রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘মাদ্রাসা শিক্ষা ও রামমোহন রায়’

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০২১

মুসলমানরা যখন ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করে তারা ভারতের আগের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বা নিষিদ্ধ করে দেয়নি। কারো উপর জোর করে মাদ্রাসা শিক্ষা চাপিয়ে দেয়নি। ভারতীয় শিক্ষার সঙ্কটের কথা বলতে গিয়ে তিনজন শিক্ষাবিদ বেবী দত্ত, মধূমালা সেনগুপ্ত ও দেবিকা গুহ তাদের ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাস্তবিক শিক্ষার ইতিহাসের বিকাশধারার মধ্যে আমাদের বর্তমান অনেক শিক্ষা সমস্যার শিকড় ব্রিটিশ শাসন থেকে আবিষ্কৃত হতে পারে বলে আমাদের ধারণা। ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কয়েকটি কথা স্মরণ রাখা দরকার। বাইরে থেকে আগত বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার সুদৃঢ় বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরবর্তীকালের বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবকে আত্মভূত করে নিয়েছিল। ইসলামিক বা মুসলমান শাসকদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে হিন্দু শিক্ষা-সংস্কৃতি সহবস্থান করেছিল। মুসলমানরা আগের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি কিন্তু নিজেরা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা পরবর্তীকালে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতিকে আত্মভূত করা, সমন্বয় করা এবং পরিবর্তন করা সবসময় মসৃণ এবং যথাযথভাবে হয়নি, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিদিনের চাহিদা অনুসারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তুত ছিল না। এই কারণে আমাদের বর্তমানের শিক্ষাক্ষেত্রে এতগুলি সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া নানান নীতির কারণে পূর্বের প্রগতিশীল ধারা আর মাদ্রাসায় বজায় রাখা যায়নি।

ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল সে যুগের তুলনায় খুবই আধুনিক। ব্রিটিশ শাসনে এ শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকে। বাংলার রামমোহন রায় তৎকালে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছন। বিজিতকুমার দত্ত লিখেছেন, ‘রামমোহনের শিক্ষার আরম্ভ রাধানগর গ্রামেই হয়েছিল। নবাব দরবারে চাকরি করতে গেলে আরবি-ফারসি শিক্ষার প্রয়োজন। রামমোহনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পাটনায়। আরবি-ফারসিতে রামমোহন কেবল বিদ্যাচর্চাই নয়, একেবারে মজে গেলেন। এই দুই ভাষাকে এমন আয়ত্ব করলেন যে এ ভাষায় কথা বলতে, আলোচনা করতে, চিন্তাভাবনা করতে তার অসুবিধাই হতো না। এমনকি কঠিন জিনিসকে পর্যন্ত তিনি সহজ করে লিখতে পারতেন আরবি-ফারসিতে।’ রামমোহন মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন ইংরেজ শাসনে। মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্ত করে রামমোহন সংস্কৃত শিক্ষার জন্য কাশীতে চলে যান। সুরজিৎ দাশগুপ্ত রামমোহনের শিক্ষা সম্পর্কে লিখেছেন, রামমোহন সতেরশো বাহাত্তর খ্রিস্টাব্দের বাইশে মে এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রামমোহনের পিতা রামকান্ত রায় অন্দরের প্রসঙ্গে রক্ষণশীল হলেও সদরের প্রসঙ্গে বাস্তববাদী ছিলেন। ছেলেকে ঘরে সংস্কৃত শিখিয়ে আরবি ও ফারসি শেখাবার জন্য পাটনাতে পাঠালেন, কেননা দুটোই ছিল তখন জীবিকা অর্জনের ভাষা।

ইংরেজ শাসিত ভারতে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত আরবিব-ফারসি শিক্ষার যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। বিশেষ করে ফারসি তখন ছিল আইন-আদালতের ভাষা। মধুসূদন দত্তের পিতা রাজনারায়ণ ছিলেন ফারসিতে সুপণ্ডিত, সেজন্যই তাকে বলা হতো মুন্সি রাজনারায়ণ। ফারসি ছিল জীবিকা অর্জনের ভাষা; ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা। রাজানারায়ণ দত্ত যখন হঠাৎ একদিন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় উপস্থিত হন তখন কলকাতার আদালতে কাজকর্ম চলছে ফারসিতে। সকল আইনজীবীদের সদর দেওয়ানি আদালতে সওয়াল করতে হয় ফারসিতে, ইংরেজি শিক্ষিত ব্যারিস্টারদের তখন সেখানে বিশেষ প্রতিপত্তি নেই। রাজনারায়ণ আইন ব্যবসায় যুক্ত হয়ে তখন দু’হাতে টাকা রোজগার করে চলেছেন। ফারসি ভাষার উপর দখল খুব কাজ দিয়েছিল এক্ষেত্রে। ফলে সদর দেওয়ানি আদালতে তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা আর খ্যাতি পেয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে তিনি আদালতে টেক্কা দিয়ে চলতেন। প্রবাদ ছিল, রাজনারায়ণ তখন টাকা গুণে খরচ করতেন না। কিন্তু হঠাৎ যখন ১৮৩৫ সালে ইংরেজ উচ্চশিক্ষা আর আদালতের ভাষা করে দিয়েছিল ইংরেজি, বিপদে পড়েছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত। রাজনারায়ণের দত্তের আয় হ্রাস পেল; পসার আর জমছে না। রাজনারায়ণের আর্থিক ভিত নড়ে গেল।

রামমোহনকে কেন ফারসি শিখতে পাটনা পাঠানো হয়েছিল, উপরের ঘটনায় সেটা স্পষ্ট বোঝায় যায়। রামমোহন পাটনায় পড়তে যান সম্ভবত ১৭৯০ এর আগেই। বাংলায় তখন ফারসি শিক্ষার মর্যাদা অনেক বেশি। রামমোহন ঠিক কবে মাদ্রাসায় পড়তে যান তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। রামমোহনের মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, গ্রীক চিন্তাধারাতে প্রভাবিত মুতাজিলারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের জন্য কুকর্ম বরাদ্দ করে স্রষ্টা আবার তারই জন্যে মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। তিনি স্বাধীন চিন্তা আর কর্মের অধিকার দিয়েছেন মানুষকে, আপন স্বাধীনতাতে সে যা নির্বাচন করে তারই জন্যে স্রষ্টা কর্তৃক পুরস্কৃত বা দণ্ডিত হন। কুরআন সম্পর্কে তারা মনে করতেন, পবিত্র গ্রন্থ চিরন্তন বা অসৃষ্ট হতে পারে না; তাহলে পবিত্র গ্রন্থ স্বয়ং স্রষ্টার সমকক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র স্রষ্টাই চিরন্তন আর অসৃষ্ট। সুফি ও মুতাজিলাদের বে-শরা বা শাস্ত্রবহির্ভূত চিন্তাধারা কিশোর রামমোহনের চেতনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। উপরন্তু এই সংযোগে রামমোহনের চিত্তে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মেছিল। রামমোহন এরূপ সিদ্ধান্তেও উপনীত হন যে, ঈশ্বর এক, তিনি নিরাকার, সর্বত্র আবির্ভূত এবং ঈশ্বর যখন এক তখন তাঁর সৃষ্টিও এক এবং মানবসমাজও এক। মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে মুতাজিলাদের কাছ থেকেই তিনি এ ধারণা লাভ করেছিলেন, স্রষ্টার সৃষ্টি জীব হিসেবে মানুষ কর্মে এবং চিন্তায় স্বাধীন। রামমোহন একেশ্বরবাদের দৃষ্টি নিয়ে ১৮০৪ সালে লিখেছিলেন ‘তুহ্ ফত্-উল্-মুওয়াহিদ্দিন্’ নামের চাঞ্চল্যকর একটি পুস্তিকা। বইটির নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘একশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার’। পুস্তিকাটির ভূমিকা তিনি লিখেছিলেন আরবি ভাষায় আর মূল বক্তব্য লেখেন ফারসি ভাষায়। পরপর প্রকাশিত হয় আর একটি বই ‘মনজরাৎ-উল-আদিয়ান’ বা ‘বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা’। প্রথম পুস্তিকাটিতে রয়েছে পাটনা ও বারাণসীতে অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের সুস্পষ্ট প্রয়াস। দ্বিতীয় বইটির কোনো অনুলিপি পাওয়া যায় না।  প্রথম পুস্তিকাটির একটি বাংলা অনুবাদ রয়েছে।

বিজিত কুমার দত্ত জানাচ্ছেন, ইংরেজ শাসনের প্রথম যুগে রামমোহন যখন পাটনায় পড়তে যান, পাটনা ছিল সেসময়ে আরবি-ফারসি শেখার রাজধানী। রামমোহন আরবি-ফারসি ভাষায় পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। আর সেইসূত্রে ইসলাম ধর্মের সব কিছু রামমোহন জেনে নিলেন। কুরআন শরিফ পড়ে তিনি মুগ্ধ হলেন। তিনি প্রতিমা পূজা আর বিশ্বাস করতে পারলেন না। রামমোহন একশ্বেরবাদী হয়ে উঠলেন। ইসলাম ধর্মের উপাসকদের মধ্যে মুতাজিলা সম্প্রদায় সববিষয়ে তর্কেবিতর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। মুতাজিলারা সবকিছুকে বিচার করে দেখতেন আর হিন্দু-মুসলমান বিভেদ মানতেন না। রামমোহন এদের কাছে পেলেন এক উদার ধর্মের রূপ। সে ধর্মে সকলের মিলেমিশে থাকার কথা। কিছুকাল পরে তিনি সুফি মরমিয়াদের ধর্মকে জেনে আরো খুশি হয়েছিলেন। হাফিজ ও রুমি তাঁর কণ্ঠস্থ হয়ে গেল। বিজিতকুমারের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, মাদ্রাসা শিক্ষায় তর্ক-বিতর্কের জায়গা ছিল। ইসলাম ধর্মকে অন্ধভাবে মেনে নেয়ার শিক্ষাই শুধু মাদ্রাসায় দেয়া হতো না। বিভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ ছিল। বিজিতকুমার জানাচ্ছেন, রামমোহন এরপর চলে গেলেন কাশীতে। বেদ, বেদান্ত ও পুরাণ চর্চার কেন্দ্র ছিল কাশী। রামমোহনের তখন মন তৈরি হচ্ছে একশ্বরবাদের দিকে; একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি ভারতের জ্ঞানের ভাণ্ডার উপনিষদের পাঠ নিলেন। ব্রহ্মসূত্র পড়লেন। গীতাকে বুঝে নিতে চাইলেন। হিন্দুধর্মের শাস্ত্র সবই পড়লেন; পড়লেন, ষড়দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতিনিবন্ধ। কিন্তু উপনিষদ পড়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন প্রতিমাপূজার কোনো মানে হয় না। প্রতিমাপূজা সম্পর্কে যেটুকু বিশ্বাস ছিল একেবারে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল উপনিষদের জ্ঞান লাভ করে। কুরআনের একেশ্বরবাদ আর উপনিষদ মিলে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বহু প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে, তিনি হয়ে উঠলেন একেশ্বরবাদ ‘ব্রহ্মার’ উপাসক।

রামমোহনের প্রথম দুটি বইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে বলে জানা যায় না। বই দুটি আরবিব-ফারসিতে লেখা হওয়াতে হিন্দু-সমাজপতিদের কাছে দুরধিগম্য হয় এবং সেকারণেই সে-দুটি পুস্তিকা পণ্ডিত-সমাজের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। রামমোহন এরপর বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলেন বেদান্ত গ্রন্থ। বইটির নামপত্রে রামমোহন বেদান্তকে শ্রেষ্ঠ সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ বলে উল্লেখ করলেন। পাশাপাশি এও লিখলেন সেখানে, একমাত্র ব্রাহ্মই সকলের পূজ্য। আঠারশো পনেরো সালে বইটি বের হবার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ঘুম ভাঙলো। রামমোহনের বক্তব্যের কঠোর জবাব দিলেন তারা। রামমোহনও থেমে থাকেননি, বেদান্তের সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নিলেন। রামমোহনের বিরোধীরা প্রতিবাদের সময় কখনো কখনো ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করেছেন। গালিগালাজ করেছে এমন ভাষায়, যে ভাষা লেখা যায় না। কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন রামমোহনকে পাষণ্ড বলেছেন। তাদের দৃষ্টিতে রামমোহন যে সংস্কৃত বাদ দিয়ে বাংলা ভাষায় শাস্ত্র আলোচনা করেছেন সেটাই অতি অন্যায় কাজ। তারা রায় দিলেন, রামমোহন অধার্মিক, পাপী; কারণ তিনি ম্লেচ্ছ, অস্থানে তাঁর যাতায়াত। রামমোহন ধর্মসংহারক; দেবতাদের মূর্তিপূজা বন্ধ করতে চান আর বহুদেবতার অস্তিত্বই মানছেন না।  
রামমোহন রচিত প্রথম বাংলা ভাষার পুস্তিকা দুটি প্রকাশিত হবার পর তিনি ধর্মীয় কট্টর মানুষদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। প্রথম বাংলা পুস্তিকাটিতে রামমোহন তীব্রভাবে মূর্তি পূজার বিরোধিতা করেছিলেন। রামমোহনের লেখা বাংলা গ্রন্থ দুটি আসলে তাঁর ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ পুস্তক। হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ যেমন রামমোহনকে বিরোধিতা করেছিলেন, তেমনি খ্রিস্টান মিশনারী সম্প্রদায় রামমোহনের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন। কারণ মিশনারিদের ধর্মমতের গোঁড়ামি আর ভুল কোথায় তা তিনি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মিশনারীরা তখন হিন্দুধর্মের প্রতি আক্রমণ শুরু করলেন। মানোএল দ্য আসুম্পসাঁও এবং দোম আন্তিনিও হিন্দুধর্মকে পতিতের ধর্ম বলেছিলেন। রামমোহন মূর্তিপূজার বিরোধী, মিশনারীরাও সেই মতে বিশ্বাসী। সেকারণে প্রথম রামমোহনের সঙ্গে মিশনারীদের বন্ধুত্ব ছিল। রামমোহন শ্রীরামপুরে মিশনারীদের সভায় চলে যেতেন। মিশনারীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে যে রামমোহন বিশ্বাস করে এই প্রচার দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছিল। বিদেশেও তখন রামমোহনের ধর্মমত নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ মিশনারীরা রামমোহনের প্রতি বিরূপ হলেন যখন রামমোহন ১৮২০ সালে লিখলেন, ‘দি প্রিসেপ্টস অব জেসাস, গাইড টু পিস এ্যান্ড হেপিনেস’ বইটি।

রামমোহন খ্রিস্টধর্মের সার সংকলন করেছিলেন এই বইটিতে। আর জোর দিয়ে বলেছিলেন বাইবেলের অলৌকিক ঘটনাবলি এবং যিশুর ঈশ্বরত্ব মেনে নেয়া যায় না। রামমোহন ঈশ্বর ছাড়া আর কোনো প্রেরিত পুরুষে বিশ্বাসী ছিলেন না। ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যার সময়েও তিনি পয়গম্বরত্বে আস্থা স্থাপন করতে পারেননি।  তিনি মনে করতেন মুহাম্মদ একজন নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক; কিন্তু তিনি ঈশ্বরের দ্বারা বিশেষভাবে প্রেরিত কোনো মানুষ নন। তিনি ইহজাগতিক একজন সাধারণ মানুষ। রামমোহন তুহ্ ফত্-উল্-মুওয়াহিদ্দিন্ পুস্তিকায় লিখেছিলেন, সুতরাং এটা দেখা দরকার যে, পয়গম্বর পাঠানো ও তাদের কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রকাশ সোজা তাঁর কাছ থেকে হয়, না কোনো ‘মধ্যবর্তীর’ সাহায্য দরকার হয়। প্রথমটা সত্য হলে মুক্তির পথ দেখাবার জন্য কোনো মধ্যবর্তীর দরকার হয় না। এবং পয়গম্বরের কিছু করবার বা বাণী দেবারও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আর দ্বিতীয়টা হলে তো একটার পর একটা করে বহু ‘মধ্যবর্তীর’ দরকার হবে। সুতরাং এই পয়গম্বরের আবির্ভাবের এবং বাণী প্রকাশের সঙ্গে অন্যান্য বহির্জগতের বস্তুর মতোই ঈশ্বরের সম্পর্ক কোনো নেই। তাছাড়া এক জাতি যাকে সত্যধর্মের একমাত্র পথপ্রদর্শক বলে থাকে, অন্য জাতি তাকেই ভুল পথের নির্দেশক বলে।  
কিন্তু নবি সম্পর্কে এসব কথা জন্য মুসলমানদের দিক থেকে রামমোহনের উপর কোনো আক্রমণ আসেনি। ভারতের মুসলমানদের মধ্যে তখনো ধর্মীয় বিষয়ে বিধর্মীদের প্রতি খুব একটা আক্রমণাত্বক হতে দেখা যায় না। মুসলমানরা মুঘল যুগেও বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্বক ছিল না।  বরং মুসলমানরা শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা লড়াই করেছে। রামমোহনের যুক্তিবাদী মন তৈরি করে দিয়েছিল মাদ্রাসা। তিনি সেজন্যই যুক্তিতর্কের অবতারণা করে লিখেছিলেন আরবি আর ফারসি ভাষায় ‘তুহ্ফাৎ উল মুয়াহহিদ্দিন’ এবং ‘মনজরাৎ-উল-আদিয়ান’। রামমোহন ধর্মহীন বা নাস্তিক ছিলেন না, ছিলেন একশ্বরবাদী। ইসলাম সম্পর্কে রামমোহনের চিন্তার সঙ্গে বহু মুসলমান পণ্ডিতের চিন্তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘ভারতের ইতিহাসে রামমোহনের অধিক পরিচয় সমাজ-সংস্কারক ও ধর্ম সংস্কারক রূপে। কিন্তু কোন্ সমাজের বা কোন্ ধর্মের সংস্কার করেছিলেন তিনি?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে তিনি হিন্দুধর্মের বা হিন্দু সমাজের সংস্কার সাধন করেছিলেন। রামমোহন একা নন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ অনেকেই সে-সময়ে হিন্দুধর্মের বা হিন্দু সমাজের নানা সংস্কার সাধনে মন দিয়েছিলেন। ফলে হিন্দু সমাজ যে অনেক বেশি কুসংস্কার আচ্ছন্ন ছিল সেটা নবজাগরণের বহু বড় বড় নেতার সংস্কার আন্দোলন থেকেই ধরে নেয়া যায়। হিন্দুধর্মে কুসংস্কার না থাকলে হিন্দুধর্ম বা হিন্দুসমাজে সংস্কার আনার দরকার ছিল না। হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সমাজের সংস্কারের পক্ষে পরবর্তীতে কলম ধরেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। হিন্দুসমাজ কতটা কুসংস্কারের আগলে আটকে ছিল এসব ঘটনা তার প্রমাণ। রামমোহন তখন নানাভাবেই হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করেছিলেন। ইংরেজ সরকার ১৯২৪ সালে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করলে রামমোহন ১৮২৩ সালে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়ে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতশিক্ষা অত্যন্ত কঠিন। এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে একজন মানুষের পুরো জীবনটাই কেটে যায়। এই সময় দিলে শিক্ষা কতটা এগোবে? আর সংস্কৃত ব্যাকরণ? তার খুঁটিনাটি জানতে হলে, সংস্কৃত ব্যাকরণবিদরাই বলেছেন, বারো বছরের কমে তা সম্ভব নয়। এ বোঝা ছাত্রদের বইতে হলে শিক্ষার উন্নতি অসম্ভব।’  তিনি আরো বললেন, ‘বেদান্ত, মীমাংসা কিংবা ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা খুব যে উপকারে লাগবে তাও মনে হয় না। সংস্কৃত শিক্ষা দেশের লোককে অন্ধকারেই রেখে দেবে।

রামমোহন রচিত প্রথম বাংলা গ্রন্থ হলো ‘বেদান্ত গ্রস্থ’। তিনি নিজে বেদান্ত আলোচনা করেছেন, অথচ এর পঠন-পাঠনের উপযোগিতা সম্পর্কে গুরুত্ব দিচ্ছেন না লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে। তিনি মনে করছেন. সংস্কৃত বা বেদান্ত পড়ানো হলে শিক্ষার্থীর লাভ হবে না; শিক্ষার্থী শিক্ষার ভার বইবে শুধু। রামমোহন প্রস্তাব করেছিলেন, প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য জেনে বিশেষ কিছু হবে না বরং ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান যথা; গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শরীর-সংস্থানবিদ্যাসহ বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজন। রামমোহনের এই মতামত তখন সরকারের কাছে যুক্তিপূর্ণ মনে হয়নি।

রামমোহন হিন্দু-সমাজের সতীদাহ, হিন্দু সমাজের বহুবিবাহ, হিন্দু সমাজের কন্যাপণ ও কন্যাবিক্রয়, হিন্দুনারীর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চনা ইত্যাদি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। নারীর বিধবাবিবাহ এবং নারীর জন্য শিক্ষার কথা বলেছিলেন বিদ্যাসাগর। রামমোহন জন্মেছিলেন বহু দেবদেবীর মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী হিন্দু আচারনিষ্ঠ কুলিন ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু মাদ্রাসার পাঠ সমাপ্ত করার পর পিতামাতার সঙ্গে তাঁর চিন্তার বিরোধ বাধে। পাটনার মাদ্রাসায় পড়াশুনা সমাপ্ত করে রামমোহনের গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর পিতা রমাকান্ত রায়ের সঙ্গে হিন্দুদের দেবদেবী-আচারপ্রথা ইত্যাদি বিষয়ে দুজনের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। সুরজিৎ ঘোষ জানাচ্ছেন, পাটনা থেকে ফিরে আসার পর রামমোহন প্রচলিত ধর্মবিরোধী এমন কিছু লিখেছিলেন যা পিতার চোখে পড়ে আর পিতার কাছে সেজন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়। মাতা তারিনীদেবীর ইচ্ছা অনুসারে তখন রামমোহনকে বারাণসীতে পাঠানো হলো সংস্কৃত ভাষা, ব্যাকরণ, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে। প্রখর বিষয়বুদ্ধি-সম্পন্ন তারিনীদেবী দেখলেন যে, রামমোহন পাটনা থেকে বিদ্যায় ও বিশ্বাসে ‘মুসলমান’ হয়ে এসেছে, পুত্রকে আবার আচারে-বিচারে ‘হিন্দু’ করার জন্য তারিনীদেবী বারাণসীতে পাঠিয়েছিলেন। লক্ষণীয় যে, বারাণসীতে সংস্কৃত ও শাস্ত্র অধ্যয়ন করে রামমোহন এমন কোনো জ্ঞান লাভ করেননি যা তাঁর পরিবারের অথবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অভ্যাস-অনুশীলনের তথা বিচার-বিশ্বাসের পরিতোষক, যাতে তাঁর পিতার মানসিক শান্তি সংরক্ষিত হয়।’

রামমোহনকে বারাণসীতে পাঠিয়ে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেল না বরং বিপরীত ফলই দেখা গেল। তিনি সেখানে ‘ব্রহ্মসূত্র’ উপনিষদ বা বেদান্তগুলি পাঠ করে দেখলেন, ইতিপূর্বে পাটনাতে যে সত্য লাভ করেছিলেন ঠিক তারই সমর্থন পাচ্ছেন সংস্কৃত বেদান্তগুলিতে। স্পষ্ট করেই তাতে বহু দেবতার বদলে তিনি একশ্বরবাদের পক্ষে সমর্থন খুঁজে পেলেন। বিজিতকুমার মন্তব্য করছেন, রামমোহন এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ঈশ্বর এক এবং নিরাকার। মাত্র ষোল বছর বয়সে রামমোহনের মনে হয়েছিল অনেক দেবতা নেই। মাত্র আছেন এক দেবতা; তিনি ব্রহ্মা। হিন্দুধর্মে তখন কত দেবতা! রামমোহন সিদ্ধান্ত দিলেন, তারা সব বাদ যাবেন আর থাকবেন ব্রহ্ম এক।

সুরজিৎ দাসগুপ্ত লিখেছেন, রামমোহনের জীবন ও দর্শনের যথার্থ সূচনা হয়েছিল পাটনাতে। তিনি তখন আরব, পারস্য এবং গ্রীসের ধর্ম, দর্শন, গণিত, রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি জ্ঞাতব্য অনেক কিছুই পাঠ করেছিলেন এবং এমন তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন যার বৈশিষ্ট হলো এক, অদ্বিতীয় ও অমূর্ত ঈশ্বরে বিশ্বাস। তিনি মাদ্রাসায় শুধু ধর্মীয় শিক্ষা পাননি; দর্শন, গণিত, রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে শিক্ষা লাভের সঙ্গে সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। তিনি যে মাদ্রাসায় বিজ্ঞান পাঠ করেছিলেন তা ধারণা করা যায় পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ থেকে। মাদ্রাসাতেই তখন বিজ্ঞান পড়ানো হতো, কাশীর হিন্দু বিদ্যালয়ে তা পড়ানো হতো না। রামমোহন  বারবার শিক্ষার পাঠ্যক্রমে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শরীরতত্ত্ব পড়াবার কথা বলেছেন। পাশাপাশি তাঁর মিশ্র সূক্ষ্ম চিন্তা-ভাবনার ভিতরে ইসলামের তত্ত্ব বরাবর অনুস্যূত থেকেছে তা বোঝা যায় পরিণত বয়সে তাঁর রচিত ‘মনে কর শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ গানটির মধ্যে। সত্যি বলতে শেষ বিচারের দিন সম্বন্ধে কোনো ধারণাই বেদান্তে নেই, ধারণাটি একান্তভাবে ইসলামীয়। পাটনার বিদ্যার্থী জীবনে যে-জ্ঞান, যে-বোধ ও যে-সত্য তিনি অর্জন করেছিলেন, সেগুলিকে তিনি সযত্নে তাঁর জীবনের বুনিয়াদ রূপে স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সেই সুদৃঢ় বুনিয়াদের উপরেই নির্মাণ করেছিলেন এক নতুন স্থাপত্য, আর তা হলো বিপুল বেদান্তের স্থাপত্য। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে বেদান্তের ধারণাকে যোগ করে রামমোহনের চিন্তা বিস্তৃত হচ্ছিলো; পরে পাশ্চাত্যের নানা ধারণা তার সঙ্গে যুক্ত হয়।

রামমোহন নিরাকার একেশ্বরবাদে বিশ্বাস থেকে ১৯২৮ সালে স্থাপন করলেন ব্রহ্মসমাজ বা ব্রহ্মসভা। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মসভার অনুষ্ঠান হতো। একজন হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ বেদ আর উৎসবানন্দ বেদান্তবাগীশ উপনিষদ পাঠ করতেন। এই সভার একটি উদ্দেশ্য ছিল মূর্তিপূজা হবে না। সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, মনে রাখা ভালো যে তিনি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেননি এবং তাঁর পরিকল্পিত ব্রাহ্মসমাজের গৃহটি কোনো মন্দির নয়। গৃহটি নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নগরে তো মন্দির আছে, মসজিদ আছে, গির্জা আছে। নগরবাসী তো আপন আপন ধর্ম অনুসারে আপন আপন ধর্মগৃহে গমন করে আপন ধর্মীয় বিধান অনুসারে পূজা বা নামাজ বা ভজনা করতে পারে। তা হলে আবার একটি ধর্মগৃহ কেন?’ রামমোহনের ধর্মগৃহটির বৈশিষ্ট হলো এটির দরজা সবার জন্য খোলা। সব ধর্মের মানুষ এই গৃহে প্রবেশ করে বিশ্বস্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে পারে। কিন্তু সেই বিশ্বস্রষ্টার রূপ বা মূর্তি স্থাপন করতে পারবে না; তাকে কোনো নামে চিহ্নিত করতে পারবে না। বিভিন্ন ধর্মের যে-কেউ এই গৃহে এসে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ তৈরি করতে পারবে। রামমোহনের এই চিন্তার মধ্যে সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহীর সুর বেজে ওঠে।

মূলত মুসলিম মুতাজিলাদের বিশ্বাস এটা; সকল ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন। রামমোহন পাটনার মাদ্রাসা থেকেই এই ধারণা লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময় দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মধর্মে রামমোহনের এই চিন্তা বজায় থাকেনি। রামমোহণের ব্রহ্মসভা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে হয়ে গেল ব্রহ্মধর্ম; সব ধর্মের মানুষের অধিকারের জায়গায় সেটা হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ালো। বিবেকানন্দের কাছে ব্রাহ্ম হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠান হওয়ার পাশাপাশি ব্রহ্ম আর নিরাকার থাকলো না। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা রামমোহন কিন্তু মুসলমানদের সংস্কৃতির বহু কিছু নিজ জীবনে ধরে রেখেছিলেন; মুসলমানদের পোষাক-খাওয়া-দাওয়া কিছুই ত্যাগ করেননি।  

রামমোহন-গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন যে, রামমোহন মানিকতলার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে জোড়াসাকোর ব্রাহ্মসমাজে যেতেন, কিন্তু কখনো ধুতিচাদর পরে যেতেন না। তাঁর পোষাক ছিল মুসলমানি চোগা আর মাথায় পাকানো পাকানো কাপড় জড়ানো পাগরি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, রাজার সকল বন্ধুরাও রাজার ন্যায় পোশাক পরেই সমাজে যেতেন। শুধুমাত্র তাঁর পিতা দ্বারকানাথ ছিলেন সে-স্থলে নিয়মের ব্যতিক্রম। দ্বারকানাথ ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে ধুতি-চাদর পরে যেতেন, রাজা রামমোহন তা পছন্দ করতেন না। শুধু পরিধানের রুচিতে নয়, আহারের রুচিতেও রামমোহন আধা মুসলমান ছিলেন বলা যায়। তিনি শুধু দুবার আহার করতেন; প্রাতঃরাশে মাছ-ভাত খেতেন আর সান্ধ্য আহারে খেতেন পোলাও, কোপ্তা, কোর্মা ইত্যাদি মুসলমান রান্না। মুসলমানদের বাহ্য আচার-ব্যবহারের প্রতি রামমোহনের বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি দ্বারকানাথকে নিজ বাড়িতে ভালো রান্নার জন্য মুসলিম পাচক রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রামমোহন যে ছুঁৎমার্গ-এর বাইরে ছিলেন এসব ঘটনায় তা স্পষ্ট। তিনি তৎকালীন বর্ণহিন্দুদের বহু সংস্কার মান্য করার চেয়ে বিধর্মী মুসলমান এবং ইংরেজদের বহু অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন।

রামমোহনের উপর কুরআনের অনেক বাণী ও সূরার প্রভাব দেখা যায়। রামমোহন তাঁর প্রথম গ্রন্থে কুরআনের বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখেছেন, ‘যাকে ঈশ্বর সুপথে নিয়ে যান তাকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারে না, যাকে তিনি বিপথে নেন, তার পথপ্রদর্শক আর কেউ নেই।’ তিনি কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা বলেছেন তাঁর গ্রন্থে, ‘আমাদের নিকৃষ্টসত্তার এই সব প্রলোভন ও দুষ্কর্মজনিত অপরাধ হতে রক্ষা পাবার জন্য ঈশ্বরের শরণ মাগি।’ তিনি কুরআনের আন-নাস বা মানবজাতি শীর্ষক সূরার ভঙ্গিতে প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘হে ঈশ্বর, আমাকে অভ্যাস ও স্বভাবের পার্থক্য বোঝার শক্তি দাও।’ কুরআনের সূরা আর রাহমানে বলা হয়েছে, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে ভাষা দিয়েছেন, তাকে বুদ্ধি দিয়েছেন।’ ভিন্ন একটি সূরা আল-ইনসানে বলা আছে, ‘মানুষকে শ্রবণশক্তি এবং দর্শনশক্তি দেয়া হয়েছে আর তার সামনে রাখা হয়েছে দুটি পথ, যার তাৎপর্য হলো তাকে বিচার করতে হবে সে ভালো না মন্দ পথটা বেছে নেবে।’ রামমোহনের একটি উদ্ধৃতি যা ঐ দুটি সূরার বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। রামমোহন বলছেন, ‘ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি ও জ্ঞান দান করেছেন এবং কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা এভাবেই মানুষের বিচার করা উচিত যাতে ঈশ্বরদত্ত এই মহামূল্য দান বৃথা না হয়ে যায়।’  

রামমোহনের উপর কুরআনের কিছু প্রভাব রয়েছে তারমানে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তিনি অন্ধের মতো কুরআন থেকে সব শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি কোনো ধর্মকেই সম্পূর্ণ সঠিক বলে মনে করেননি। তিনি লিখেছেন, ‘সুতরাং কোনো বিশেষ পার্থক্য না করে বলা যায় যে, সকল ধর্মেই সাধারণভাবে কিছু কিছু ভ্রান্তি রয়েছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ তাদের অমূল্য সময় এমন সব পুরাণ কাহিনি পাঠ করে কাটায় যেগুলো বিশ্বাস করাও কঠিন। অথচ এতেই প্রাচীন ও নবীন নেতাদের উপর তাদের বিশ্বাস যেন আরও দৃঢ়তর হয়।’  তিনি সামান্য পরেই লিখেছেন, ‘যদি একটি চিন্তাশীল ব্যক্তিও হঠাৎ ওই মত ও বিশ্বাসের সত্যাসত্য অনুসন্ধান করবার একটু আগ্রহ দেখায়, তাহলে সেই ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত এরূপ প্রচেষ্টাকে শয়তানের প্ররোচনা বলেই ধরে নেয়।..সুতরাং এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে কোনো বিশেষ ধর্মমত আঁকড়ে ধরার পর, এবং সেই মতের সত্যাসত্য সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান না করে নির্বিচারে বহু বৎসর বিশ্বাস করবার পর, সেই সব ধর্মমতের সত্যিকার প্রকৃতি নির্ণয় করতে মানুষ সাবালক হয়েও সক্ষম হয় না।’ তিনি লিখেছেন, ‘যদি কোনো সুস্থ মনের লোকে একটি বিশেষ ধর্মমত গ্রহণ করার আগেই হোক কি পরেই হোক্, বিভিন্ন জাতির ধর্মমতের উপযুক্ত ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করে, তবে খুবই আশা করা যায় যে অসত্য থেকে সত্যকে, ও ভ্রান্তমত থেকে সত্যমত বেছে নিতে পারবে।’ তিনি কিছু পরে আবার মন্তব্য করছেন, ‘প্রত্যেক ধর্মই দেখি দাবি করে যে, সৃষ্টিকর্তা বুঝি একমাত্র সেই ধর্মেরই মতগুলি পালন করেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন..প্রত্যেক সম্প্রদায়ই নিজেদের কাজের সুফল ও অন্যদলের কাজের কুফল প্রত্যাশা করে মৃত্যুর পর...এবং অন্যেরা পরলোকের কোনো সুবিধাই পাবে না একথা কল্পনা করে।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাচীন ধর্মনেতাদের কিংবদন্তিতে বহু অসামঞ্জস্য তাদের কথার অসারতাই প্রমাণ করে।’

রামমোহন নিজে নাস্তিক ছিলেন না কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। রামমোহন ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলবার শিক্ষা পেয়েছিলেন মাদ্রাসাতে মুতাজিলাদের প্রভাবে। রামমোহনের উপর মাদ্রাসায় পড়ার প্রভাব শেষদিন পর্যন্ত ছিল; কিন্তু বাণারসের হিন্দু বিদ্যালয়ে পাঠ করার পরেও হিন্দু সংস্কৃতির বহু কিছু তিনি নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়েছিলেন। নিজেকে ব্রাহ্মণ দাবি করার পৈতাটা অবশ্য ছাড়েননি। তিনি লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণদের বিশ্বাস যে তাঁরা ঈশ্বরের কাছ থেকে অমোঘ আদেশ পেয়েছেন যে তাঁরাই সব ক্রিয়াকলাপ বরাবর করে যাবেন, এবং তাঁরাই ধর্মকে চিরকাল ধরে থাকবেন। সংস্কৃত ভাষায় এ বিষয় এমন অনেক দৈবী অনুশাসন রয়েছে। আমার মতো ঈশ্বরের এই দীনতম জীবটি ওই ব্রাহ্মণ বংশেই জন্মগ্রহণ করেছি, ওই ভাষা শিখেছি, ও ওই সব অনুশাসন কণ্ঠস্থ করেছি।’ তিনি  ‘ব্রাহ্মণ ধর্ম ও ইসলাম’ নামক এ অধ্যায়ে কিছু পরেই ইসলাম ধর্মের কট্টর মনোভাব বা ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদের সমালোচনা করেছেন সংক্ষিপ্তভাবে। তিনি মনে করেন, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে মুসলমানদের হাতে ব্রাহ্মণরা মারা পড়েছে, পৌত্তলিকতার অপরাধে মুসলমানরা ব্রাহ্মণদের হত্যা করতে দ্বিধা করেননি। রামমোহন তাঁর সময়কার ইংরেজদের লেখা ইতিহাসের আলোকে এ বক্তব্য রাখছেন খুবই সংক্ষিপ্তসারে। ভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নেই তাতে, রয়েছে ইতিহাস সম্পর্কে মতপ্রকাশ।

তিনি তাঁর গ্রন্থে আবার ‘বিশ্বমানবকে শান্তি দাও’ কুরআনের এ কথাটাকে পরামর্শ হিসেবে নিয়েছেন। রামমোহন বলেছেন যে, ‘ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন বিধান আর ভিন্ন ভিন্ন নিষেধ আছে। সেখানে ‘বিধান’ বলতে ‘হালাল’ আর নিষেধ বোঝাতে ‘হারাম’ শব্দ দুটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। রামমোহন যেভাবে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইসলাম ধর্মের প্রভাব তাঁর মনের উপর কীভাবে কাজ করছিল। রামমোহন ব্রহ্মসমাজের দলিলে বিধান দিয়েছিলেন, ‘জীব ও জড়ের কারও উপাস্যকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা চলবে না।’ ইসলামের প্রভাব এখানেও লক্ষণীয়। ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’; যার যার ধর্ম তার তার কাছে এ তো ইসলামেরই কথা। রামমোহন ইসলাম ধর্মের নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা মনে করার কারণ এই যে, তিনি মুহাম্মদের একটি জীবনী লেখা শুরু করেছিলেন কিন্তু দুঃখজনক যে সেটি শেষ করতে পারেননি।  

ঘটনাচক্রে রামমোহনকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। ইংরেজ শাসকরা প্রথম দিল্লির সম্রাটের পক্ষ থেকে রামমোহনকে দেয়া এই উপাধি মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু ভারতের সাধারণ জনগণ মেনে নিয়েছিল। রামমোহনকে সাধারণ মানুষ ‘রাজা রামমোহন’ বলতে আরম্ভ করে। রামমোহন তখন বিলাতে যাবেন সতীদাহ আর দিল্লির সম্রাটের পক্ষে দরবার করতে। ইংরেজ শাসকরা বললেন, রাজা হিসেবে তাঁকে বিলাত যাবার অনুমতি তারা দেবে না। রামমোহন তখন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিলাতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিলাতে যাবার ছাড়পত্র পেলেন। কিন্তু জাহাজে করে বিলাতে পৌঁছাবার আগেই যাত্রাবিরতিতে নানাভাবে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের দ্বারা সম্বর্ধনা পেলেন তিনি। রামমোহনের কথা প্রচার হয়ে গেল পাশ্চাত্যের চারদিকে বিদগ্ধ মানুষদের মধ্যে। ব্রিটিশ রাজ-পরিবারে আমন্ত্রণ পেলেন রামমোহন। রামমোহনের ‘রাজা’ উপাধি মেনে নেয়া হলো সেখানে। ভারতবর্ষের করণিক-শাসকরা রামমোহনকে যথাযোগ্য সম্মান না দিলেও, ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্মান দিতে কার্পণ্য করলেন না। রামমোহনের দরবার করায় দিল্লির সম্রাটের ভাতা চারলাখ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হলো। রামমোহন কিছুদিনের মধ্যেই বিলাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রামমোহনের জীবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ইসলাম, এক ঈশ্বর, বেদান্ত, ইংরেজদের নতুন মত, বিশ্বশান্তি; সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন যথেষ্ট যুক্তিবাদী এবং সেই যুগের সাহসী ভিন্ন চিন্তার এক মানুষ। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রভাব যে তাঁর জীবনদর্শনে ছিল সে-কথা সামান্য অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমান কালের মাদ্রাসার দিকে তাকিয়ে, রামমোহন সেদিন পাটনায় কী ধরনের শিক্ষালাভ করেছিলেন ধারণা করা যাবে না। কারণ বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রথম যুগের মুসলিম মনীষীদের বিজ্ঞানমনস্কতার স্থান নেই।