রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘নাটকের চরিত্র, সংলাপ ও অভিনয়’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২৩

হাসান শাহরিয়ার কিছুদিন আগে থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অনেককেই। সেখানে তিনি বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকে যারা বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন, তাদের ‘অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র’ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে কিছু লেখা তার সম্পাদিত থিয়েটারওয়ালা পত্রিকায় ছাপাতে চান। তিনি প্রথম সংখ্যার জন্য চারজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বাছাই করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন প্রয়াত মোহাম্মদ জাকারিয়া, নাজমা আনোয়ার, হুমায়ূন ফরিদী ও খালেদ খান। চিঠিটি পাবার পর আমি হাসান শাহরিয়ারকে জানাই যে, এরকম লেখা লিখতে আমি অপারগ। কারণ এরকম কিছু লিখতে হতে পারে কখনো ভাবিনি এবং কখনো তাদের অভিনয়ের সৃজন-স্বাতন্ত্র্য মাথায় রাখিনি। বিশেষ করে অভিনয়ের সৃজন-স্বাতন্ত্র নিয়ে লিখতে গেলে কতগুলো শর্ত থাকে। প্রধানত বলি যে, নাটক যদি নাটক না হয়ে ওঠে তাহলে অভিনেতার সৃজন-ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ কম থাকে। সেই বিচারে বাংলাদেশের মঞ্চে উপস্থাপিত কয়টা নাটক সত্যিকারের নাটক হয়ে উঠতে পেরেছে? যদি নাটক নাটক না হয়ে ওঠে, নাট্যাভিনয় মনে দাগ কাটতে পারে না। বাংলাদেশে মঞ্চের খুব কম অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় মনে রাখা গেছে, সৃষ্টিশীল নাটক পাওয়া যায়নি বলে। পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চা নিয়ে নতুনভাবে যথেষ্ট মূল্যায়ন করার আছে। কারণ নাট্যচর্চা নিয়ে আমাদের অহঙ্কার কতটা সঠিক পথ ধরে এগিয়েছে খুব হিসেবে করেই তা আমাদের বুঝতে হবে।

 

বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে, পাড়া মহল্লায় প্রচুর নাটক মঞ্চায়িত হতো। স্বাধীনতার পর তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের যুগে যা কমে যায়। বাংলাদেশের নবনাটক বা পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মহারথীরা স্বাধীনতা পূর্বকার পাড়া, মহল্লা বা সরকারি দপ্তর বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঞ্চায়িত নাটকগুলোকে খুব হেয় চোখে দেখতেন। যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর ও আশির দশকের নাটক-সম্পর্কিত লেখাগুলো পাঠ করা হয় সে-কথার প্রমাণ মিলবে। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বা বলা ভালো ঢাকার মঞ্চের নাটক এক ধরনের ‘আভিজাত্য’-এর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে। নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি রাতারাতি তারকা খ্যাতি লাভ করেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী মঞ্চ নাটকে এই ‘তারকা’ খ্যাতি লাভের সুযোগ ছিল না। শাহরিয়ার হাসান যখন চারজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম উচ্চারণ করেন, তা সেই নাট্য দলগুলোর ‘তারকা’ খ্যাতির পথ ধরেই। কারণ তিনি সামগ্রিকভাবে নয়, কয়েকজন তারকাকে আলোচনার জন্য বেছে নেন। নিশ্চয় সেটা দোষনীয় কিছু নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছর সময়ের চেয়ে স্বাধীনতার আগের বাইশ বছরে নাটক রচিত হয়েছে অনেক বেশি, নাটক প্রকাশিত হয়েছে অনেক বেশি। নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে অনেক বেশি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাইশ বছরের চেয়ে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাইশ বছরে নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যাও অনেক বেশি। যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক মঞ্চায়নের হিসেব ধরা হয়, পঞ্চাশ বছরে যত না তার নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে, তার চেয়ে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বাইশ বছরে রবীন্দ্রনাথের নাটক বেশি মঞ্চায়িত হয়েছে। সুকুমার বিশ্বাসের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নাটক মঞ্চায়নের বিবরণ দেখলেই তার প্রমাণ মিলবে। ঢাকা শহরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পূর্ববাংলার বিভিন্ন শহরে তখন রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন ছিল পূর্ববাংলায় বা পূর্ব পাকিস্তানে খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। সারা দেশে নাটক মঞ্চায়ন যেমন হতো, রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়ন ছিল একইভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন করতে তাদের সার্ধশত বছর উদযাপনের দরকার ছিল না, মন্ত্রণালয়ের অনুদানের প্রয়োজনও হয়নি।

 

যারা বলেন স্বাধীনতার পূর্বে এ দেশে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিল বা তার নাটক মঞ্চায়নে বাধা দান করা হয়েছিল তারা সঠিক বলেন না। কারণ তাহলে রবীন্দ্রনাথের রচিত এত নাটক বা গল্পের নাট্যরূপ মঞ্চায়িত হতে পারতো না। ইতিহাস বিকৃত করার সামান্য সুযোগ এখানে নেই, সুকুমার বিশ্বাস সে ইতিহাস সকলের জন্য লিখে রেখেছেন। বাংলা একাডেমি তা প্রকাশ করেছে। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে নয়, মফস্বল শহরেও প্রচুর রবীন্দ্রনাথের নাটক তখন মঞ্চায়িত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে যে পাঠ্যক্রম ছিল, অনেকেই বলেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তা বহু বেশি বিস্তৃত ছিল। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে বহু নাট্যকার খুব ভালো কিছু নাটক লিখেছেন যাদের নাম এখন আর উচ্চারিত হয় না। বিশেষ করে নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখের নাম এক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য। নাট্যকারের বিদ্রোহী পদ্মা, দুরন্ত ঢেউ, দুর্যোগ, আওয়াজ, অনেক তারার হাতছানি, যাত্রী, বিল বাওড়ের ঢেউ ইত্যাদি নাটক তার উদাহরণ। শাইখ তখন যে-ধরনের নাটক লিখেছেন তারই ছায়া পড়েছে মামুনুর রশীদের প্রথম দিকের খুব আলোচিত নাটকগুলিতে। নাটকগুলো পাঠ করে সবাই মিলিয়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের প্রথম দিকের ঢাকার মঞ্চের বহু নাট্যকারের চেয়ে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নাট্যকারদের নাট্য রচনার মান ছিল উন্নত। কিন্তু আবার ঠিক ততটা উন্নত নয় যে, তা চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে।


স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চা হয়ে দাঁড়ালো অনেকের জন্য প্রচার প্রতিপত্তি লাভ বা আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। কিছু মানুষ যেমন আত্মপ্রতিষ্ঠা চেয়েছেন এবং পেয়েছেন, কিন্তু মানুষ তার বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিকারভাবে নাটককে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। সত্যি বলতে শেষের পক্ষের ব্যক্তিরা তেমন প্রতিষ্ঠা বা প্রচার পাননি। বাংলাদেশে এই প্রতিবাদী নাটকের যাত্রা আরম্ভ বাহাত্তর সাল থেকে। স্বাধীনতা লাভের পরপর বেশির ভাগ নাটক রচিত হলো সমকালীন সমাজ নিয়ে, সমাজের মূল্যবোধ অবক্ষয়, মানুষের হতাশা-বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে। বিশ্বজিৎ ঘোষের ভাষায়, ‘সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাট্য-আয়ুধ হাতে নাট্যকর্মীরা হয়ে উঠলেন সুষম বন্টনভিত্তিক সমাজ গড়ার কারিগর। শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্ব, শ্রেণীসমাজের দ্বন্দ্ব এভাবেই হয়ে উঠলো নাটকের অন্যতম উপজীব্য বিষয়।’

 

বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে কবীর চৌধুরী লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর যুগে বাংলাদেশে একাধিক নাটকে আমরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সুরকে নানাভাবে ধ্বনিত হতে দেখেছি। তীব্র প্রত্যক্ষ সমালোচনা, শ্লেষ ও ব্যঙ্গ-কৌতুক, রূপক-প্রতীকের সাহায্যে অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচন, অবিচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার উজ্জীবন; এই সবই আমাদের নাটকে আমরা লক্ষ্য করেছি।’ তিনি আরও লিখছেন যে, সমাজে বিদ্যমান ঘৃণ্য শ্রেণীবৈষম্য, উচ্চবিত্ত কর্তৃক নিম্নবিত্ত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের নিগ্রহ ও নির্যাতন, স্বৈরাচারী শোষক গোষ্ঠীর অনাচার, খাকি পোষাকের দাপট প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদী সুর দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাটকে। মফিদুল হক লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর নাট্যধারা নিছক নাট্যমঞ্চে সীমিত থাকে নি, দেশের গভীরতর জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনসত্যেরও তা বাহক হয়ে উঠেছে’। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ, কবীর চৌধুরী ও মফিদুল হকের উপরের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত হওয়া না গেলেও কিছু কিছু সত্য তাঁদের বক্তব্যে রয়েছে। সন্দেহ নেই, নাট্যদলগুলো নানাধরনের রাজনৈতিক শ্লোগান তুলেছিল এবং সেগুলো মূলত শ্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সত্যিকারের নাটক হয়ে উঠতে পারেনি।

 

স্বাধীনতার পরপর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন শহরে হঠাৎ প্রচুর নাটক লেখা হয়। নাটকে আগ্রহী নতুনরা যেমন নাটক লিখতে আরম্ভ করেন, তেমনি পুরানো অনেক লেখক-সাহিত্যিকরাও হঠাৎ নাটক লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে বাংলাদেশে এতবেশি নাটক লেখা হতে আরম্ভ করে এবং এতবেশি নাট্যকারের দেখা মিলতে শুরু করে যে, এই প্রাচুর্য দেখে নাট্যকার নুরুল করিম নাসিম লিখেছিলেন, ‘আমাদের এখানে এক সময় সাহিত্য জগতে কবিতার চেয়ে কবির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। তখন অকবিদের ভিড়ে আসল কবিকে চিনে নিতে কষ্ট হতো। এখন যেন সেই রকম একটা সময় এসে গেছে। অনাট্যকারদের ভিড়ে আসল নাট্যকার চিনে নিতে ভুল হয়।’ সাতাত্তর সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসবের নাটকগুলো দেখে জনৈক লেখেন যে, বাংলাদেশে নাটকের নামে কতরকম পাগলামি চলছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। এ্যাবস্ট্রাক্ট, এ্যাবসার্ড, সামাজিক, নৈতিক, ঐতিহাসিক এবং জগাখিচুড়ি; এমনি নানা ধরনের নাটক দেখে একটা ধারণা করা গেছে, বাংলাদেশের নাটক মোটামুটি হাঁটতে শিখেছে, কিন্তু চোখ ফোটেনি। অন্ধের মতো চলছে, ঠোক্কর খাচ্ছে, মাথা ফাটাচ্ছে।

 

তিনি আরও লিখছেন, রেভ্যুলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান এবং এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নিয়ে বাহাত্তরে এক ধরনের নাটক ‘বদর বদর’ বলে দাঁড় ফেললো ঠিকই তবে সে সময় নাট্যচক্রের উদ্ধত তরুণেরা জানতো না, কোথায় তারা যেতে চায়। বর্তমানের পরস্পর অলিখিত প্রতিযোগী নাটুকে দলগুলোও জানে না কোথায় তারা যাবে। তবু যে যতো জোরে পারছে হাঁক মারছে, ‘বদর বদর’। বাহাত্তর থেকে এ পর্যন্ত অনেক নাটুকে দল দেখা গেছে, ‘আন্দোলন’ ‘আন্দোলন’ বলে নানারকম কসরতে বাজার গরম করার আপ্রাণ চেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। নাট্যচর্চার তাতে উন্নতি না হলেও মহিলা সমিতির মিলনায়তনের ফটকে ‘মিলনায়তনপূর্ণ’ ফলকের গৌরবে ‘ল্যাজ’ ফুলেছে সবার। মাহবুব জামিল তাই লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাটক জীবনবিমুখ নয়, সমাজচ্যুত নয়। বরং জীবনের, সমাজের রূপই প্রতিবিম্বিত এসব নাটকে। কিন্তু তবুও আমরা যারা সাধারণ দর্শক, পরিতৃপ্ত হতে পারি না। মনের গভীরে দাগ কাটে না এসব নাটক। বিষয়বস্তু সহজ করে বোঝার ব্যাপারে, নিজেকে নাট্যবিষয়ের সাথে একাত্ম করে নিতে, জীবনের ছবি দেখতে সহায়তা করে না এসব নাট্যপ্রয়াস। থেকে যায় আমাদের বোধের বাইরে। কারণ সমাজচিত্র প্রকাশ তথা প্রতিফলিত করতে গিয়ে তরুণ নাট্যকাররা অতিমাত্রায় চমক নির্ভর হয়ে পড়ছেন।’

 

হাসান ফেরদৌস মন্তব্য করছেন, ‘ইতিমধ্যেই আমরা কয়েকজন সাধারণ শ্রেণির নাট্যকারের কাছ থেকে কতিপয় নাটক পেয়েছি যেগুলি অবয়বে অভিনব হলেও প্রকাশের ক্রুডিটি, স্থুলতা ও সংলাপের প্রকাশ্য বর্বরতার জন্য আমাদের আকর্ষণের চাইতে বিকর্ষণই করেছে অধিক।’ নাট্য পরিচালক, অভিনেতা আতাউর রহমান লিখছেন, বিশ্ব-নাট্যসাহিত্যের ক্রমবিকাশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও যোগসূত্র রাখতে হবে। তবে আমাদের নাট্যান্দোলনকে অ্যাবসার্ড থিয়েটার নির্ভরশীল করতে গেলে ঠকতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে শিল্প এবং নাটক হলো মানুষের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ শিল্প যা অতি সহজে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। সেখানে এক লাফে বিমূর্ত নাটক ও অ্যাবসার্ড থিয়েটারের পর্যায়ে চলে গেলে, বদহজম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে আশাতীত কর্মতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে, কিন্তু নাট্যরচনার ক্ষেত্রে আমাদের দারিদ্র্য তেমন একটা ঘোচেনি। সোজা ভাষায় যে হারে বা মানে আমাদের দেশে নাটক অভিনীত হচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে ভালো নাটক রচিত হচ্ছে না।

 

সত্যিকারের নাটক না থাকলে নাটকে ভালো অভিনয় আশা করা যায় না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, স্বাধীনতা পূর্বের নাট্যচর্চার চেয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চা মূলত এগিয়ে গিয়েছিল মূলত নাট্য প্রযোজনার রীতিতে। নাট্য নির্দেশনায় এবং নাট্যাভিনয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু নাট্যাভিনয় খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারেনি নাটক রচনার দুর্বলতার জন্য। স্বাধীনতার পর নাট্য নির্দেশনা বা প্রযোজনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। স্বাধীনতার আগে নাট্যচর্চা ছিল সৌখিনতার বিষয়, পরে সেখানে পেশাদারী দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান শতকে তা যথেষ্ট উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেছে। কিছু তরুণদের ভূমিকা তাদের অগ্রজদের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। বর্তমান শতকে বেশ কিছু নাটকও রচিত হয়েছে, যা খুবই উন্নতমানের। যদি সামগ্রিকভাবে দুই পর্বের নাটক নিয়ে আলোচনা করা হয়, পরবর্তী পর্বের নাটকের প্রযোজনা এবং অভিনয়ের মান থাকবে অনেক এগিয়ে। কিন্তু দুই পর্বেই সত্যিকারের উঁচুমানের নাটক পাওয়া গেছে খুবই কম। সামগ্রিক বিচারে নাটক রচনার মান বিচার করলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গত শতকের শেষের দিকে এবং বর্তমান শতকে হাতে গোনা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক রচিত হয়েছে, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের নাট্য্কাররা সে মাপের নাটক রচনা করতে পারেননি। ব্যতিক্রম ‘সিরাজদৌলা’। সত্যি বলতে বাংলাদেশ ভারতসহ সারা বিশ্বেই ভালো নাটকের সংখ্যা কম। কিন্তু নাটক না লিখে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের পদক পাওয়া যায় বাংলাদেশেই। পৃথিবীর আর কোথাও তা ঘটে কি না আমার জানা নেই। সারা বিশ্বে ভালো নাটক কম লেখা হয় বলেই, বহু নাটকই মঞ্চায়িত হবার পর হারিয়ে যায়।

 

যদি ভালো নাটক রচিত না হয়, স্মরণে রাখার মতো অভিনয় করা কি সম্ভব? বিশ্বে বহু বড় বড় অভিনেতা জন্মেছেন শেক্সপিয়রের নাটককে ঘিরে। ইবসেন, বার্নার্ড শ, চেকভ, ব্রেশট প্রমুখ একইভাবে বড়মাপের নাটক লেখার কারণেই তাদের নাটকগুলো হারিয়ে যায়নি। প্রাচীন গ্রীসের বহু নাটক এখনো অভিনীত হয়, নাট্যগুণের কারণেই। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটিতে অনেকে অভিনয় করতে চান শুধুমাত্র সেখানে সৃজনশীল অভিনয় করার সুযোগ আছে বলেই। কিন্তু সকল নাটকে কী সৃজনশীল অভিনয় করার সুযোগ থাকে? নাট্য মঞ্চায়নে সবক্ষেত্রে কী ঘটে, অভিনেতা অভিনেত্রীরা নাটকের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু যদি তারা ফুটিয়ে তোলার মতো চরিত্র না পায়? নাট্যকার নিজেই যদি নাটক রচনা করতে গিয়ে বড় মাপের চরিত্র সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে অভিনেতা বা অভিনেত্রী বড় মাপের অভিনয় করবে কীভাবে? ফলে বড়মাপের অভিনয় পেতে হলে, কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে সৃজনশীল চরিত্রায়ণ করতে হলে অবশ্যই সবার আগে চাই বৃহৎমাপের নাটক।

 

বাংলাদেশের নাট্যকারদের রচিত নাটকে তারা কটা বৃহৎমাপের চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছেন যে, অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় বহুকাল স্মরণ থাকবে। ‘ইডিপাস’, ‘আন্তিগোনে’, ‘কিং লিয়ার’, ‘হেমলেট’ ‘মুখরারমনী বশীকরণ’, ‘রক্তকরবী’, ’মাদার ক্যারেজ’, ‘গ্যালিলিও’, ‘মাস্টার বিল্ডার’, ‘সাজাহান’, ‘টিনের তলোয়ার’ -এর মতো নাটক কোথায় যে অভিনেতা অভিনয় করে দর্শককে মাতিয়ে রাখবেন? কয়েকটি নাটকের নাম উল্লেখ করলাম এ কারণেই যে, এসব নাটকে এমন সব চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে যা ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। যদি মঞ্চে কেউ এসব চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারে তাহলে দর্শক তা বহুকাল স্মরণে রাখবেন। ধরা যাক গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকেরের অভিনয় নিশ্চয় এখনো সবার মনে পড়বে যারা নাটকটি দেখেছেন। মাসুম রেজার ‘নিত্যপুরাণ’ মঞ্চে সেইরকম দুধর্ষ নাটক হয়ে উঠতে পেরেছিল বলেই দিলীপ অভিনয় করে সবার মন জয় করে নিয়েছিল। ঢাকার নাট্যজগতে বহুকাল ধরে সেই আলোচনা চলবে। চুমকিকে দর্শকরা মনে রাখবে বহুকাল দ্রৌপদীর চরিত্র অভিনয়ের জন্য। মাসুম যে একলব্যকে সৃষ্টি করেছিল, সেই একলব্যই তো নাটকের প্রাণ। সঙ্গে পুরো নাটকটা এবং তার সংলাপের নানা গাঁথুনি। নাটকটাকে তো আগে নাটক হয়ে উঠতে হবে। যা কিছু লিখে মঞ্চে অভিনয় করলেই তা নাটক হয় না। কিছু মানুষের তাতে মনের খায়েশ মেটে মাত্র। মান্নান হীরার ‘অগুনমুখা’ ছিল মানসম্পন্ন এবং অভিনয় করার মতো নাটক। সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুলের’ মঞ্চরূপ। ভিন্ন ধরনের নাটকের মধ্যে মামুনুর রশীদের ‘সংক্রান্তি’র কথা বলতে হয়, তিনি একঝাঁক অভিনেতা তৈরি করেছিলেন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তাঁরা অনেকেই পরে তাঁদের অভিনয়কে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলেছিলেন। বর্তমান শতকেই পাওয়া গেল মলয় ভৌমিকের ‘হত্যার শিল্পকলা’। বাংলাদেশের নাট্যকারদের লেখা ভালো নাটক আরো পাওয়া গেছে। ঠিক যেমন ‘মহাজনের নাও’, কিছুদিন আগে পাওয়া গেল মাসুম রেজার ‘পারাপার’। দু-একটা নাটকের কথা এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না। কিন্তু আমি বলছি সেইসব নাটকের কথা যেখানে শুধু অভিনয় নয়, ‘চরিত্র সৃষ্টি করার’ সুযোগ ছিল।

 

নাটকে যদি বড় বড় মাপের চরিত্রই সৃষ্টি না হয় কীভাবে অভিনেতা বড় মাপের অভিনয় করবে? ছবি বিশ্বাস, শিশির ভাদুরী দর্শকের মনে গেঁথে আছেন বড় বড় সামাজিক বা ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন বলেই। চরিত্র সবসময় বড় হতে হবে তা নয়, কিন্তু সেটা একটি চরিত্র হয়ে উঠতে হবে। মহাভারতের ছোট্ট চরিত্র ‘শকুনি’ও এক আলোচিত চরিত্র। যদি তুলনা করা হয়, বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয় শেক্সপিয়র এবং ব্রেশটের নাটক। ঠিক সেই সঙ্গে প্রাচীন গ্রীসের নাটক। কারণ একটাই, বড়মাপের অভিনেতারা সেসব নাটকের চরিত্র অভিনয় করার স্বাদ পান, দর্শক পান সৃজনশীল অভিনয় দেখার আনন্দ। ‘সিরাজদৌলা’ চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। কারণ সিরাজের মতো একটি বিরাট চরিত্রকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চরিত্রটিকে ঘিরেই গল্পটা রচিত। নাটকের গল্প যাই থাক, নাটকে চরিত্র থাকতে হবে। নাটক হয় মানুষকে নিয়ে, মানুষের দুঃখ-বেদনা, আনন্দ এবং বিজয় নিয়ে। ফলে নাটকের চরিত্র হয়ে উঠতে হবে দ্বন্দ্ববহুল, প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র। দর্শক নাটকে প্রতিদিনের ঘটনা দেখতে চায় না, দর্শক দেখতে চায় বৃহৎ বৃহৎ ঘটনার নাটকীয় নির্যাস।

 

যদি খুব মনোযোগ দেয়া যায় দেখা যাবে, পৃথিবীতে চরিত্রকে ঘিরে রচিত নাটকগুলোই বিখ্যাত। জুলিয়াস সীজার, আগামেমনন, কোরিওলেনাস, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, সীজার ক্লিওপেট্রা, আলমগীর, তিতুমীর, মহারাজ নন্দকুমার, মীরকাশিম; বহু নাম উচ্চারণ করা যাবে। পূর্বেও কিছু নাম বলা হয়েছে। কিছু নাটক চরিত্রের নামে রচিত হয়নি কিন্তু সেখানে বৃহৎ মাপের চরিত্র আছে। বাংলাদেশে মঞ্চস্থ কিছু নাটকের নাম বলছি: বিসর্জন, রক্তকরবী, রাজা, জনতার শত্রু, শেষ সংলাপ, লোক সমান লোক, দেওয়ান গাজীর কিসসা ইত্যাদি। কারণ নাটকে সেখানে চরিত্র আছে, আখ্যান আছে, চমৎকার সব সংলাপ আছে, নাটকীয় দ্বন্দ্ব আছে এবং একটি বার্তা আছে বলেই সেগুলো মঞ্চসফল হয়েছে। যা বহু বছর আগে নাটক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে অ্যারিস্টটল উল্লেখ করেছিলেন। নাটক কেমন হবে তা নিয়ে অ্যারিস্টটলের বহু বছর পর ব্রেশট লিখলেন ‘শর্ট অরগানুনন’। তিনি নাটকে দেখাত চাইলেন বিপরীত সব দ্বন্দ্বে কম্পমান দ্বন্দ্ববহুল ঘটনা আর চরিত্র। তিনি নাটক লিখেই দ্রুত সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। তিনি দেখালেন, নাটকের গল্পে সস্তা নায়ক আর খলনায়ক সৃষ্টি করে সত্যিকারের নাটক দাঁড় করানো যায় না। গল্পের নায়ক যার কোনোই দোষ নেই, খলনায়ক যার কোনোই মহৎ গুণ নেই; তিনি বললেন এগুলি সস্তা রচনা যা সমাজ-বিপ্লবের কাজে আসে না। মানুষের চেতনাকে শানিত করে না।

 

নাটক লিখবার জন্য মহাকাব্যের কাছে ফিরে গেলেন ব্রেশট। মহাকাব্যে সম্পূর্ণ ভালো বা সম্পূর্ণ খারাপ চরিত্র বলে কিছু নেই। সকলেই নানা দোষগুণে টলটলায়মান। ইলিয়ড অডিসি, মহাভারত; সর্বত্র একই বিষয় দেখা যাবে। নাটক শুরু থেকেই সমাজকে এবং মানুষের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে। মানুষ সে-কারণেই প্রাচীন যুগের গ্রীসের নাটকে বিরাট চরিত্র হয়ে এসেছে, সেইসঙ্গে রাষ্ট্র এবং সমাজের ক্রীড়নক হিসেবে। নাট্যকারদের সৃষ্ট নাটকের সেইসব বিরাট চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে এসেছিল সেযুগের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সেযুগে অভিনয়ের প্রধান উপাদান ছিল কণ্ঠ, বাচিক অভিনয়রীতি। সুন্দরভাবে সংলাপ প্রক্ষেপন। বর্তমান যুগের নাটকেরও প্রধান একটি দিক সংলাপ প্রক্ষেপন। যাঁরা নাটকের সংলাপ নিয়ে নানাভাবে খেলতে পারেন না, সংলাপ দিয়ে দর্শক-শ্রোতার কান মুগ্ধ করতে পারেন না; এমন ব্যক্তিরা মঞ্চে বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সম্মান পাননি। সারাবিশ্বে মঞ্চনাটকে বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রী হিসেবে যাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সকলেই তাঁরা বাচিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে ছিলেন দুর্দান্ত। নাটকের বিশাল মাপের চরিত্রদের প্রধানত বাচিক অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্যই তাঁদের স্বীকৃতি। প্রাচীন গ্রীসের নাটক থেকে বাচিক অভিনয় নাটকের প্রধান একটি অঙ্গ, যা আজ পর্যন্ত স্বীকৃত।

 

বাংলার যাত্রাপালা বাচিক অভিনয়কে ঘিরে। যাত্রাপালার প্রায় সবটাই প্রধানত বাচিক অভিনয়কে কেন্দ্র করেই। পরে যুক্ত হয়েছে বিবেকের গান। গান যাত্রার অনুষঙ্গ, মূল বিষয় নয়। রবীন্দ্র-নাট্যের প্রধান নাটকগুলো সংলাপ প্রধান আর বাচিক অভিনয় তার প্রাণ। বাংলা নাটকের শুরু থেকে দেড়শো দুশো বছর তাই ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা নাটকের কয়েকজন দিকপাল অভিনেতা শম্ভুমিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুইজন অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র, কেয়া চক্রবর্তী প্রমুখ বাচিক অভিনয়ের জন্যই আলোচিত ছিলেন। মঞ্চে যাঁরা তাঁদের নাটক দেখেননি, বেতারে তাঁদের কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই আমরা অনেকে তাঁদের কণ্ঠে সুললিত সংলাপ শুনে মুগ্ধ ছিলাম। কতোটা যে তা বলে বুঝানো যাবে না, তাঁরা শুধু তাঁদের বাচিক অভিনয় দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। নিজে আমি পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় সব অভিনেতাদের চিনেছি বেতারে তাঁদের অভিনয় বা সংলাপ প্রক্ষেপন শুনে। তাঁদের চেহারাটা পর্যন্ত তখনো দেখিনি।

 

বাচিক অভিনয়ে সৃজনশীলতা প্রকাশ করা সম্ভব হবে না, যদি না নাটকে উচ্চমানের সংলাপ থাকে। মানে যদি উচ্চমানের চরিত্র সৃষ্টি না হয়। নাটক রচনা কী সেটাই তাই প্রথম বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মঞ্চে উচ্চমানের বাচিক অভিনয় পাওয়া যায়নি কেন? কারণ মঞ্চায়িত নাটকগুলোকে প্রায় ক্ষেত্রেই উচ্চমানের নাটক বলা যাবে না। সত্যিকারের নাটক কী না বুঝেই কিছু মানুষ নাটক লিখতে শুরু করেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে সেগুলো পত্রপত্রিকায় বড়মাপের নাটক হিসেবে প্রচার পায়। পত্রপত্রিকার প্রচারকে ঘিরে সবাই খুব হৈ চৈ ফেলে দেয় সেইসব নাটক নিয়ে। প্রশ্নটা কেউই প্রায় তোলেন না যে, উচ্চমাপের নাটক ছাড়া নাট্য আন্দোলন হয় কী করে? সবাই তাঁদের নিজনিজ সস্তা কাজে ভয়াবহ আপ্লুত থাকেন। যাঁরা কিছুটা নাটক তখন বুঝতেন তাঁরা নতুনদের প্রচারণার কৌশল দেখে ধাক্কা খেয়ে পিছু হটলেন। নতুনরা প্রচারের নানা সূত্রধরে বিরাট জায়গা করে নিলেন রাজধানী ঢাকায় এবং কতিপয় চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে। যদি সেইসব দলের ইতিহাস ঘাঁটতে বা বিশ্লেষণ করতে বসেন, কী পাওয়া যাবে শেষ ফলাফল?

 

বিরাট একটা নাট্য আন্দোলনে কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই, কিছু কিছু ইতিবাচক কাজ হবেই। হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রথম তিন দশকের নাট্যচর্চা এবং নাট্য আন্দোলনের ফলাফল কী? গত পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চার কতোটা সুফল এখন আমাদের হাতে রয়েছে যা নিয়ে বিরাট অহঙ্কার করতে পারি? নাট্যদলের সংখ্যা বিবেচনা করে কী বলা যাবে? প্রতিটি দলের কি একটা করে নাটক বলা যাবে যা আলোচিত এবং স্মরণীীয়। কয়টা দল সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পেরেছে? যারা পারেনি, প্রধানত তারাই অন্যদের চাটুকারিতায় এখন ব্যস্ত, ব্যস্ত দলাদলি করে সুফল নিতে। নাট্যচর্চার বহুক্ষেত্র আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে আছে বলেই খবর পাওয়া যায়। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামক একটি সংগঠনের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ যারা, সত্যিকারভাবে সুস্পষ্ট করে বলতে পারবে না ‘গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা’ আসলে কী। গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে যা শুনতে পাই তা এখন, নাট্যচর্চার চেয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি, দলাদলির কাজে লিপ্ত। গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের একাংশই সভা ডেকে সেই কথাটাই বলছেন। বিষয়টা হলো, নাট্য আন্দোলনেই সৃজনশীলতা নেই। প্লাটো তো স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, নাটক সুশিক্ষা যেমন দিতে পারে, কুশিক্ষাও দিতে পারে।

 

মহৎ নাটক না থাকলে বড় মাপের অভিনেতা সৃষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে না তা বলার জন্যই এতো কথা বলা। সত্যিকারের নাটক না থাকলে ভিন্নমাত্রার সৃজনশীল অভিনয় কোথায় পাওয়া যাবে? স্বাধীনতার পর নাটক রচনার নামে কতোরকম পাগলামী হয়েছে তা নিয়ে সমালোচনা লিখেছেন জনৈক। নিজের নামে লিখতে সাহস করেননি কারণ মহান নাট্যকর্মীরা তাহলে তাঁর উপর আক্রমণ চালাতে পারে। রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় সেই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নাট্যচর্চার শুরুতেই তাঁদের হতাশা নিয়ে কী লিখেছিলেন তাঁরা তা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। বড় মাপের সৃজনশীল অভিনয় পাওয়া যাবে তখনই, যখন অভিনেতা অভিনেত্রীদের হাতে বড় মাপের নাটক থাকবে। বড় মাপের নাটক যদি লেখা হতে থাকে, তাহলে নাট্য-আন্দোলনও সঠিক পথ খুঁজে পাবে। ভিন্ন দিকে নাট্য আন্দোলন বা নাট্যচর্চ সঠিক পথে থাকলেই সৃজনশীল নাটক রচিত হবে। সৃজনশীল নাটক থাকলেই মানুষ মঞ্চে উপভোগ করতে পারবে সৃজনশীল অভিনয়।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক