রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘মার্কসবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতা’

পর্ব ২

প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০২৩

যখন চুলায় রান্নার জন্য কিছু সামগ্রী দেয়া হয়, সামান্য পর পাল্টাতে পাল্টাতে গুণটাই পাল্টে যায়। প্রথম ডাল দেখা গেল, মাংস দেখা গেল, নানা মশলা দেখা গেল। হঠাৎ গুণগত পরিবর্তন ঘটে `হালিম` নামক খাবার হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু হালিমের ভিতরে আগের সামগ্রীগুলোর আলাদা আর কোনো বৈশিষ্ট্য রইলো না। পূর্বের সব বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করে হালিমের জন্ম হলো। মুরগির একটা ডিমের কথা ধরা যাক। বাচ্চা ফোটাবার জন্য কতদিন ধরে সেখানে তা বা হালকা তাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে ডিম দেখতে পাচ্ছি। ডিমের ভিতরের প্রতিদিনের পরিবর্তনটা আমাদের সাধারণ চোখে দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ ডিম থেকে একদিন মুরগির বাচ্চা বের হয়ে এলো। ডিমটার গুণগত পরিবর্তন ঘটলো, ডিমটা আর ডিম রইলো না। মুরগির বাচ্চা হলো। কিন্তু একদিনে কি ঘটেছে? না। প্রতিনিয়তই ডিমটার ভিতর পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিনিয়তই ডিমটা একটু একটু করে নিজেকে ধ্বংস করে নিজের বিপরীতে মুরগির বাচ্চা হিসেবে বের হয়ে এলো।

 

পৃথিবীর সব পরিবর্তন বা সব টিকে থাকার ঘটনা এমনই। মুহূর্তের জন্যই সে টিকে থাকে, ক্ষণে ক্ষণেই তার একবার জন্ম একবার মৃত্যু ঘটে। মানুষের পুরো বেঁচে থাকাটাকে আমরা জীবন বলি। কিন্তু মানুষের সেই একজীবনে বহু বার তার মৃত্যু আর জন্ম ঘটে। প্রতি ক্ষণে জন্ম প্রতি ক্ষণে মৃত্যু। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর ভিতর দিয়েই প্রতি ক্ষণে ক্ষণে সে নতুনভাবে জন্মলাভ করে। সবটা মিলিয়ে একটা জীবনচক্র। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তাই বিশেষ কারো নির্দেশে চলে না। চলে কতগুলো নিয়মের দ্বারা। মার্কস জানিয়েছেন, মানুষ নিজেই তার ইতিহাস সৃষ্টি করে কিন্তু তাই বলে নিজের খেয়াল-খুশিমতন ইতিহাস রচনা করতে পারে না। মানুষ বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনার কয়েকটি ধাপ পার হতে পারে। মার্কসের সৃষ্টিশীলতা এইখানে যে, মানব সমাজের অগ্রণী ভাবনায় বিভিন্ন যেসব জিজ্ঞাসা আগেই দেখা গিয়েছিল, মার্কস তার বিজ্ঞানসম্মত জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হলো এমন এক তাত্ত্বিক হাতিয়ার, জগৎ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যাকে কাজে লাগানো যায়।

 

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যুক্তিতর্কবিহীন বদ্ধমূল ধারণা নয়। বরং প্রতিটি প্রশ্নকে বিচার করা, অনুধাবন করা এবং ব্যাখ্যা করার উপায়। ভাববাদের জায়গায় মার্কস বস্তুবাদকে সামনে আনলেন। দর্শনে ভাববাদ বলতে বাস্তব জগতের ঊর্ধ্বে একটি চৈতন্যময় উচ্চতর জগতকে কল্পনা করা হয়েছে। ভাববাদীরা বিজ্ঞানের উপর খুব বেশি নির্ভর করতে বারণ করে। ভাববাদীরা বলতে চান যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়গুলোই বিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে। মার্কস তা সরাসরি বাতিল করে দেন। মার্কসবাদী বস্তুবাদ বলে যে, জগতের প্রকৃতি স্বভাবতই বস্তুগত এবং তার প্রকাশ বস্তুর গতিশীল রূপ ছাড়া কিছু নয়। বিজ্ঞানের প্রতিটি উন্নতি বস্তুবাদের ধারণাকে শক্তিশালী করে। বস্তুবাদ বাস্তব জগতের ঘটনাবলীকে বাস্তব জগত দিয়েই ব্যাখ্যা করতে চায়। বাইরের অলৌকিক জগতের ধারণায় তাদের আস্থা নেই। মার্কসের দুই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস বলেছিলেন, সূর্য যে ঈশ্বর নয় বরং কতকগুলি অনু পরমাণুর সমষ্টি, এটা বুঝতে পারাই সবচেয়ে জরুরি। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের মনে করা হয়, বিশ্ব-জগৎ কোনো এক পরম সত্ত্বার সৃষ্টি নয়।

 

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিচারে গতিহীন বস্তুর কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনি বস্তুহীন গতির কথাও ভাবা যায় না। বস্তুর প্রকৃতিই হলো ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া। বস্তুকে যতোই নিশ্চল মনে হোক না কেন, তার মধ্যে অবিরাম গতি বর্তমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, পরমাণু তার অংশগুলির অবিরাম গতির সাহায্যেই কেবল নিজেকে একই রকম রাখতে সক্ষম হয়।

 

সুতরাং, পরিবর্তনের কারণসমূহ অধ্যয়নের সময় শুধুমাত্র বাহ্যিক কারণগুলো জানতে চেষ্টা না করে, পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যেই সর্বোপরি পরিবর্তনের উৎস খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে হবে বস্তুর আপন গতির মধ্যে, বস্তুর অন্তর্গত বিকাশ- প্রেরণার উৎসধারায়। মার্কস মনে করেন, ঠিক একইভাবে সমাজ বিকাশের কারণ ও নিয়মাবলী কিছু বীর পুরুষদের কর্মফল নয়। সমাজ পরিবর্তনকে সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের বিকাশের ফল হিসেবে দেখতে হবে। মার্কস এঙ্গেলস বলেন, মানুষের আসল পরিচয় পাওয়া যাবে তার উৎপাদনী কর্মে। মানুষ চিন্তাশীল জীব। কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে তার অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ভাবনা। জীবন ধারণের উপকরণ সংগ্রহ করাই ছিল মানব সভ্যতার প্রাথমিক কাজ। মানুষকে জানতে হলে, তার ইতিহাস জানতে হলে সর্বপ্রথম জানতে হবে তার জীবনব্যবস্থার উপকরণ সে কীভাবে সংগ্রহ করে। মানব সভ্যতার প্রথম কথা হলো তার শ্রম। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জানতে হলে তাই মানুষের শ্রমের ইতিহাস জানতে হবে। শ্রমের সাহায্যেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছে।

 

মানুষ শ্রমের দ্বারা প্রকৃতি থেকে তার রসদ সংগ্রহ করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে তাই মানুষের প্রথম বন্ধন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি কিন্তু দ্বান্দ্বিক। রসদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষ যেমন প্রকৃতিকে পাল্টেছে, সেইসঙ্গে নিজেকেও প্রতিনিয়ত পাল্টে নিয়েছে। ফলে মানুষের শ্রমের ইতিহাস বা উৎপাদনী কর্মের ইতিহাস না জেনে বা তাকে আড়াল করে মানব সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ এবং প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব নয়। মার্কস অন্যান্য মনীষীদের গবেষণার সূত্র ধরে সেই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ রূপ তুলে ধরেছেন। জ্ঞানের ইতিহাসে এসব হচ্ছে মার্কস এঙ্গেলসের বিরাট অবদান।

 

সমাজে একসময়ে সবমানুষ একইরকম ছিল। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ঝগড়া বিবাদ ছিল না। সেটাকে বলা হচ্ছে আদিম সাম্যবাদী সমাজ। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির ভিতর দিয়ে নানারকম পেশার মানুষ সমাজে কবে থেকে বাস করতে আরম্ভ করলো? মানুষ তার সভ্যতার উষা লগ্নে যখন শিকারী জীবন নিয়ে বেঁচে ছিল তখন মানুষে মানুষে বিভেদ ছিল না। মানুষ তখন দখলদার ছিল না। মানুষের মধ্যে রাজা প্রজা ছিল না। সকল মানুষ তখন সমান ছিল। মানুষের নিয়তি ছিল তখন প্রতিনিয়ত শিকারের পেছনে ছুটে চলা। ঘর বাঁধতে শেখেনি মানুষ তখন। রাত্রি যাপনের ঠিকানা নেই। নিজেই জানে না সে তখন শিকারের পিছনে ছুটতে ছুটতে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে। কারণ তার হাতে মানচিত্র নেই। পিছনে ফিরবার তার কারণ নেই। কারণ পিছনে ফেলে আসা কোনো বন্ধন নেই, পিছনে ফেলে আসা সুনির্দিষ্ট কোনো আবাস নেই তার। ফলে যখন যেখানে ক্লান্তি, সেখানেই তার নিদ্রা। সেই সময়ে চারদিকে ঘন জঙ্গলের অন্ধকারে বসে অনেক সময় তার জানার সুযোগ নেই সেটা রাত না দিন। জানার প্রয়োজন নেই, কারণ মানুষ তখনো কারো চাকরি করছে না।

 

দিবস আরম্ভ হলেই তাড়াহুড়ো করে দাপ্তরিক কাজে কার্যালয়ে যেতে হচ্ছে না। মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করছে, দলবদ্ধভাবে শিকার করছে এবং শিকার করা পশুর মাংস সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খেয়ে নিচ্ছে। মানুষ তখন দলবদ্ধভাবে না থাকলে, অন্য প্রাণীদের আক্রমণের সামনে টিকতে পারতো না। তখনো লিপির আবিষ্কার হয়নি, মানুষের ভাষা তখন আর দশটা প্রাণীর মতো নানারকম ইঙ্গিত আর কণ্ঠের নানা উচ্চারণ। মানুষ তখন দখলদার ছিল না বলেই, সারা পৃথিবীটাই তখন মানুষের ছিল। মানুষের একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগত না। ঠিক আবার কোনো ভূখণ্ডেরই সে মালিক ছিল না। সামান্য কিছুরই সে নিজেকে মালিক বলে দাবি করেনি তখন। দরকারও ছিল না। ঠিক আর দশটা প্রাণীর মতোই সে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল যত্রতত্র নিজেদের প্রয়োজন মতো। কিন্তু মানুষের সঙ্গে সেদিন এবং আজকেও অন্য প্রাণীদের মূল বা মৌলিক পার্থক্যটা কি? পার্থক্য একটাই, যা মানুষকে নিজের ‘সভ্যতার ইতিহাস’ বানাতে সাহায্য করেছে। সেটা হচ্ছে অস্ত্র।

 

মানুষ নিজেই নিজেকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে থাকে। সত্যি বলতে অন্য প্রাণীরা মানুষকে ভোট দিয়ে তা বানায়নি। মানুষ শক্তির জোরেই শুধু এটা দাবি করছে। মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা জীব প্রমাণ করতে পারবে কি না সে প্রশ্নটা থেকেই যায়। মানুষ আসলে অন্য প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ কোথায় বা আলাদা কোথায়? সেটা আজকে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের দিকে তাকালে খুব সুস্পষ্টভাবে ধারণা করা যাবে। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অস্ত্র ব্যবহার করতে জানে। বাকিরা তা জানে না। মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বলেই সভ্যতা নামক একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছে, যা আর কোনো প্রাণী পারেনি। মানুষ যে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার প্রধান কারণ তার হাতের বুড়ো আঙুল। মহাভারতে দ্রোণাচার্য একলব্যর কাছ থেকে এই বুড়ো আঙুলটাই কেড়ে নিয়েছিল যাতে সে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। মানুষের চিন্তার যে বিকাশ ঘটেছে সেটা একদিকে তার শ্রম আর অন্যদিকে এই অস্ত্র ব্যবহার করবার ক্ষমতা। মানুষ শ্রমের ভিতর দিয়েই একদিন নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছে তাতে করে হাত দুটো মুক্ত হয়ে গেছে।

 

চলতে চলতেই হাত দুটেকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারছে সে এখন। মানুষের এই মুক্ত হাত অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে যা আর কোনো প্রাণী পারে না। মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বলেই দূর থেকে শত্রুকে ঘায়েল করতে পারে, যা আর কোনো প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষই একমাত্র প্রাণী যার অস্ত্র বানাবার এবং দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র হিসেবে তাকে ব্যবহার করার ক্ষমতা রয়েছে। বাকি প্রাণীরা অস্ত্রের ব্যবহার জানে না বলেই অন্য প্রাণী থেকে পিছিয়ে আছে। মানবসভ্যতা আছে, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস আছে। কিন্তু অন্য প্রাণীদের কারোরই সভ্যতা নেই। মানুষের মতো অন্যদের ঐতিহ্য বলে কিছু নেই। কারণ তারা সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারেনি, অস্ত্র ব্যবহার করতে জানে না।

 

বাঘ, সিংহ বা অন্য প্রাণীরা যখন লড়াই করে, পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে লড়তে হয়। নিজেদের শরীরের শক্তি আর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করেই তারা সেখানে লড়াই করে। পিছন থেকে ছুরি মারার সুযোগ তাদের নেই। শত্রুর সংস্পর্শে না এসে লড়াই করতে পারে না তারা। মানুষ দূর থেকে অস্ত্র ছুড়ে নিজে সামান্য আহত না হয়ে শত্রুকে বধ করতে পারে। মানুষ আসলে এখানেই অন্য প্রাণী থেকে আলাদা। যখন ধৃতরাষ্ট্র নিজের পুত্র দুর্যোধনের অহঙ্কার চূর্ণ করার জন্য বলেছিল, তুমি তো জুয়া খেলে পাণ্ডবদের হারিয়েছো। ধৃতরাষ্ট্র তখন বলে,
যার যাহা বল তাই তার অস্ত্র।
নখে দন্তে নহিকো ব্যাঘ্র সমান
তাই বলে ধনুশ্বরে বধি তার প্রাণ কোন নর লজ্জা পায়?

 

রবীন্দ্রনাথের রচনায় ধৃতরাষ্ট্রের সংলাপের এই বাক্যগুলো বুঝিয়ে দেয়, মানুষ নিজের নখদন্তু দিয়ে যদি বাঘের সঙ্গে লড়তে যেতো নির্ঘাত প্রাণ হারাতো। মানুষ বাঘের সঙ্গে জয়ী হয় কীভাবে? দূর থেকে তীর ধনুক ছুড়েই। মানব সভ্যতার সব কথা এইখানে লুকিয়ে আছে। মানুষ যে আদিম সমাজ থেকেই অস্ত্র ছুড়তে বা ব্যবহার করতে জানে সেটাই তার সভ্যতা বিকাশের মূল কথা। মানুষের বড় বড় সাহিত্য তাই যুদ্ধ দ্বারা পরিপূর্ণ। সেখানে আছে নানা অস্ত্র ব্যবহারের কলাকৌশল। মহাভারত ইলিয়ড অডিসি সবই তাই। মহাভারতের সেই যুগের বিবাদমান দুই পক্ষের দেবতারা আসলে আজকের পরাশক্তি দেশগুলো। পরাশক্তিরা আজ ইউক্রেন আর রাশিয়ার পক্ষে বিভক্ত হয়ে দুপক্ষকে উস্কানি দিয়ে চলেছে। যুদ্ধ এবং অস্ত্রই হচ্ছে মানব সভ্যতার আদিকথা। মার্কস আশা করেন, ‘সাম্যবাদ’ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই তবে যুদ্ধ আর অস্ত্র বাতিল করা সম্ভব হতে পারে।

 

মানুষ যখন থেকে চাষবাস করতে আরম্ভ করে তখন থেকে সে হয়ে দাঁড়ায় দখলদার। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী চাষাবাদ করতে জানে না। সে কারণে অন্য প্রাণীদের মানুষের মতন এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের দরকার পড়ে না। মানুষ যতদিন শুধুমাত্র শিকারী জীবন যাপন করেছেন, শিকারের পিছনে ছুটে বেড়িয়েছে। কারণ পশুকে বধ করতে হলে পশুর পেছনে ছুটে বেড়াতে হবে। সেই আদিম যুগে ঘন জঙ্গলে মানুষের বিদ্যা বুদ্ধি ছিল না। মানুষের হাতে মানচিত্র ছিল না। মানুষের ঘর বাড়ি ছিল না। বৈবাহিক জীবন বা ঘর সংসার ছিল না। কারণ সেসবের দরকার ছিল না। দলবদ্ধভাবে মানুষ শিকার করতো বা ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করতো। শিকার করার জন্য পশুর পেছনে ছুটতে ছুটতে সে ঘন অন্ধকার জঙ্গলে কোথা থেকে কোথায় চলে যেতো নিজেরাই জানতে পারতো না। কিন্তু যখন মানুষ চাষাবাদ শিখলো, এই ছুটে বেড়ানো বন্ধ হলো। কারণ ফসলের বীজ বপন থেকে ফসল জন্মাতে অনেক দিন লেগে যায়। ফলে মানুষকে চাষাবাদের স্বার্থে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধতে হলো। মানব সভ্যতার সকল অঘটন এখান থেকেই শুরু।

 

চাষাবাদ করতে গিয়ে মানুষ প্রথমবার দখলদার হলো। প্রকৃতির জমি দখল করে তার উপর নিজের মালিকানা দখল করলো। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী প্রকৃতির উপর দখলসত্ব সৃষ্টি করেনি। মানুষ প্রজাতির সবাই আগে ছিল দলবদ্ধভাবে শিকারী এবং খাদ্য সংগ্রহকারী। কিন্তু এইবার মানুষের মধ্যে শ্রমের বিভাজন হলো। কিছু মানুষ শিকারী থাকলো, কিছু মানুষ চাষাবাদ যুক্ত হলো। জমির দখল নিয়ে মানুষ মানুষে যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধকে ঘিরে এলো প্রতিষ্ঠান এবং নতুন নতুন পেশা। কেউ সৈন্য হলো, কেউ সেনাপতি হলো। মানুষ আর সেই আদিম সমাজের মানুষ থাকলো না। চাষাবাদকে ঘিরে যুদ্ধ, পঞ্জিকা, নানান নতুন প্রযুক্তি এলো। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ বন্যা, ভূমিকম্প, ঝড়-বাদল, দাবানল, মহামারী দেখে মানুষের মনের ভয় থেকে দেবদেবীর কল্পনা এলো। সেইভাবে ধর্ম এলো। জন্ম, মৃত্যু, শোক, সবকিছু ঘিরে মানুষের কল্পনায় এলো কতো রকম চিন্তা। মানুষ জানতে চাইলে নিজের পরিচয়, জানতে চাইলো জগতের এবং নিজের জন্মের উৎস। মানুষের রাজ্যে এভাবে কতরকম চিন্তা এবং বিপরীত চিন্তা এলো। কতো রকম শিল্প সাহিত্য জন্ম নিল। ভাষা এলো, অক্ষর এলো।

 

সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্ক নতুন রূপ নিয়ে বিবাহ নামক পরিবার এলো। কতোরকম ঘটনা, কতোরকম কার্যকারণ, কতো রকম মত বিনিময়, যুদ্ধ এবং কতো রকম আকাঙ্ক্ষা পথ বেয়ে, কতো সমাজব্যবস্থা পার হয়ে আটশো নয়শো বছর আগে এলো বর্তমান সময়ের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ।

 

বর্তমান সমাজ হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ। গত পঞ্চাশ হাজার বা একলক্ষ বছরে কতো রকম পরিবর্তন, কতো রকম সমাজ বিবর্তন, কতো রকম বিপ্লবের পর এসেছে পুঁজিবাদী সমাজ। মূলত ইউরোপের রেনেসাঁ ভিতর দিয়ে এই পুঁজিবাদী সমাজের যাত্রা শুরু। পুঁজিবাদী সমাজের আগে যেসব সমাজ এসেছে কিছুই চিরকালীন হয়নি। মার্কস এঙ্গেলস তাই মনে করেছেন পুঁজিবাদী সমাজও টিকবে না। কারণ মানব সভ্যতার আগের সব সমাজব্যবস্থা বিলোপ হয়ে বা পাল্টে গিয়ে পুঁজিবাদ এসেছে। পুঁজিবাদী সমাজ পাল্টে আবার নতুন সমাজ গঠিত হবে। ইতিহাসের এটাই নিয়ম। মানুষের কোনো সমাজ কোনো সভ্যতা কোনো উৎপাদন ব্যবস্থা চিরকাল টিকে থাকে না। মার্কস বলেন, এখানে দুটা ঘটনা ঘটতে পারে। সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাল্টাতে পারে পরিবর্তনের নিয়মে। কিংবা মানুষ চাইলে সচেতনভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়ম মেনে সেখান পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কিন্তু আগের যুগের মানুষরা সচেতনভাবে চিন্তা করে, হিসাব নিকাস করে সমাজ পাল্টায়নি। মানুষের সংগ্রামের ভিতর দিয়েই পাল্টেছে, তবে ইচ্ছা-নিরপেক্ষেভাবে।

 

বর্তমান সমাজ মানুষ পাল্টাবে ইতিহাসের সচেতন সাক্ষী হয়ে। মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তার এটা আর একটা দিক। মার্কস দেখিয়েছেন আগের সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের শ্রেণীসংগ্রামের ভিতর দিয়েই। মানুষ প্রথম সমাজসচেতন ছিল না। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবে মানুষ সমাজসচেতনভাবে নতুন কিছু ঘটাবার কথা ভেবেছিল। কিন্তু মার্কসবাদ মানুষকে সমাজবিজ্ঞান সচেতন করার প্রশ্নটিকে সামনে আনেন। দর্শনের জগতে মার্কসের এটা এক বিশেষ অবদান। সমাজ সচেতন আর সমাজবিজ্ঞান সচেতন দুটো কথার মধ্যে পার্থক্য কী? মানুষ সমাজে অন্যায় দেখে যখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, সংগ্রাম করার আগ্রহ দেখায় মানুষ তখন সমাজ সচেতন মানুষ। কিন্তু সেই সংগ্রামের সুফল মানুষ লাভ করতে পারে না। কারণ সমাজ বিকাশের নিয়মগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে মানুষ তা করে থাকে। কিন্তু মানুষের এখন সংগ্রাম করার জন্য সমাজবিজ্ঞান এবং ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপট খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং বিচার করতে হবে মূল সংগ্রামের আগে। সমাজ সচেতন এবং সমাজবিজ্ঞান সচেতন প্রসঙ্গটি পরের পর্বের আলোচনায় বিস্তারিতভাবে আবার আসবে।

 

মার্কস বহু কিছু লিখে গেছেন। তিনি মানুষের ইতিহাসকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সেইসঙ্গে বলেছেন, নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে, পূর্বের জ্ঞান এবং তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা যতোটা সম্ভব বলে গেছেন। কিন্তু এই বলাটাই চূড়ান্ত নয়, কেউ যেন এই বলাটাকে চূড়ান্ত ধরে না নেয়। স্বতঃসিদ্ধ মনে না করে। নতুন অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের আলোকে তাঁর চিন্তার অনেক ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কারণ পূর্বের মনীষীরা কেউ জ্ঞানচর্চা করার মধ্য দিয়ে সব সত্য বলে যেতে পারেননি। কখনো কারো পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। যদি একজন সব বলে যেতে পারতেন তাহলে বারবার মনীষীদের আসতে হতো না। সেই একই প্রক্রিয়ায় মার্কস এঙ্গেলস পৃথিবীর সব সত্য বলে যাননি। বলা সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে সব সত্য আপাত, সব চিন্তা পরিবর্তনশীল। ইতিপূর্বে দার্শনিকরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কথাটা বলে যাননি। মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের আলোকে সেই সত্যটা বলে গেছেন। তিনি বিশ্বের জ্ঞান চর্চাকে নিজের জায়গায় এসে থামিয়ে দেননি। তিনি বলেছেন সেটা প্রবাহমান। নিজের চিন্তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি এভাবেই সচেতন ছিলেন।

 

প্রায় প্রত্যক ধর্ম যেমন মনে করে তার চিন্তাই শ্রেষ্ঠ, মার্কস এমন কোনো চিন্তাদ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন না। মার্কস জ্ঞানচর্চার সূত্রকে এই যে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন, সেটাই মার্কসবাদ। ফলে পরবর্তী ক্ষেত্রে যা ঘটলো, একদল মার্কসের চিন্তাকেই দিনে দিনে আরো অনেক অভিজ্ঞতার দ্বারা এগিয়ে নিলেন। কারণ মার্কস তাঁদের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টি করে রেখে গেছেন। বর্তমান দুনিয়ায় তাই এখন যা ঘটছে, হয় মার্কসবাদকে বিরোধিতা করতে হবে। নতুবা পুঁজিবাদী সমাজকে পাল্টাবার জন্য মার্কসের তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে মার্কসের তত্ত্বের ভিতর অসঙ্গতি থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। সেই আলোকেই সাম্যবাদের পক্ষে মার্কসের চিন্তাকে বাস্তবের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে বিপ্লব সংঘটিত করা।

 

মার্কস যে যুগে এসে তাঁর চিন্তার ভাবনার বিকাশ ঘটান সেটা ছিল আধুনিক যুগ। ইউরোপের রেনেসাঁর সময় থেকে আধুনিক যুগ চিহ্নিত হয়ে আসছে। কারণ এই যুগে মানবতাবাদের উত্থান ঘটে। মানবতাবাদ মানে যখন মানুষ মনে করতে শুরু করে মানুষের সকল কাজের দায়ভার মানুষের নিজের। সেখানে ঈশ্বর বা দেবদেবী কারো অস্তিত্ব নেই। মানুষের সৃষ্টিশীলতার পেছনে কোনো ঈশ্বর বা অতিলৌকিক অবধান নেই। মানুষ নিজের চেষ্টা আর প্রতিভার দ্বারা এসব করে থাকে। ইউরোপের রেনেসাঁর সেই চিন্তাকে মার্কস এঙ্গেলস আরো এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁর বিজ্ঞানমনস্ক জগত ছিল বস্তুবাদী। কিন্তু তা ছিল যান্ত্রিক বা জড় বস্তুবাদ। মার্কস তাকে দাঁড় করালেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে। রেনেসাঁর ভিতর দিয়ে বুর্জোয়াদের উত্থান ঘটে। জন্ম নেয় পুঁজিবাদী সমাজ। মার্কস এঙ্গেলস রেনেসাঁ আর ফরাসী বিপ্লবকে প্রগতিশীল আন্দোলন মনে করছিলেন। কিন্তু সেখানেই আলোচনা থামিয়ে দেনন। কালের বিবর্তনে পরে বিচার করে দেখিয়ে দিলেন ধনতন্ত্রের আর প্রগতিশীল ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। ভয়াহব শোষণের রূপ নিয়েছে তা।

 

ফলে সেই পুঁজিবাদী সমাজের বিলোপ ঘটিয়ে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটিয়ে সেখানে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবাই মার্কস এঙ্গেলসের এই সূত্র মেনে নেয়নি। যাঁরা উত্তর আধুনিক চিন্তার ধারক বাহক, বুঝে হোক না বুঝে হোক তাঁরা মার্কসের চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করছেন। পরের পর্বগুলোতে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। চলবে