রাহাত খানের গল্প ‘হে আনন্দ’
প্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২০
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকার বাসাতেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘হে আনন্দ’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
এগারোটা বেজে তিন মিনিটের সময় রকিবুল হোসেনের সবুজ টেলিফোন ভালো একটা খবর ধরল। অনেকদিন থেকে আদায় হতে চায় না, একেবারে আদায় হতে চায় না, এ ধরনের বড় অঙ্কের একটা টাকা আদায় হওয়ার খবর। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অফিসের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ কিবরিয়া হয়া গেছে স্যার, বলল। খেলা জিতে যাওয়ার গলায়। পরে বলল, চেক নিয়া আসতেছি।
রকিবুল হোসেনই ধরেছিল। তার চেম্বারে প্রায় রোজ এ সময় মিটিং বা আড্ডা মতোন হয়। ঘরে বন্ধু দিল হাসান ছিল। কদিন থেকে তার বান্ধবী তাকে খুব ভালো। সময় যুগিয়ে যাচ্ছে। ঘরে আর বসেছিল ম্যানেজার হরিপদ সরকার। টেলিফোনটা চুপচাপ ছেড়ে দিয়ে রকিবুল ভাবে খবরটা কি বেশ একটা চীৎকার দিয়ে উঠে হাসি খুশিতে ফেটে পড়ে তার বলা উচিত ছিল না? সে রকমেরই তো দারুণ সুসংবাদ একটা। কেননা এই টাকাটা পাওয়ার কথা ছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুঝল দেরি হয়ে গেছে। যখনেরটা তখন দিয়ে ফেলা উচিত। এখন চেঁচালে উদ্ভট দেখাবে। খুশিটা যে বানোয়াট তা সবাই বুঝে ফেলবে। ভেতর থেকে আপসে আপ না এলে চেঁচাই কি করে! ওরকম পারে মানুষ?
রকিবুল মনস্থির করতে পারা না পারার মধ্যে ভাবে। পরে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসির সাথে প্রবল আনন্দ বুঝাবার চেষ্টা করে বলে : হয়ে গেছে। হয়ে গেছে’র বৃত্তান্ত ভেঙে বলল। বলাটা তার তেমন খারাপ হচ্ছিল না। আনন্দ না হোক, উত্তেজনার টুকরা-ফাঁকরা বেশ প্রকাশ পাচ্ছিল।
শুনে আগেভাগে চীৎকারটা দিল হাসান। যদিও তার জিনিসটার মধ্যে আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি ছিল। স্বাভাবিক। পড়শি বা বন্ধুদের কেউ লটারি জিতে গেলে, হঠাৎ একদিন বনানী-গুলশানে জমির এলটমেন্ট পেয়ে গেলে বা প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া পি. ডব্লিউ, ডি’র একটা সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার চেক আদায় পেয়ে গেলে এভাবে মানুষের ভেতরে খুব জ্বলুনি-পুড়ুনি হবে না? বেরোবে না গলগল করে কালো ধোঁয়া। চীৎকার ও হাসি কতটাইবা পারে ভেতরের দাগা চাপা দিতে?
দিল হাসান বু চমৎকার পেরেছে বলতে হয়। হাসিটা ভালোই দিল। দাঁত দেখাবার সময় দেখাচ্ছিল আনন্দ বা হাসি-খুশি প্রকাশের মতই বেশ ঝকঝকে। চেঁচিয়ে ওঠাটা ছিল রীতিমতো উঁচুদরের। যাকে বলে উইথ কনফিডেন্স। সে বলছিল আরে, কও কি মিঞা। আরে কও কি মিঞা, দুতিনবার বলল। ক্রমাগত একটা জিনিস ধরে টানলে যা হয়, তার প্রাণবায়ু ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তবু সব মিলিয়ে তার দেখানোটা খারাপ ছিল না।
ভালো একটা পার্টি চাই দোস্ত। মিষ্টিফিষ্টিতে হবে না।
ঠিক আছে, হবে পার্টি।
হবে পার্টি? ফাঁকেলাস। পার্টি হবে? দুর্দান্ত! আমি দোস্ত চিবাস রিগ্যালের নীচে নামব না! কথা দে…
ও ননা প্রবলেম! টপ অব দা ক্লাবে পার্টি হবে।
টপ অব দা ক্লাবে? ফাসকেলাস! দুর্দান্ত…
নো প্রবলেম! টপ অব দা ক্লাবে পাটি হবে।
টপ অব দা ক্লাবে? ফাসকেলাস! দুর্দান্ত…
দুই বন্ধুতে এইরকম হচ্ছিল….! রকিবুল হোসেন জেগে উঠতে চাইছিল দিল হাসানের সাহায্য নিয়ে। যদিও আপসে আপ জিনিসটা আসছিল না। তবু হয়তো আমোদ-ফুর্তির কথা বলতে বলতে, চেঁচাতে চেঁচাতে সেই সুন্দর ঝর্ণা বুকের ভেতর এক সময় বেজে উঠবে। কে জানে। চেষ্টা করে দেখা যাক!
ম্যানেজার হরিপদ প্রকার ‘ব্যাংকে একটা ইনফর্মেশন দিয়ে রাখি’ বলে সরে পড়ে। মুখোমুখি দিল হাসান ও রকিবুল হোসেন। পার্টির কথা শেষ হয়ে তখন দিল হাসানের নিজের কথা। দোস্ত, শি ইজ ফেটাস্টিক। কসম, এরকম আর পাইনি। বলছিল ও মনের থেকে কিছু মণিমুক্তো তুলে আনতে পারছিল। ইংরেজি ও বাংলা শব্দ মিলিয়ে দিল হাসানের দেওয়া জুলেখার চুলের বর্ণনা ভারী সুন্দর। জুলেখা মানেও তো কেশবতী। দিল হাসান বলল যে জুলেখা সত্যি সত্যি দিতে জানে। মহিলা ভারী দুঃখী। এতকাল স্বামীর অবজ্ঞা-অবহেলা শুধু পেয়ে আসছিল। আহা বেচারী। ইচ্ছে করলে রকিবুল একদিন গিয়ে দেখে আসতে পারে। সময়কে আনন্দে ভরিয়ে তোলার দারুণ ক্ষমতা রাখে মহিলা।
রকিবুল শুধু জানতে চেয়েছিলে মহিলাকে দিল হাসান বিয়ে করে ফেলবে কি। গাড়ি করে বাসায় ফেরার সময় আরো মনে পড়ে কাকে যেন রকিবুলও একদা বিয়ে করে ফেলতে চেয়েছিল। অমলা না পারভিন, কে সে?
কারো সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। দূর থেকে রূপে মুগ্ধ হওয়া যাকে বলে। তার গাড়ি বেশ স্পীডে যাচ্ছিল। সে কতদিন আগের কথা। রকিবুলের মনে পড়ে, মধুখালিতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টির কথা। নদীর পাড় ছিল নির্জন। রাচর জুড়ে কুয়াশার মতো জেগে আছে বৃষ্টির রঙ ও ক্যানভাসে সেঁটে থাকা গ্রাম ও গাছপালার সুজ এখানে-ওখানে। নাদেরাই তাকে হাসতে হাসতে অতর্কিতে ধাক্কা দেয়। ব্রহ্মপুত্র নদে বৃষ্টির ঝাঁঝরা হতে থাকার সময় ভেতরের জল ছিল নরম ও উষ্ণ। সেই মধুখালি। সেই বৃষ্টির সময়টা। নাদেরা তারপর নিজেও নদীতে নেমে গৃহহীন হয়েছিল।
তার গাড়ি বিজয় প্রণির উপান্তে এসে লাল সিগনেল পেয়ে থেমে আছে। অফিসে বসে দিল হাসান ও সে কত চেষ্টা করেছিল। হৃদয় নিয়ে কিছুতে জেগে উঠতে পারছিল না। ভেতর থেকে আপসে আপ আসতে চায় না। দিল হাসান তবু বেশ ভালো আছে তার প্রিয় ক্রীড়া নিয়ে। জুলেখা এখন তার লেটেস্ট। সে জুলেখার চুলের বর্ণনা দেওয়ার সময় মনের কিছু কিছু মণিমুক্তো তুলে আনতে পারছিল। একদিক দিয়ে এটা ভালোই। এরকম কিছু একটাতে লেগে লেগে কেমন হয় ভাবতে থাকল সে।
নাদেরার সময় সে কি খুব সপ্রাণ, খুব জাগ্রত ছিল না? হ্যাঁ, খুবই ছিল। তখন রকিবুলের একহারা শরীর। কম বয়সে স্বাই হয়তো ভেতর থেকে সপ্রাণ ও সজীব থাকে। তার বয়স ছিল পঁচিশের কাছাকাছি। নাদেরার বাইশ। নাদেরার মুখ একটু লম্বাটে, পুজ অর্থপূর্ণ ছিল। রকিবুলের কারণে-অকারণে হঠাৎ একেক সময় দৈতের মতো হো হো করে হেসে ওঠা তার খুব পছন্দ ছিল। নাদেরা কখনো কখনো রকিবুলের বুকে মাথা রেখে বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে বলত যে, আমি আর কিছু চাই না। সে অনেকদিন আগের কথা। আজও ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ঝাঁঝরে পড়া বৃষ্টির কথা ভোলা যায় না। আহ্, কী সুন্দর তখন হৃদয়কথা বলে উঠত। পাখি বা নদীর জল যেমন করে কথা বলে ওঠে। তখন, এমনকি এর বহু পরেও, এই তো কিছুদিন আগেও বুঝা যেত বুকের ভেতরে একটা ঝরঝর ঝর্ণা আছে। আনন্দ। একটা গাছে পাতার আড়ালে দশ লাখ একাশি হাজার ফুলের ফুটে থাকা বা ওরকমই কোন ব্যাপার। আহ কি দুর্দান্ত সেই থাকাটা।
তার ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দোতলার কার্নিশের পরে নুয়ে পড়া গাছগাছালি পাশে তার ঘর। দখিনের শেষ। ঘরটা ছেলের জন্য সে-ই পছন্দ করেছে। যোক এতটুকু ছেলে। তাকে নির্দয় সংসারে আস্তে আস্তে একটা পুরুষ মানুষ হয়ে উঠতে হবে। একাল ঘরে থেকে অভ্যস্ত হওয়া দরকার আছে বলে সে মনে করে।
গিয়ে দেখে মুহীবর ঘুমুচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে। দু’হাত ছড়ানো। হাতের কাছে একটা ভোলা বই। অর্থাৎ আল্পর মতো ঘুমুবার আগে বই বা ম্যাগাজিন দেখার অভ্যেস করছে সে। মুহীবরেরটা ছিল নীল পরীর গল্প, রূপকথার বই। মুহীবর আব্দুর মতো হতে চায়। রবুিলের চালাবার প্রিয় গাড়ি হালকা গোলাপী করোলা এক্সেল। মুহীবরের ট্রাই সাইকেলের রং হালকা গোলাপীর কাছাকাছি ঘিয়ে রঙ। রকিবুল রূপালীর মতো কফি খেতে ভালবাসে না। তার প্রিয় পানীয় অবশ্যই চা, সেটা হতে হবে ফ্রেশ ব্লেন্ডিং, দার্জিলিং বা সিলেটের। মুহীবরও তাকে দিতে বলে : চা। রূপালী ধমক দেয় আর বলে ইশ, আব্বর মতো হবে, তোর আব্বর মতো হব। রূপালী হাসতে থাকে আর বলে তোর আবু কার মতো হতে চায় জিজ্ঞেস করে দ্যাখতো।
ছেলেকে দেখে তার ভেতর থেকে চুপসে যাওয়াটার কিছু উপসম হয়। যদিও খচখচ করে একটা কাঁটা বিধছেই। খাওয়ার টেবিলে সুস্থ সমস্ত গৃহকর্তার মতো বসে সে চিংড়িভর্তা দিয়ে একটুখানি ভাত মাখিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে বলল। বলতে পারছিল সহজভাবে। এতক্ষণে সে একটু একটু এনজয় করতে পারছে প্রায় হঠাৎ পড়ে পাওয়া একটা বড় টাকার সুখ। আহ্, যদি দুর্দম খুশি হয়ে উঠতে পারত। পারছে না যে কেন। তবে সবুজ শাড়ি ও লাল জামা পরে আছে। বাইরে কোথাও যাক না যাক, সব সময় মুখে রং-চং মাখা চাই। কথাটা শুনে রূপালী বলে : সত্যি! তার এই সত্যি বলার মধ্যে প্রচুর আগ্রহ উৎসাহ-আনন্দ ইত্যাদি ছিল। হাসছিল রকিবুলের দিকে তাকিয়ে। না, এই হাসি ধার করা বা দিল হাসানেরটার মতো ঈর্ষায় কিছুটা জ্বলে-পুড়ে থাক হওয়া নয়। সহজ-সুন্দর হাসি। রকিবুলের আবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি যে কেন পারছি না। সে চিকেন ও সবজির ফালি দিয়ে কোরিয়ান স্টাইলে রূপালীর রাঁধা ডালের বাটিতে অনেকক্ষণ ধরে চুমু দিতে থাকে। একটু একটু। কখনো ঠোঁট ছোয় কি ছোঁয় না। শেষে তার হাবভাব দেখে তোমার কি খারাপ লাগছে, রূপালী এই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসে।
আজ একটা ভালো দিন। সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার প্রায় আশা ছেড়ে দেওয়া একটা বিল উদ্ধার করা গেছে। একটু এনজয় করা যাক ভেবে সে তার ঝকঝকে সুন্দরী স্ত্রীও প্রিয় দশ ছেলেকে নিয়ে বেরোল প্রিয় করোলা এক্সেলে। ডি. ও. এইচ. এসের প্রসারিত পশ্চিম জুড়ে তার সুন্দর ছিমছাম দোতলা বাড়ি। ছাতের কিছু টালি দেওয়া ইতালীয়ান মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। কাঠের কারুকাজ করা দরজা। তার এই বাড়ি, মাস্টারির চাকরি থেকে ধীরে ধীরে ঢাকার মাঝারি ধরনের বেশ স্বচ্ছন্দ অবস্থার ট্রেডার হয়ে ওঠা, স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে সংসারে থিতু হওয়া ইত্যাদি যোগ করলে দাঁড়ায় একটি গর্ব, একটি অহংকার : রকিবুল হোসেন। হ্যাঁ, নিচে থেকে ওঠে এসেছে বটে। মফস্বলে ছিল, গরিব গেরস্থ বাপের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, ঢাকা এসে আগামসিহ লেনের ধসে পড়া একটি ভাড়া বাড়িতে থাকত, ইত্যাদি। সবই ঠিক আছে। তবে যাই বল, রকিবুল যে হয়ে উঠেছে, এও তো সত্যি কথা। হয়ে ওঠাই বড় কথা। নয়?
কোথায় যাওয়া যায়, স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে। রূপালী বলে যে অনেকদিন গৌতমদার ওখানে যাওয়া হয়নি, গেলে কেমন হয়? অথবা দীদার চাচার ওখানে যাওয়া যায়, টিংকু নাকি স্টেটসে চলে যাচ্ছে! রকিবুলরা কোথাও স্থির করতে না পারলে ক্লাবে যায়। গাড়ি যাচ্ছিল সাভারের দিকে। ঘিয়ে রঙের রোদ ধরে আছে মাথা উঁচু সব গাছপালা। এছাড়া বিল থেকে জলজ উদ্ভিদের ঘ্রাণ মেশা হু হু বাতাস পাওয়া যাচ্ছিল। মুহীবব, খুব এনজয় করছিল। সে ক্রমাগত তার আন্ধুকে জিজ্ঞেস করছিল ব্যাটম্যান নাকি দেড়শ তলা ছাত থেকে পড়ে মারা গেছে? সুপারম্যান কি শেষ পর্যন্ত মার্সের কালো মুখোশ পরা শয়তান চক্রকে খতম করে দিতে পারবে? দোলন বলছিল যে আর দেড়শ বছর পর নাকি দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। ইত্যাদি। রকিবুল উত্তর দেয় আর ফাঁকে ফাঁকে একটা মাঠের ছবি দ্যাখে। একটা মফস্বল শহর থেকে মাইল দুই দূরে নির্জন কতকগুলো শিমুল গাছ। তারপর মাইলের পর মাইল জুড়ে সেই মাঠ। একবার নষ্টচন্দ্রের রাতে এই মাঠে নেমে গিয়েছিল রকিবুল, হাসানুজ্জামান ও শিরীষ চন্দ। তারা তিন বন্ধু। হাসানুজ্জামান এখন মধুখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার। শিরীষ চন্দ যে কোথায়, ইন্ডিয়ার কোন শহরে বা গ্রামে নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কোথায় যে! রকিবুল ছেলেকে উত্তর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই একটা মাঠের ছবি দেখছিল। চাঁদ ছিল আকাশ জোড়া। সেই চাঁদের উদ্দেশে নষ্টচন্দ্রে রাতে রওনা হয়েছিল তারা নি বন্ধু হাসান, শিরীষ ও সে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে। হু হু করে হাওয়া। আর গোল চাদটা ঠিক চোখের সামনে পাঁচহাত দূরে। চাঁদটা প্রত্যেকে তারা ধরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। একেক সময় মনে হচ্ছিল পারা যাবে, এই তো চাঁদ কত কাছে! এই খেলায় চাঁদেরও নিশ্চয়ই সায় ছিল। তা নইলে সারারাত নেচে, গেয়ে, দৌড়োদৌড়ি-হুড়োহুড়ি করে চাঁদ ধরার চেষ্টা কি করত তারা? আর একেবারে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার আনন্দ তারা পাচ্ছিল চাঁদের হাসি-খুশি প্রশ্রয়েই তো? সেই মাঠ। মনে পড়ে খৈ ফোঁটার মতো চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া নষ্টচন্দ্র রাতের সেই মাঠ।
রূপালী একটু চেঁচিয়ে বলে : এ্যাই, তোমার কি খারাপ লাগছে। শুনে একটু ভয় পেয়ে সংযত ও সতর্ক হয় রকিবুল। সাভার না গিয়ে ফিরে আসে বাসায় হাসি খুশি ভাব দেখাতে তো কোন অসুবিধে নেই, রুপালীকে সেই তৈরি করা চেহারা দেখিয়ে যাচ্ছি সে। তাতেও রূপালীর সন্দেহ কাটছে না দেখে রাতে খাওয়ার পর টেলিভিশনে কিছু একটা কতক্ষণ দেখাটেখার পর শোবার ঘরে গিয়ে রকিবুল বলে? আচ্ছা রূপূ, তোমার কাছে কোন্টা বেশি দামী, স্বামীর চুমু না টাকা?
এ আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। স্বামীর টাকা।
বেশ আমি তোমাকে টাকা দিতে চাই। একটা শর্ত আছে।
খেলা বা মজা সব স্ত্রী মন দিয়ে বুঝে এবং খুব পছন্দ করে। রূপালী বেশ আমোদ পাচ্ছিল। তার এখন শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরার সময়ে। মুখ থেকে রং তুলে ঠাণ্ডা পানি দিতে থাকবে। বিছানায় উঠে আসার আগে বিজ্ঞাপনের সুখী রমণীদের মতো টেবিল ল্যাম্পের চোরা আলোর নিচে বসে ওভাকন খেয়ে নেবে। রকিবুলের কথা শুনে মজা পেয়ে বলল, কি শর্ত স্যার?
খুব মন খুলে হাসতে হবে। একেবারে ভেতর থেকে। একেবারে খুব ভের থেকে। বুঝলে তো? জিনিসটা করতে পারলে ড্রয়ারের যা কিছু ক্যাশ আছে, সব তোমার।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
ঠিক বলছ?
ঠিক বলছি!
রূপালী শক্তিশালী নারী বটে। হাসিতে-খুশিতে ঝর্ণার মতো অবিরল বাজতে থাকে পার্টনার বন্ধুর বাসায় সেই যে প্রথম দেখা হয়েছিল তার সাথে রকিবুলের উনচল্লিশ ও রূপালীর সাতাশ বছর বয়সে তেমনি কিছু বদলায়নি, সেই সুন্দর বুজলতা হয়ে আছে এখনো। জীবনের ওপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে কত হৃদয় আপোসে বদলে গেল। খবরের কাগজে কত কত হেডলাইন তৈরি হল ভেঙে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, মিসমার হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে। ব্ৰহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা প্রভৃতি বিখ্যাত ধ্ব নদী তো প্রায় শুকিয়ে এসেছে। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, রুপালী তেমন ফুরায়নি। ব ক্যাশ দিয়ে দেওয়া হবে শুনে নিশ্চয়ই নয়, রুপালী হাসছিল অশেষ আনন্দের ঝর্ণায় ঘা পড়েছে বলে। সে ধরতে চাইছে রকিবুলের একটু আগে ঘোষণা করা একটা বাজি। যেমন আজ থেকে বিশ বছর আগে রকিবুল, হাসান ও শিরীষ নষ্টচন্দ্রের রাতে মাঠ পাড়ি দিয়ে আকাশে ভাসতে থাকা, প্রত্যেকটা সময় মাত্র পাঁচ হাত দূরের একটা চাঁদ ধরতে চেয়েছিল। রকিবুল অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল রূপালীর খিল খিল করে বেজে ওঠা হাসি শুনে। সেই যে একদা মধুখালির নাদেরার পছন্দ ছিল রকিবুলের একেক সময় দৈর্যে মতো হো হো করে হেসে ওঠাটা, সেই রকমেরই আনন্দ-খনি থেকে আপসে আপ উছলে ওঠা ঝঙ্কৃত ও চীৎকৃত হাসি। রকিবুল আজকাল আর কেন যেন পারে না। কিছুদিন আগেও কিছু না কিছু পারত। আর কি তাহলে ভেতরে সেই খনির দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল?
ড্রয়ার খুলে ক্যাশ বার করে আনে রকিবুল, তখন নিজেকে দেখতে পায় রূপালীর আলিঙ্গনে ও চুমুতে বদ্ধ। চুমুকে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলছিল যে টাকা না, স্বামীর চুমু চাই। তখনো হাসছিল। অপারগ ও অসমর্থ রকিবুল সেই মুহূর্তে ঠিক করে ফেলে আর দেরি না করে এই ব্যাধির চিকিৎসা করবে, সম্ভব হলে আগামীকালই যাবে দিল হাসানের সেই মহিলার কাছে। ভেতরের দরজা বন্ধ হয়ে আসছে, আর দেরি করা যায় না।
দুই.
দিল হাসান টেলিফোন করে রেখেছিল। একদিন সুবিধে মতে, সোয়া বারোটার দিকে হাউজিং এপার্টমেন্টের একটা বাড়িতে মহিলার কাছে পৌঁছে গেল সে। দশতলায় দুইরুমের একটা ফ্ল্যাট। জুলেখাই দরজা খুলে দিয়ে তাকে হেসে স্লামালাইকুম জানায়। কেশবতী বটে। চুল একটু পীত বর্ণের তবে যত্ন করা, নরম ও মসৃণ, সাদাটে একটা ঝলক ফেলে নেমে গেছে কোমর পর্যন্ত। ফর্সা। খুবই ফর্সা। ফলে দাঁত তেমন ঝকঝকে নয়, যদিও লম্বা কাঠামোর মধ্যে শরীর বেশ মজবুত। এই মহিলার হওয়া উচিত ছিল কূটনীতিকের কিংবা কোন সচিবের স্ত্রী। মানুষ যে কতভাবে ভিন্ন দরজায় পৌঁছে যায়।
মহিলা তাকে বসতে বলে ভেতরে চলে যায়। একটু পর ভেতর থেকে এক কিশোরী এসে তাকে আদাব দেয়। জুলেখার মেয়ে। জানায় আম্মুর আসতে সামান্য দেরি হবে। আঙ্কেল যেন কিছু মনে না করেন।
রকিবুলের কথা বলার তেমন ইচ্ছে নেই। মেয়েটির মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকে। আজ অনেকদূর যাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হয়ে এসেছে। লু যদি বুকের দরজাটা খোলে। মদ্যপানের অভ্যেস তার তেমন নেই, দরকার হলে আজ দু’এক পাত্র চালাবে। দিল হাসান বলে দিয়েছে : সে যা কিছু করতে বলে, করিস, দেখবি মজা আসছে। আরো বলে দিয়েছে, তাড়াহুড়া না করতে। জুলেখা মানুষের মনকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। সে ছিলো খানদানী ঘরের এক লোকের স্ত্রী। কিন্তু হলে কি হয়, লোকটা নিজে মহিলাদের ধরে রাখতে জানে না, আবার খুব বদমেজাজী, বদমাশও কি কম, নিজের সুবিধের জন্য দরকার হলে বৌকে ব্যবহার করত। একাত্তর সনে একজন পাকিস্থানী কর্নেল ও দু’জন মেজরকে এই জুলেখার টোপ দিয়ে সে গেঁথেছিল। উর্দু জানা বংশে আছে, কাজেই মেলামেশায় সুবিধে হয়েছিল লোকগুলোর, জুলেখার একাত্তর টা ওরাই তছনছ করে দিয়ে গেছে। দিল হাসান নিজে হাফ বাঙালি। কলকাত্তাইয়া। সে রকিবুলকে বলে দিয়েছে সাবধানে জুলেখাকে ব্যবহার করতে। কারণ মন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত সে তোমার সাথে ড্রয়িংরুমের সোফা ছেড়ে শোবার ঘরে যাবে না। তবে হ্যাঁ, বাঘিনীর জাত। একবার মনে ধরে গেলে সে তার পুরুষকে আনন্দের সাত দরজা পার করে তুলে নিয়ে যাবে। জুলেখা তা পারে বলেই তো সে জুলেখা।
জুলেখার মেয়ে কুহি ও রকিবুল মুখোমুখি বসে আছে। তার কথা বলার তেমন ইচ্ছে নেই। কুহি মেয়েটা বেশ ভদ্র বলে মনে হয়। সে হয়তো ভাবছে এই আঙ্কেল এমন গভীর কেন। রকিবুল কুহির সামনে বসে আছে, মাঝে-মধ্যে চলে যাচ্ছিল আচ্ছন্নের মধ্যে। সে একটা কথা খুব জানে যে, যোগ্য না হলে কেউ এ্যাঙ্গুর ওঠে আসতে পারে না। মধুখালি একটা আধা গ্রাম আধা শহর। লোকেরা কাঁধে গামছা ফেলে খালি গায়ে নদীতে গোসল করতে যায়। রাস্তার পাশে পাটি বা সতরঞ্চি ফেলে তার ওপর বসে ছুটির দিনে তাস খেলা মানুষজন ভাবনা-চিন্তা করে খুব কম। তারা হয় ভালো গোছের ও অলস। ১৯৬৩ সালের দিকে যেবার মধুখালিতে বিদ্যুৎ গেল, সেবার যার যার বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, তারাই বেশ ডাটের মানুষ বলে পরিচিত হয়েছিল। না, ডাটের মানুষ না, আধুনিক মানুষ শুদ্ধ করে বললে মডার্ন। এইরকম একটা আধা-শহর আধা গ্রাম থেকে ঢাকার জি. ও. এইচ. এসের ঝকঝকে সুন্দর দোতলা বাড়িতে ওঠে আসতে পারা যোগ্যতার ব্যাপার নিশ্চয়ই। হয়তো মধুখালি লোক নাদেরার কথা ভেবে বলবে যে তাহলে রকিবুল মিঞা, এম, এ পরীক্ষাটা পাস করতে না করতে হুট করে বিয়ে করার কি দরকার ছিল। মধুখালির মানুষ এটা বলতে পারে। এই রকম বলতে পারার হক তাদের আছে। নাদেরা ও রকিবুল ছিল একই পাড়ার ছেলেমেয়ে। তাদের বাড়ি থেকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ এক চীৎকারের পথ। কিছুদূর গেলে শহর শেষ হয়ে যায়, তারপর ঝোঁপঝাড়ের পথ ঠেলে শুধু নদীর পাড়। স্কুলে পড়ার সময় থেকে নাদেরা ও রকিবুলকে মধুখালির মানুষ নদীর পাড় ধরে হাঁটতে দেখেছে, নদীতে যার যার সঙ্গী-সাথী নিয়ে মানে যেতে দেখেছে। তবে সবাই তো জানে দুই দলে কে কৃষ্ণ, কে রাধা। মধুখালিতে সেই বিশ বছর, তিরিশ বছর আগের কথা, মানুষের জীবন ছিল মানুষের কাছে মুখস্থ। কাজেই নাদেরাকে বিয়ে করা বিয়ে করে বছ দুই পর ঢাকা চলে আসা, দুমাস, চার মাস পর এক-আধ দিনের জন্য মধুখালিতে যাওয়া, শেষে নাদেরার অসুস্থ হয়ে যাওয়া, রকিবুলের খুব বেশি রকম ঢাকামুখী হয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে মধুখালির লোক কথা বলার হক রাখে। তারা বলতেই পারে।
বিশ বছর পঁচিশ বছর আগের মধুখালি ছিল কিছুটা শহর তবে অনেকটাই গ্রাম। সেখানকার মানুষ নিজের বৈঠকখানাকে আমার বৈঠকখানা বলে না, বলে আমগোর বৈঠকখানা। জামাই, কবে আসলেন?’ এই কথা জিজ্ঞেস করত নাদেরাকে নিয়ে পাড়ায় বের হলে নাদেরাদের পাড়া-প্রতিবেশীরা। যে কারুর বৈঠকখানা ঘরে পাড়ার যে কারুর মেহমান এসে রাতে থাকতে পারত। এই ছিল মধুখালি। যেন পৃথিবীর ওপারে আরেক সভ্যতা। কমলাপুরের কাছাকাছি হয়ে কোথাও রেলের বাঁশি শুনলে মধুখালিকে কিংবা বৃষ্টিতে লক্ষকোটি সুচ ভাঙার শব্দেমুখর নদ ব্রহ্মপুত্রের ধারে সেই কুয়াশাধূসর মদুখালিকে। এও ভাবে রকিবুল, যোগ্যতা না থাকলে এ্যাদুর কেউ ওঠে। আসতে পারে না। হ্যাঁ, মধ্যে ঘটনা আর ব্যাপার স্যাপার আছে। যেমন, নাদেরার সঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়া। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ঘোর সন্দেহে পড়া যে রকিবুল তার হিস্যা হিসাবের মারপ্যাচে মেরে দিয়েছে। ফুল খালাম্মার মনে খুব দুঃখ দেওয়া। মহিলা বলতেন যে রকিব আমার পেটের ছেলে।
ব্যাঙ্কের কোলেটারেলের জন্য পুরানো পল্টনের জমি ও বাড়ির দলিল দিয়েছিলেন তিনি রকিবুলকে। এইসব বৃত্তান্ত আছে তার এ্যাদূর উঠে আসার মধ্যে। রকিবুল অনুতপ্ত কিনা? তা জেনে মানুষের কি লাভ! রকিবুল সেসব কখনো ভাবতে চায় না। সে চায় ভাবতে যে সে রকিবুল হোসেন, জি.ও এইচ, এসের শেষ পশ্চিমে ছিমছাম সুন্দর একটা বাড়ির মালিক। সেনা কল্যাণে এখনে স্পেস নেওয়া যায়নি বটে, তবে দিলকুশায় তার সাড়ে চার হাজার স্কোয়ার ফুটের অফিসও বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। স্মার্ট, মডার্ণ। বহুদিন মার খেতে খেতে এখন সে ব্যবসা শিখে গেছে, এখন সে দু’বার মার খায় তো পাঁচবার মার দেয়। ঢাকায় মাঝারি গোছের ট্রেডারদের মধ্যে সে নিশ্চিত দশজনের একজন বলে গণ্য হতে পারে। মধুখালি ইজ অলরাইট। তবে তার ছেলে আছে, অতীত নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি সে চায় না। সে নিজের মধ্যে দেখতে চায় দৈত্যের মতো নির্মম ও দেবতার মত সহৃদয় একটি মানুষকে। যে-কোন সফল মানুষ হল এইরকম, একই সাথে দৈত্য ও দেবতা বা ফেরেশতা। রকিবুলের ওপরে ওঠা এখনো বেশ অনেকটা বাকি। এই সময় কি বিপদ ও দুর্বিপাক যে বুকের ভেতরকার আনন্দের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। কোন মানে হয়! বন্ধ হয়ে গেছে বৈকি! তার ছেলে নার্সারী ওয়ানের ছাত্র। সেন্ট জোসেফে। টিচার লিখে পাঠিয়েছে মুহীবর ডিড এক্সিলেন্ট ইন ক্লাস ম্যানারস। কি চমৎকার সংবাদ। মনের মধ্যে আনন্দের হু হু বাতাস বয়ে যাওয়া উচিত ছিল না? কিন্তু টিচারের লেখা দেখে রকিবুল শুধু একটু জোর দিয়ে মুহীবরকে বলেছিল ও গুড। ভেতর থেকে হেলে পড়া দেবে যাওয়া ভেঙে পড়া এই সমস্ত কি জিনিস? এতদিন তেমন গা করেনি। ইদানীং রূপালী যখন তখন জিজ্ঞেশ করে বসে, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? পরশুদিন অফিসে দিল হাসান ও হরিপদ’র সামনে ওভার টেলিফোনে সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার অচিন্তনীয় একা সুসংবাদ পেয়েও তক্ষুণি উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতে পারল না। এসব কি শরীর ও ক্যারিয়ারের জন্য খুবই খারাপ লক্ষণ না? তার একা নিরাময়ের দরকার। এই মহিলাটা নাকি জানে। দিল হাসানের প্রেসক্রিপশন। দেখা যাক।
কুহি সামনে বসে অবাক হয়ে প্রৌঢ় তবে শরীরে স্বাস্থ্যে বেশ মজবুত লোকটাকে দেখছিল। বারো মিনিটের মধ্যে একবারের জন্যেও চোখ তুলে তাকায়নি। একটা কথা বলেনি। ঘাড় গুঁজে বসে আছে সেই তখন থেকে। কুহি জানে মানুষ ভালো হয় না, মন্দ হয় না, সে ভালো-মন্দের মাঝখানে বাস করে বলে ভালো বা মন্দের কিংবা সুখ বা দুঃখের একটা ছাপ তখনকার মতো বহন করে। জেলখানার কয়েদীর পোশাকের মতো। তার আম্মা তাকে এসব কথা বলেছেন। ছোটবেলা দেখেছে, আম্মার একজনের বেশি সত্যিকারের ছেলে বন্ধু নেই। এখন হয়তো একাধিক বা অনেক বন্ধু তার থাকতে পারে। সে যাই হোক, আম্মা তার একমাত্র বন্ধু ও ভরসা। আম্মা খারাপ কিছু করতে পারেন না বলে তার বিশ্বাস। এই লোকটাকে দেখে কুহির মনে হতে থাকে সে খুব বিপদে পড়া। আম্মুর কাছে সাধারণত আসে ড্যাসিং পুশিং সব লোক, কেউ কেউ খুব সফল, তাদের সবারই তাকাবার, বসার, কথা বলার, হেসে ওঠার একটা আলাদা স্টাইল আছে। আম্মুর কাছে যারা আসে তারা বেশির ভাগ হয় প্রাণচঞ্চল, অস্থির, হাসিখুশি এমনকি একটু-আধটু রগচটা। এই লোকটা ঠিক তাদের মতো কেউ না।
কুহি আর থাকতে না পেরে বলে, আঙ্কেল, দু একটা কথা বলেন।
ভারী মধুর ভঙ্গি মেয়েটোর। আদুরে অথচ আত্মবিশ্বাসী। তাকে হঠাৎ ভালো লেগে যায় রকিবুলের। এরিকম মেয়ে যেন সংসারে অনেক থাকে, বড় হয়ে আমাদের। প্রিন্স চার্মিং মহীবুর হোসেন যেন তাদের কারুর দেখা পায় ও ডেটিং করে। রকিবুল মায়ার্দ্র হয়ে ভাবে। পরে তার মনে হয় এটা বোধহয় একটা বাড়াবাড়ি চিন্তা হয়ে গেল। মেয়েটাকে সে ভালো চেনেও না। এইমাত্র বুঝতে পারে যে কলেজের ফাস্ট ইয়ার বা সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী হবে। হয়তো সতেরোর মধ্যে বয়স। টিন এজার। একটা কথা শুনে বা কথার ভঙ্গি দেখে কোন উপসংহারে চলে যাওয়া নিশ্চয়ই ঠিক।
তুমি কোথায় পড়ছ, ইডেনে না বদরুন্নেসায়?
জগন্নাথে। সেকেন্ড ইয়ার কমার্স।
জগন্নাথে। আচ্ছা কমার্স! হুঁ।
আচ্ছা, হুঁ এইসব শব্দ বলেটলে রকিবুল হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসে! জিজ্ঞেস করে ফেলে ও আচ্ছা বড় হয়ে তুমি কার মতো হতে চাও…..
তার জানার ইচ্ছে হচ্ছে বটে। বাবা খানদানী বংশের ও উচ্ছন্নে যাওয়া। মা মনে হয় শিক্ষিতা, রুচিবতী ও জীবনের অনেক দূর তৈরি হওয়া মানুষ। বু তাকে মডেল করা যায় কি? মেয়ের পক্ষে বলা যায়, আমি আম্মুর মতো হব? মুহীর যেমন বলে, আমি আবুর মতো হব? রকিবুলের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল।
কথাটা শুনে কুহি একটু হকচকিয়ে গেল না? হা করে তাকিয়ে রকিবুলের দিকে। এসময় ট্রেতে নাস্তা ও চা নিয়ে ঘরে ঢোকে জুলেখা। হ্যাঁ, কেশবতী বটে। আর মাথায় অনেকটা লম্বা। এর মধ্যে ভেতরে গিয়ে একদম কোন সাজগোজ করেনি। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া পর্যন্ত না। ‘একটু দেরি হয়ে গেল, না’, বলে হাসতে হাসতে রুপালী মহিলা টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখে। কুহি ‘আমি যাই’ বলে ওঠে পড়েছিল। তাকে জুলেখা বলে যে এখন বাইরে যাওয়া চলবে না, হোমটাস্ক বাকি, লাঞ্চের আগে সেগুলো শেষ করতে হবে। খুব মেজাজ দেখিয়ে কুহি বলে? উঃ অসহ্য। মা মেয়ে হাসছিল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। ‘কুহি যাই আঙ্কেল’ বলে আদাব দিয়ে চলে যায়। রকিবুলের মনে হতে থাকে তার একটু একটু ভালো লাগছে।
এরপর চা খেতে খেতে দু’জনের মধ্যে কুশল বিনিময়। আপনার দেশ কোথায়? ব্যবসা কেমন চলছে? আপনার হাব্যান্ড কি ঢাকায় না বাইরে? দিল হাসান আপনার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। আপনার স্ত্রী কিছু করেন-টরেন? ছেলেমেয়ে? এসব নিয়ে আলাপচারিতা। এছাড়া এর ওর দিকে তাকানো-টাকানো। হাসা টাসা বা হাতনাড়া, কপাল ঘষা ইত্যাদি। রকিবুল হোসেন একটু প্রখ করে দ্যাখে মহিলার ওয়েস্টলাইন এখনো দারুণ ভালো। সন্দেহ নেই, মেইনটেইন করেন। নতুবা বয়স তো চল্লিশের কাছাকাছি নিশ্চই। জুলেখা দ্যাখে ভদ্রলোকের বেশ পুরুধু মুখে থুতনির দিকটায় একটু টিপে দেওয়া খাঁজ। নাকে ঘাম জমে। চোখ দুটি জ্বলে পড়ে খাক হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে লাজুক বোধহয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ অনর্থ ও ভালো কাজ ভেতরে ভেতরে লাজুক এই পুরুষেরাই করেছে।
সাধারণ আলাপচারিতার পরে বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপচাপ। জুলেখা ভাবছিল বলুক। সে তো কিছু বলতেই এসেছে। রকিবুলের মনে হতে থাকে তার তো বলার বিশেষ কিছু নেই। জুলেখাই বলুক না। বড় আশা নিয়ে সে এসে পৌঁছেছে এপার্টমেন্ট হাইজিংয়ের দশতলায় দিল হাসানের জীবনের অভিজ্ঞতা হল, সব নারী পুরুষের ওপর জাদু কেলতে জানে। কম বা বেশি। জুলেখা একটু বেশি জানে। সেই জানা প্রয়োগ করুন রকিবুলের ওপর।
জুলেখা চট করে কিছু বলল না। একটু শিথিল হয়ে বসে। যাতে তার গলার ছাঁট, বুকের নিচে অনকেদুর নেমে যাওয়া ও কোমরের কিছু অংশ চোখে পড়ে। যে কোন নারী যৌবনে নিজেকে যতটা পারুদঘাটিত করতে চায়। জুলেখা তার ব্যতিক্রম হবে কেন। তবে রকিবুল শরীরের ঐ দেখানো-অংশে মোটে তাকাচ্ছিল না। সে সবসময় নারীকে চেনার ও বুঝার জন্য বেছে নেয় তার চোখ। জুলেখার চোখ কিছু অসাধারণ নয়। তবে একটা কথা হল, সেই চোখে জীবনে অনেক কিছু দেখার ছাপ। ছিল।
একটি ফিসফিসে গলায় জুলেখা বলে, কেন এসেছে আমার কাছে? সম্পর্ক করতে চান?
ক্লান্ত কণ্ঠে রকিবুল বলে, না। দিল হাসান বলেছিল আপনি নাকি জাদু জানেন। পুরুষ মানুষের বুকের দরজা খুলে দিতে পারেন।
হ্যাঁ, জাদু জানি। তবে তাকে হতে হবে আমার প্রেমিক। আপনি তো তা নন।
আপনার প্রেমিক কেউ আছে?
আগে ছিল একজন। তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। লোকটা খুব বদমেজাজী। আমার থেকে একশো পার্সেন্ট চায়। অথচ সে যে কি করে, কোথায় যায় তার কিছু আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করত না। কয়েকমাস আগে থেকে আমার বাসায় তার আসা বন্ধ। লোকটা খুব জেদী। আমি জানি না ডাকলে সে কখনো আমার কাছে আসবে না…..
আপনি তাকে ডাকবেন?
বুঝতে পারছি না। আমার কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছেন। তারা খুব বিবেচক। তবে কেন জানি না ঐ বদমেজাজী আর অসহ্য লোকটার সঙ্গেই আমার বেশ। মিলেছিল। লোকটাকে আর ডাকার ইচ্ছে আমার নেই। সে আমার ডাকের অপেক্ষায় নেইও। খবর নিয়ে দ্যাখেন একটার পর একটা মেয়েলোক উদ্ধার করে ফিরছে…খুব বাজে লোক।
জুলেখা একটু হাসে। বলে? মনে হয় আপনিও আমার মতো পুড়ছেন। আপনি হয়তো একটু বেশি। আপনাকে আসলে কোথায় যেতে হবে আপনি জানেন?
হ্যাঁ জানি।
একটু পর রকিবুল জুলেখার ফ্ল্যাট থেকে ওঠে পড়ে। পৃথিবীতে কোন অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। জুলেখা খুব ভালো মহিলা।
তিন.
তিনটি সেশান হয়ে যাওয়ার পর রকিবুল ও ডাক্তার সিদ্দিক উল্লাহর মধ্যে এরকম কিছু কথাবার্তা হয়েছিল?
মহিলার কাছে কেন গিয়েছিলেন?
ও মনে হয় প্রলুব্ধ হয়ে। তবে প্রলোভন না হয়ে প্রয়োজনও হতে পারে। সে নাকি পুরুষ মানুষকে আনন্দের সাত দরজার ওপারে নিয়ে যেতে পারে।
এটা ঠিক নয়। যারা এরকম বলে তারা হয় ব্যাপারটা বুঝে না, নতুবা বুঝেও আমোক আশ্বাস দেয়। হয়তো আপনার বন্ধু দিল হাসানেরই ভুল। ঠিক আছে, মহিলা যদি আপনার প্রেমিকা হয়ে উঠতে রাজি হয় তাহলে আপনি কি রাজি আছেন?
না। আমার বয়স সাতচল্লিশ। আমার একটি ছেলে আছে। তাছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো খারাপ নয়। যদিও সময় সে আমাকে বুঝে না অথবা আমি। তাকে বুঝতে পারি না…।
ঠিক আছে তাহলে ঐ মহিলার কাছে গেলেন কেন? আপনার কি মনে হয়?
প্রয়োজনে গিয়েছিলাম।
আর একটু ব্যাখ্যা করতে পারেন?
না। আর কিছু মনে আসছে না।
নাদেরার ব্যাপারে আপনার একটা মমতা ও অপরাধ বোধ আছে একবার মধুখালিতে যান না কেন। গিয়ে মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে আসুন। অবশ্য যদি তার এখনকার স্বামীর অনুমতি মেলে। যাবেন?
না। কোন কোন সম্পর্ক আর সহজ হয় না। যেমন ফিরে পাওয়া যায় না হারিয়ে যাওয়া সময়। তাছাড়া তেমন করতে গেলে আমার স্ত্রী খুব দুঃখ পাবেন। সেটা আমি চাই না…..
বেশ তাহলে একটা কাজ করুন। আপনার স্ত্রীকে নাদেরা সম্পর্কে সব অনুভূতি খুলে বলুন….
সে যে আমাকে ভুল বুঝবে ডাক্তার সাহেব।
না। ভুল বুঝবে না। বরং আপনিও তাকে ইনভাইট করুন তার কোন না বলা কথা থাকলে বলতে। দেখবেন মনের ময়লা দূর হয়ে চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে…..
আমি জানি না কি করব। রূপালী কোন কোন সময় খুব কঠিন মহিলা। তার কিছু কিছু ব্যাপার আমি বুঝতে পারি না।
আর একটা কথা। নাদেরাকে একটা চিঠি লিখতে হবে।
ডাক্তার সিদ্দিক উল্লাহর সাথে আরো দুটি মেয়াদের পর কিছু ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র দিলেন তিনি। হাই অর্ডার অব ডিপ্রেশন। তিনি আশ্বাস দিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। রকিবুলকে মাস ছয়েক নিয়মিত মাসে দু’বার যেতে হবে তার কাছে। আনন্দের দরজা বন্ধ ঐ ডিপ্রেশনের কারণে।
কয়েকদিন খুব সতর্কভাবে ডাক্তারের নির্দেশ ফলো করে রকিবুল। এর মধ্যে একদিন টপ অব দা ক্লাবে পার্টি হয়ে গেল। মহা হৈ চৈ ও আমোদর্তি রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। রকিবুল সহ্য করতে জানে বলে সবকিছুতে উৎরে যায়। তারপর রকিবুল আগের মতো সকাল বেলা স্নান সেরে পোশাক পরে তৈরি হয়ে অফিসে যায়, ফিরে আসে কখনো লাঞ্চের আগে এবং বেশির ভাগই বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে। ডাক্তার যাই বলুক নাদেরাকে চিঠি লেখা যায় না, রুপালীকে বলা যা না তার সম্পর্কে সবকিছু ভাঙিয়ে। জীবন হল সহ্য করার ব্যাপার। দিন তো কেটে যায়। সময় ঠিকই যাবে। একদিন তার বাসায় গৌতম সাহা, দীদার আহমদ, সেলিম মীর্জা ও হাস্নাহেনা চৌধুরীর নিমন্ত্রণ। সাথে তাদের স্ত্রী ও স্বামী। রূপালী সবার সামনেই হাসতে হাসতে রকিবুলকে বলে যে যদি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাহলে রকিবুল বরং তার অফিসে চলে যেতে পারে। তার কাছে তো কাজই হল জীবন।
রকিবুল বেঁচে যায়। ফিসে তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে চলে এল তার ছেলে মুহীবরের ঘরে। মুহীবরের বয়স সাত বছর। সে একটা রংয়ের বাক্স দিয়ে কাগজে রঙ-তুলির খেলা খেলছিল। রকিবুল তাকে জিজ্ঞেস করে : মুহী, তুমি কি বড় হয়ে আর্টিস্ট হতে চাও….
মুহী বলে? না। বড় হয়ে আমি আম্মুর মততা হতে চাই।
না, না, বলে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় রকিবুল। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। সে বলল, না।