রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘পুঁজিবাদের বিজ্ঞানচর্চা’
পর্ব ১
প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২২
ধর্ম আর বিজ্ঞানে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা মানতেই হবে। ধর্মের ভিতর দিয়ে বিজ্ঞানের নব নব প্রশ্নের উদয় হয়েছিল একদা, সেটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ধর্ম বিজ্ঞানকে এগিয়ে যাবার জন্য এক সময় বহু কিছু সুযোগ করে দিয়েছে। ধর্ম উপাসনালয়ে কিংবা ধর্ম প্রসঙ্গে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মানবমনের প্রশ্ন বা ভাবনাচিন্তা মানুষের বিজ্ঞানচেতনাকে উস্কে দিয়েছে। বিজ্ঞান আর ধর্মের যাত্রা তাই এক জায়গা থেকেই, মানব মনের জিজ্ঞাসা। কিন্তু মনের যেসব জিজ্ঞাসা কিছুটা মনগড়া জবাব তৈরি করে সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, কিংবা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে থাকতে চেয়েছে, কিছুটা অগ্রসর হবার পর অনড় হয়ে পড়েছে, নতুন প্রশ্ন তুলতে চায়নি সেগুলি ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। যা ক্রমাগত প্রশ্ন তুলেছে জীবন জগৎ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে জানবার জন্য তাই বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দর্শন আছে দুই পক্ষেরই। ধর্মেরও দর্শনের দিক আছে, বিজ্ঞানেরও দর্শনের জায়গা আছ। সে কারণেই দুই পক্ষের দর্শন পরবর্তীতে ভাববাদ আর বস্তুবাদে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ধর্মের বিরাট ভূমিকা আছে। বিশ্বের শিল্পকলা, সঙ্গীত নৃত্য সাহিত্য সব সৃষ্টির ক্ষেত্রে ধর্মের আছে বিরাট অবদান। বিজ্ঞান সেই পর্বে অনেক বেশি ধারণা আর বিশ্বাস নির্ভর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের সে চরিত্র পাল্টে গেছে। বর্তমান কালেও বিজ্ঞান ধারণা থেকে বহু কিছু আরম্ভ করলেও বিশ্বাসে থেমে থাকে না। বিশ্বাসের জগতে আটকে থাকবার কোনো সুযোগ নেই বিজ্ঞানের। বিজ্ঞানে সবকিছু প্রমাণিত হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, চির সত্য বা অপরিবর্তনীয় কিছু নেই বিজ্ঞানে। সৃষ্টি সম্পর্কে একক স্রষ্টার অস্তিত্ব বিজ্ঞানের চিন্তায় আগে প্রাচীন ও মধ্যযুগে খুব বেশি সাংঘর্ষিক না হলেও, বর্তমান সময়ে তা খুবই সাংঘর্ষিক।
বিজ্ঞানের সাফল্য বা অগ্রগতির সঙ্গে ঈশ্বর বা স্রষ্টার ধারণা বাতিল হয়ে গেছে বহু বছর আগে, সেই ইউরোপের রেনেসাঁর যুগে। মানববাদ মানেই হলো যেখানে মানুষ শ্রেষ্ঠ। মানুষের কাজের দায় আর কারো নয়। ঈশ্বর নামের কেউ নেই, আর সে মানুষকে পরিচালিত করে না। মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের সমাজ আর চারপাশের নানা ঘটনাবলি দ্বারা। ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলাই প্রমুখের সঙ্গে বিরোধ বাধে চার্চের। চার্চের সঙ্গে বিরোধ আরম্ভ হয় ব্যক্তিত্বের, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের। ধর্মীয় বিশ্বাসের। কারণ বিজ্ঞানের অগ্রগতি তখন আর ঈশ্বরের ধারণাকে স্থান দিতে রাজি নয় যৌক্তিক কারণেই। কারণ চার্চের বা বিশ্বাসীদের ধারণা ছিল চাঁদে ঈশ্বর থাকেন। গ্যালিলিওর দূরবীন দেখিয়ে দিল চাঁদে ঈশ্বর বলে কেউ নেই। বিশ্বাসীরা গ্যালিলিওর কাছে জানতে চাইলো, পৃথিবী ঈশ্বর নেই, চাঁদে ঈশ্বর নেই, তাহলে ঈশ্বর কোথায়? গ্যালিলিও বললেন তার আমি কি জানি। চার্চ বুঝতে পারলো, গ্যালিলিও যা করতে যাচ্ছে তাতে দ্রুত মানুষের মন থেকে ঈশ্বরের ধারণা বাতিল হয়ে যাবে। ফলে চার্চ গ্যালিলিওর গবেষণা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ইউরোপের নবজাগৃতির যুগেই সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরাট অগ্রগতি সূচিত হয়েছিল। চার্চ বেশিদিন তাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ নব উত্থিত বুর্জোয়া শক্তি ছিল এর পৃষ্ঠপোষক। বুর্জোয়ারা তখন সবচেয়ে আলোকিত মানুষ। সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ। ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব সব তাদের হাতে ঘটেছিল। গণতন্ত্র আর সাম্য মৈত্রীর কথা তারাই বলেছিল। কিছুদিন পর তারাই হয়ে উঠলো রাষ্ট্র ও সমাজের মূল শাসকশ্রেণি। তারাই বিপুল উৎসাহে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চার্চ সম্পর্কে মানুষের অন্ধ ধারণা দূর হচ্ছিল। সমাজে এক বিরাট বিপ্লবের সূচনা করেছিল তারা। জন্ম নিল নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা পুঁজিবাদী বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত। প্রগতিশীল বুর্জোয়ারাই ধর্মের ভিত্তিকে নড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়নি। দ্রুত এই প্রগতিশীল বুর্জোয়ারা শাসক হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল পথে হাঁটতে আরম্ভ করে। প্যারিস কমিউন আর নানান শ্রমিক আন্দোলন তাদের বুঝিয়ে দেয় শ্রমিকরা তাদের নতুন আর চিরস্থায়ী শত্রু। ফলে নিজেদের স্বার্থেই দ্রুত চার্চের সঙ্গে হাত মেলায়।
কুসংস্কার, ধর্মের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তির যে প্রগতিশীল লড়াই সে আরম্ভ করেছিল, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সে আন্দোলন মাঝপথে থামিয়ে দেয়। বুর্জোয়া প্রগতিশীল বিপ্লবের পতাকা মাঝপথে থমকে দাঁড়ায়। শাসক বুর্জোয়ারা বুঝতে পারে ধর্মকে বাতিল করলে তারা নিজেরাই বিপদে পড়বে। সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। ভিন্ন দিকে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে বিজ্ঞানের চর্চাও বন্ধ করা যাবে না।
ফলে বুর্জোয়া সমাজ আর ধর্মচর্চার বিরুদ্ধে এককাট্টা থাকেনি। সুবিধা মতো তার বাণিজ্যিক স্বার্থে কখনো ধর্মকে, কখনো বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছে। বুর্জোয়া সমাজে তাই যে বিজ্ঞান চর্চা হয় তা তাদের নিজেদের স্বার্থেই। চলবে