. ম্যাক্রঁ আরো আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। তার এক ঘণ্টার ভাষণে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন এবং কট্টর ডানপন্থী এবং মুসলিম বিদ্বেষী বামপন্থীদের সুরে গান গেয়েছেন।

অথচ সকলের সামনে নিউজিল্যান্ডের উদাহরণ ছিল। ভিন্ন সমাধানও ছিল ফ্রান্সের কাছে। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধেও ফ্রান্স সরকার কাজ করতে পারতো। ২০২০ সালের মার্চে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়া কেন্দ্রিক ঘটনা প্রায় ৫২% বেড়েছে (হামলা, হেটস্পিচ)। অস্ট্রিয়ায় সেটা ৭৪%। জার্মানিতে ৪৪, ইটালিতে ৫৩ এবং ফিনল্যান্ডে ৬২%... অন্যদিকে সৌদিকেন্দ্রিক সুন্নি মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বরাবরের মতোই পশ্চাতমুখি। বাংলাদেশের মুসলমানরাও সৌদি ঘরনার চিন্তা ধারণ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এরাও #বয়কটফ্রেঞ্চপ্রোডাক্ট এর ডাক দিয়ে বসে আছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার হলেও অর্জিত হয় ১ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন। কে কার পণ্য বয়কট করবে তাহলে? পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া সহজ কিন্তু ফ্রান্সের মুসলমানদের কি হবে সেক্ষেত্রে, তা নিয়ে এরা কোনো সমাধান দিতে পারেনি। ইউরোপজুড়ে বেড়ে যাওয়া ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে মুসলমানরা কিভাবে দাঁড়াবে সে নিয়েও কোনো চিন্তায় পৌঁছাতে পারেনি মুসলমানরা। এমনকি অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই একেকটা ফ্যাসিস্ট সরকার বসে আছে ক্ষমতায়, তার বিরুদ্ধেও মুসলমানদের কোনো শক্ত অবস্থান নাই।  

যে কেউ যে কারো কার্টুন আঁকতেই পারে। কার্টুনের মাধ্যমে ভুল বক্তব্যও প্রচার হতে পারে। কিন্তু কার্টুনের বিরুদ্ধে হত্যা কোনো সমাজেই গ্রহণযোগ্য না, সে ফ্রান্স হোক বা বাংলাদেশ। দুনিয়াজুড়ে ইসলামোফোবিয়ার যে উত্থান সেটা শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের অবদান। আবার গলা কেটে হত্যাও পুঁজিবাদের অবদান। রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ ও হত্যা, কোনোটা দিয়েই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব নয়। বিবিসি জানাচ্ছে (৩ অক্টোবর ২০২০), অপরাধ ও জঙ্গি ইসলামের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ততটা শক্ত নন বলে যে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনের আগে তা খণ্ডনে তৎপর হয়েছেন মি. ম্যাক্রঁ।

নতুন আরেক জনমত জরিপ বলছে, তথাকথিত কট্টর ইসলাম রুখতে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত আইনের প্রতি সিংহভাগ ফরাসির সমর্থন রয়েছে। চলমান ঘটনায় আসন্ন নির্বাচনী রাজনীতির প্রভাবও পড়েছে।

লেখক: কাটুর্নিস্ট ও কবি