রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘মার্কসবাদ’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০২২

মার্কসবাদের মূল কথাটাই হলো সব কিছু পরিবর্তনশীল এবং সেই পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণটাই হলো সবকিছুই নিজের বিপরীতে বিকশিত হয়। ফলে মার্কসবাদ কট্টর বা অনড় কিছু নয়। মার্কস এঙ্গেলস স্বীকার করেছেন, মার্কসবাদ বিশ্বের পূর্বের বিভিন্ন তথ্য আর জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে মালমশলা গ্রহণ করেই জন্মলাভ করেছে। মার্কসবাদ বা মার্কস এঙ্গেলসের দর্শন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু নয়। মার্কস এঙ্গেলস নিজেদের মাথা থেকে কোনো কিছু অলৌকিকভাবে টেনে বের করেননি। মার্কসবাদ হচ্ছে ইতিহাসের চিন্তার নানা ধারাবাহিকতার একটা বিশেষ দর্শন।

মার্কসবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বা খুব আলোচিত দর্শন কেন? বিশ্বে মার্কসবাদের পূর্বে যত দার্শনিকরা জন্মলাভ করেছেন, সকলে নিজেদের দর্শনকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিপন্ন করেছেন। মার্কস এঙ্গেলস প্রথমবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, বিশ্বের জন্য চিরস্থায়ী শ্রেষ্ঠ কোনো দর্শন তারা লিখে রেখে যাননি। যতটুকু তাদের সময় পর্যন্ত তাদের সামর্থ্যে কুলিয়েছে সেটাই তারা বলে গেছেন। ভবিষতে ভিন্ন কেউ এসে এর চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে পারেন। কারণ জ্ঞান বা চিন্তার বিকাশ কখনো থেমে যাবার নয়। বস্তুজগত যেমন পরিবর্তনশীল দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, মানুষের চিন্তার জগতও তেমনি।

ক্রমাগত বিকশিত এবং নানাভাবে রূপান্তরিত বিশ্বের বিরাট চিন্তার জগতে কেউ কখনো শেষ কথা বলে যেতে পারে না। বিশ্বের কোনো মানুষের পক্ষেই তা বলা সম্ভব নয়। মার্কস এঙ্গেলস তাই চিরসত্য কোনো দর্শন দিয়ে যাননি। মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তাধারা ভবিষ্যতে সময়ের প্রয়োজনে নানাভাবে যে বিকশিত হবে এবং তা হওয়াটাই যে স্বাভাবিক সেটাই হচ্ছে মার্কসবাদ। মার্কসবাদ সেইজন্য কেবল মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তাচেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মার্কস এঙ্গেলসের পরবর্তী সময় ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধারায় চিন্তার বিকশিত সকল রূপ নিয়েই মার্কসবাদ।

মার্কসবাদ তাই একটি বিকাশশীল ধারা। বহু মার্কসবাদী নামধারী আছেন যারা এতটাই কট্টর যে, মার্কসের চিন্তা তোতা পাখির মতো উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। বুঝতে চান না মার্কসবাদ বিচার হবে সমাজের প্রেক্ষিতে নতুন বিকশিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বিত করে। মূর্খরাই শুধু বিশ্বাস করে, বিশ্বের মানুষ চিরস্থায়ী সমাজের চিত্র বা তত্ত্ব দিয়ে যেতে পারে। মানুষের সকল চিন্তাই আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হবে। সকল কিছুই নিজের পক্ষে বা নিজের বিপরীতে বিকশিত হচ্ছে। মানুষ বা প্রাণী যখন বড় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত বা প্রতিমুহূর্তে নিজের বর্তমানকে অতীত করে দিয়ে বিকশিত হচ্ছে।

ফলে মানুষ একইসঙ্গে শিশু আর কিশোর থাকতে পারে না। নিজের শিশুবেলাকে বাতিল করে বা ধ্বংস করে দিয়েই ক্রমাগত কিশোর তরুণ বা যুবক হচ্ছে। আরও পরে বৃদ্ধ, কিন্তু হঠাৎ করে হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে বর্তমানকে বাতিল করে। মুরগির ডিমে তা দিতে দিতে হঠাৎ ডিমের রূপান্তর ঘটে মুরগির শিশু জন্ম নিচ্ছে। দুটা শক্তি কাজ করছে প্রধানত, ভিতরের ডিমের গুণ আর বাইরে থেকে দেয়া তা, ন্যূনতম দুয়ের দ্বন্দ্ব আছেই সকল সৃষ্টির পেছনে। কখনো এক হাতে তালি বাজে না। সকল সৃষ্টির পেছনে মূল রহস্য এখানেই।

ডিমটার ভিতর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা ছিল পরিমাণগত পরিবর্তন তাই নজরে আসেনি। যখন ডিম থেকে মুরগি সৃষ্টির গুণগত পরিবর্তন ঘটলো, তখনি ডিমের রূপান্তর সকলের নজরে এলো। ঠিক একইভাবে দিবস প্রতিনিয়ত নিজের বিপরীতে বিকশিত হয়ে রাত হচ্ছে, রাত নিজের বিপরীতে বিকশিত হয়ে সকাল আসছে। সবকিছুর প্রথম পরিবর্তন ঘটে পরিমাণগত ভাবে। যখন পরিমাণগত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তখনই বস্তুর বা সবকিছুর বিরাট রূপান্তর হয়। সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একই নিয়ম কাজ করে। মার্কস এঙ্গেলস বস্তুজগতের ক্ষেত্রে এটাকেই বলেছেন দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ। সমাজের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বা রূপান্তর হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ