
উৎপল দত্ত
রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘নাট্যজগতের দিকপাল উৎপল দত্ত’
পর্ব ১
প্রকাশিত : মার্চ ০৫, ২০২৫
বাংলাদেশের বরিশালে জন্ম নেন উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের মার্চ মাসের ২৯ তারিখে, যিনি বাংলা নাটকের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। বাংলা নাটকের এই দিকপাল উৎপল দত্ত ছিলেন নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, নাট্যশিক্ষক, নাট্য-পত্রিকার সম্পাদক, নাট্যগবেষক এবং সমাজবিজ্ঞীন ও মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ। প্রথম জীবনে করেছেন ইংরেজি নাটক, ছিলেন দুর্দান্ত অভিনেতা ও নির্দেশক। তিনি ছিলেন স্কুল-কলেজ জীবনেই কান্ট, হেগেল প্রমুখের রচনার পাঠক। ছিলেন মার্কস-লেনিনের অনুসারী আবার শেক্সপিয়রের নাটকের ভক্ত।
ধ্রুপদী সঙ্গীতে তার দখল ছিল। আবার তিনি মঞ্চসজ্জার ব্যাপারেও ছিলেন দিকপাল। মঞ্চে যেমন, চলচ্চিত্রের অভিনয়েও তেমনি স্মরণীয়-বরণীয় মানুষ। বাংলা নাট্যমঞ্চে তার সমকক্ষ এবং এতরকম গুণাবলি নিয়ে আর কেউ আসেননি। তিনি ধূমকেতুর মতনই বাংলা রঙ্গমঞ্চকে কাঁঁপিয়ে দিয়েছিলেন, যা তার মতন আর কেউ কখনো পারেননি। গিরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ির মতন নাট্যজগতে তিনিও একটা যুগের স্রষ্টা।
চমৎকার ইংরেজী আর হিন্দি বলতে পারতেন। কিন্তু অধিক সংখ্যক লেখালেখি বাংলা ভাষায়। তিনি স্নাতক পরীক্ষায় ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু শেক্সপিয়ারিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানিতে অভিনয় করবেন বলে তার আর স্নাতকোত্তর করা হয়নি। এই পর্বে তার শিক্ষক ছিলেন শেক্সপিয়ারিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটারের প্রধান জেফ্রি ক্যান্ডাল, যার কন্যা ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে রূপদানকারী জেনিফার কাপুর আর কন্যা-জামাতা ছিলেন মুম্বাই ছবির এবং পৃত্থিরাজ থিয়েটারের অভিনেতা শশী কাপুর।
উৎপল দত্ত, শশী কাপুর ও জেনিফার কাপুর এরা প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করেছেন জেফ্রি ক্যান্ডালের শেক্সটিয়ারিয়ানা ইন্টান্যাশনাল থিয়েটারে। বিজ্ঞানসম্মত অভিনয় ও থিয়েটার সম্পর্কে মূলশিক্ষা তার এখানেই ঘটে জেফ্রি ক্যান্ডালের হাত ধরে। পরে তিনি জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪৯ সালে প্রথম গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। যখন শম্ভু মিত্রসহ অনেকেই কংগ্রেসের আক্রমণের ভয়ে এবং অন্যান্য কারণে গণনাট্য সংঘ ছেড়ে চলে যান। উৎপল দত্ত গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়ে তার এতদিনকার ইংরেজি নাটক করার পথ সম্পূর্ণ পরিহার করেন।
তিনি বুঝতে পারেন, জনগণের জন্য নাটক করতে হবে জনগণের ভাষায় এবং জনগণের বোধগম্য করে। তিনি শম্ভু মিত্রের আগেই রবীন্দ্রনাথের নাটক নির্দেশনা দেন ‘বিসর্জন’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে। কিন্তু কমিউনিস্ট পাটির্তে রণদীভে আর পুরন্দর যোশীর বিরোধের পটভূমিতে উৎপল দত্তকে গণনাট্য ছাড়তে হলো। তবে তিনি আর কখনো ইংরেজি নাটক করতে ফিরে গেলেন না। মার্কসবাদ বা জনগণের পক্ষে লড়বার জন্য তিনি রাজনীতির পাশাপাশি নাটককে বেছে নিলেন। নিজেই দল গঠন করলেন বাংলা ভাষায় নাটক করবার জন্য। যারা এতদিন তার সঙ্গে ইংরেজি নাটক করছিলেন সেইসব বিদেশিরা চোখের জল ফেলে বৃহত্তর স্বার্থে উৎপল দত্তের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। সকলেই যখন বুঝলেন, উৎপল দত্তের কাছে তার দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সংগ্রাম করাটাই লক্ষ্য, এতদিনকার সঙ্গীরা তাঁকে স্বাগতই জানিয়েছিল।
নতুন নাট্যদলে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে জনগণের ভাগ্য নিয়ে শাসকদের ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে একের পর এক নাটক করে যেতে থাকলেন উৎপল দত্ত। নিজেই নাটক লিখতে আরম্ভ করলেন। শাসক দল কংগ্রেস ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ চালায় মঞ্চে, রক্তাক্ত হয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কিন্তু নাটক করা বন্ধ হয় না। জনগণই পরে উৎপল দত্তের নাটককে রক্ষা করতে দিনের পর দিন এগিয়ে আসে। উৎপল দত্তের নাটককে পাহারা দেয় কলকাতা শহরের জনগণ ও শ্রমজীবী মানুষ। এটাকেই বলে জনগণের নাট্যচর্চা, যার বড় উদাহরণ তৈরি করেছিলেন উৎপল দত্ত এবং তার নাট্যদলের সদস্যরা। নবনাট্যের নামে যখন অনেক মহারথীরা কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তখন উৎপল তার সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি বিসর্জন না দিয়ে মঞ্চে সব আলোচিত নাটক করে গেছেন। দর্শকের অভাব হয়নি কখনো তার নাটকে। নাটকের বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তুর মধ্যে সৃষ্ট নানান দ্বান্দ্বিক চরিত্রে তুখোড় সব অভিনয় ও নাট্যমঞ্চায়নের সৃজনশীলতার গুণে তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখতেন।
স্মরণ রাখতে হবে, উৎপল দত্ত কেবল নাটক মঞ্চায়ন করেননি, মঞ্চসজ্জা, আলোক পরিকল্পনা ও আবহসঙ্গীতে নতুন সব দিক-নির্দেশনা রেখে গেছেন, যা আগে ঘটেনি। ভারতের মানুষ প্রথম ‘অঙ্গার’ নাটকে দেখেছে, মঞ্চে আলোর প্রক্ষেপণ দ্বারা কতরকম নাটকীয়তা ও উচ্চমার্গ তৈরি করা যায়। সেই প্রথম জানতে পারা গেল, নাটকের আলো প্রক্ষেপণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে উঠতে পারে। ঠিক একইভাবে মঞ্চসজ্জার আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন উৎপল দত্ত ‘কল্লোল’ নাটকে। আস্ত একটা জাহাজ যেন মঞ্চের ওপরে উঠে দাঁড়ালো নৌ বিদ্রেহের কথা বলতে গিয়ে। এই নাটকের মঞ্চয়ন বহু দিক থেকে বাংলা নাটকের ইতিহাসে নানান মাইল ফলক তৈরি করেছিল। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে দিনের পর দিন নাটক চলেছিল, দর্শকরা অনেক সময়ই প্রবেশপত্র না পেয়ে মনের দুঃখে চলে গেছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চে উৎপল দত্তের হাত ধরেই এমন বহু আলোচিত ঘটনা ঘটেছে।
সত্যি বলতে, উৎপল দত্তের ৪টি নাটক তো চারদিকেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অঙ্গার, কল্লোল, তীর আর টিনের তলোয়ার। বিশ শতকে এমন সৌভাগ্য বাংলা রঙ্গমঞ্চে আর কোনো নাট্যকার বা নির্দেশকের ভাগ্যে ঘটেনি। পূর্বে এবং পরেও নয়। জনগণই সবসময় শত্রুর হাত থেকে তার নাটককে রক্ষা করতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস সরকার এবং আরো অনেকে নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তীর নাটকটি বন্ধ করতে চেয়ে ব্যর্থ হলো, আনন্দবাজার পত্রিকা নাটকের বিজ্ঞাপন ছাপাতে রাজি হলো না। সেই দুর্দিনে নাটকটির প্রচার চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিল জনগণ বা নাটকের বিপুল সংখ্যক দর্শকরা। নাটকের প্রদর্শনীর দিন বা তার আগের দিন বিভিন্ন রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া কাগজে লেখা থাকতো, ‘তীর চিহ্নিত পথে চলুন’। সেই পথ ধরে গেলেই নাটক প্রদর্শনীর মিলনায়তনে গিয়ে উপস্থিত হতো দর্শক।
বিশ্বে আর কখনো কি কারো নাটকে এমন ঘটনা ঘটেছে? কিন্তু এইসব ঘটনা উৎপল দত্তকে জনবিচ্ছিন্ন করেনি, নিজেকে তিনি জনগণের চেয়ে বিরাট কিছু ভাবেননি। তিনি আমৃত্যু জনগণের সঙ্গেই ছিলেন, জনগণের জন্যই তীক্ষ্ণ ও ধারালো সহজবোধ্য নাটক করেছেন। নাটকের বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে তিনি আঙ্গিক নিয়ে কখনো বেশি মাতামাতি করেননি। ভিন্ন দিকে আঙ্গিকের গুরুত্ব অবহেলা করেননি। চলবে
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক