রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘ধর্ম‌নির‌পেক্ষ রাষ্ট্র ও ইসলাম’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০২৪

ধর্ম‌নির‌পেক্ষ রা‌ষ্ট্রের বিরু‌দ্ধে নয় ইসলাম ধর্ম। নারীর শিক্ষালাভ, চাক‌রি করা ও সংগ্রাম করার বিরু‌দ্ধে নয়। ভার‌তের প্রথম নারী শাসক ছি‌লেন সুলতানা রি‌জিয়া। মধুসূদন দত্ত নারী স্বাধীনতার প্রথম উদাহরণ হি‌সে‌বে তাঁ‌কে নি‌য়ে ইং‌রে‌জি‌তে চমৎকার এক‌টি প্রবন্ধ লি‌খে‌ছি‌লেন। মধুসূদন সুলতানা রা‌জিয়া‌কে প্রধান চ‌রিত্র ক‌রে এক‌টি নাটকও লিখ‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন, কিন্তু তৎকালীন নাট‌্যজগ‌তের মহারথীরা সে নাটক মঞ্চস্থ কর‌তে না চাইলে মধুসুদন আর সে নাটক লে‌খেন‌নি।

বিদ‌্যাসাগর ছি‌লেন বিরাট মা‌পের মানুষ। সাম্প্রদা‌য়িক একেবা‌রেই নন। কিন্তু তার সমাজ সংস্কার আন্দোলন বর্ণ‌হিন্দু‌দের ক্ষে‌ত্রে বিরাট অবদান রাখ‌লেও, নিম্নব‌র্ণের হিন্দু ও মুসলমান‌দের ক্ষে‌ত্রে এই সংস্কার কো‌নো ভূ‌মিকা রা‌খে‌নি। কারণ নিম্নব‌র্ণের হিন্দু মুসলমান‌দের জীব‌নে ‘বিধবা বিবাহ’ নি‌ষেধ ছিল না। ঠিক একইভা‌বে সেখা‌নে ‘সতীদাহ’ প্রথাও ছিল না। মনুর বিধা‌নে নারী ও শূদ্রদের জন‌্য শিক্ষা নি‌ষিদ্ধ ছিল। বিদ‌্যাসাগর নি‌জেও ইংরেজ‌দের স‌ঙ্গে সুর মি‌লি‌য়ে দ‌রিদ্র মানুষদের জন‌্য শিক্ষা চান‌নি। বিদ‌্যাসাগর শিক্ষা চে‌য়ে‌ছেন ধনী‌দের জন‌্য, ধনী নারী‌দের জন‌্য। ‌খ্রিস্টান মিশনারীরা শিক্ষা দি‌তে চে‌য়ে‌ছে দ‌রিদ্র নারী-পুরুষ‌কে।

ইসলা‌মের বিধা‌নে আছে, নারী-পুরুষ উভ‌য়ের জন‌্য শিক্ষালাভ আবশ‌্যক। মনুর বিধা‌নের আছে বিপরীত কথা। ইসলাম ধর্মে বলা হ‌য়ে‌ছে, শিক্ষালা‌ভের জন‌্য সুদূর চীন দে‌শেও যাও। মা‌নে ভিন‌দে‌শেও যাও। ইসলা‌ম ধ‌র্মে তাই বিধর্মী‌দের দেশে গি‌য়ে বিধর্মী‌দের কা‌ছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান গ্রহণ কর‌তে নি‌ষেধ করা হয়‌নি। ভিন্ন দি‌কে, বৈ‌দিক ধর্মের ‌বিধা‌নে বি‌দেশ বা বিধর্মী‌দের দে‌শে যাওয়া যা‌বে না। কালা পা‌নি বা সমূদ্র পার হওয়া নি‌ষেধ। ‌বি‌দে‌শে গে‌লে তা‌কে সমাজচ‌্যুত করা হ‌বে, গান্ধীর বি‌দে‌শে যাওয়ার যু‌গেও তা কম‌বে‌শি ছিল। সেই বৈ‌দিক বিধা‌নের বিরুদ্ধে র‌চিত বাংলার মঙ্গলকাব‌্য চাঁদ সওদাগরের কা‌হিনি, চাঁদ বা‌ণি‌জ্যের উদ্দেশ্যে বি‌দেশ যে‌তে চাইলে মানসা তার সপ্ত‌ডিঙ্গা ডু‌বি‌য়ে দেয়।

ইসলাম এসব ক্ষে‌ত্রে একেবা‌রে রক্ষণশীল নয়। ইসলা‌মে ছোঁয়াছুঁ‌য়ি নি‌ষিদ্ধ নয়, তা‌তে জাত চ‌লে যায় না। তার মা‌নে ইসলা‌মে ধর্মের বেড়াজা‌লে মানু‌ষের প্রতি‌দি‌নের জীবনযাপন‌কে সীমাবদ্ধ করা হয়‌নি। ইসলাম সব ধর্মের স‌ঙ্গে মি‌লে‌মি‌শে থাক‌তে পা‌রে। বাংলার মুস‌লিম ছাত্রবাসগু‌লো মুসলমান‌দের কার‌ণে করা হয়‌নি, হিন্দু‌দের কার‌ণে কর‌তে হ‌য়ে‌ছিল। কারণ বর্ণ‌হিন্দুরা মুসলমান‌দের স‌ঙ্গে এক হ‌লে থাক‌তে চাননি, একস‌ঙ্গে‌ ব‌সে খে‌তে চাননি। নি‌জে‌দের ধর্মের ছোঁয়াছুঁ‌য়ি রক্ষার জন‌্য আলাদা ছাত্রবাস দা‌বি ক‌রে‌ছি‌ল।

বাংলা‌দে‌শে য‌দি এখন কেউ ধর্ম‌কে সাম‌নে রে‌খে রাজনী‌তি কর‌তে চান সেটা হ‌বে মস্তবড় ভুল, তি‌নি সেটা যতই প্রগ‌তিশীলতার মোড়‌কে বলুন না কেন? এই রকম চিন্তা দে‌শের স্থি‌তিশীলতা‌কে নষ্ট কর‌বে। বাংলা‌দে‌শে যেখা‌নে নব্বই শতাংশ মানু‌ষের ধর্ম ইসলাম, স্বভাবতই সেখা‌নে এই ধর্ম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে‌ নেই। বাংলা‌দে‌শের মূল সমস‌্যা কি ইসলাম ধর্ম পালন কর‌তে পারা ‌কিংবা না পারা? যখন ধর্ম পালন করার সমস‌্যা নেই তখন, সংখ‌্যাগরিষ্ঠ‌ মানু‌ষের সেসব নি‌য়ে দু‌শ্চিন্তা না করে বরং অন‌্যান‌্য গুরুত্বপূর্ণ দি‌কে নজর দি‌তে হ‌বে। বাংলা‌দেশ বরং তার নতুন সং‌বিধান চিন্তায় এমন কিছু বক্তব‌্য অন্তর্ভুক্ত কর‌তে পা‌রে, যা এশিয়ার অন‌্যান‌্য অনেক দে‌শের কা‌ছে অনুকরণীয় ম‌নে হ‌তে পা‌রে।

সারা বিশ্ব চম‌কে যাবে এইরকম সহনশীল সমা‌জের উদাহরণ তৈ‌রি কর‌তে পা‌রে। মানবতাবাদ, ব‌্যক্তি-স্বাধীনতা, মত প্রকা‌শের স্বাধীনতা, সক‌লে নাগ‌রি‌কের প্রতি সম্মান অধিকারের ধারণা এমনভা‌বে সং‌বিধা‌নে নি‌য়ে আস‌তে হ‌বে, যেন শুধুমাত্র দেশ‌টির সংবিধা‌নের কার‌ণেই সারা‌বি‌শ্বের মানুষ এদেশ‌কে সম্মা‌নের চো‌খে দে‌খে। বাংলা‌দে‌শের পাস‌পোর্ট দে‌খেই যেন মানুষের ম‌নে সম্মান চ‌লে আসে। মানুষ যেন বল‌তে পা‌রে, নব্বই শতাংশ মুসলমা‌নের দে‌শে কেউ অব‌হে‌লিত নয়, নব্বই শতাংশ মুসলমা‌নের কর্তৃ‌ত্বে দেশ‌টি চ‌লে না। রাষ্ট্রটি প‌রিচা‌লিত হয় তার সকল নাগ‌রিক‌দের অধিকারের প্রতি সমান মর্যাদা দি‌য়ে।

বহুজন বল‌বেন, অর্থ‌নৈ‌তিকভা‌বে সমান না হ‌লে সব নাগারক কি সমান হ‌তে পা‌রে? না পা‌রে না। নাগ‌রিকদের স‌ঙ্গে নাগ‌রিক‌দের অর্থ‌নৈতিক বৈষম‌্য থাক‌বে তখন। থাক‌বে ভোগ বিলা‌সিতার পার্থক‌্য। গত আন্দোল‌নেও ছিল। কিন্তু মত প্রকা‌শের স্বাধীনতার স‌ঙ্গে তা সাংঘ‌র্ষিক নয়। সং‌বিধান য‌দি তার ধনী দ‌রিদ্র, ধর্ম, বর্ণ এসব বি‌ভেদ না রে‌খে সকল নাগরিক‌কে সমমর্যাদা দেয় সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হ‌বে সা‌ম্যের প‌থে এগি‌য়ে যাবার জন‌্য। সং‌বিধা‌নে মানুষ‌কে সমান মর্যাদা দেওয়া ছাড়া গণতা‌ন্ত্রিক এক‌টি রাষ্ট্র নির্মা‌ণের আর কোনো বিকল্প নেই। খুব স্বাভা‌বিক সত‌্যটি হলো, সকল মানু‌ষের সমান অধিকার নি‌শ্চিত কর‌তে হ‌লে ঔপ‌নি‌বে‌শিক বিচারব‌্যবস্থা ও আইনগু‌লিও পা‌ল্টে ফেল‌তে হ‌বে।

সংবিধান সংস্কার নি‌য়ে যত কথা হ‌চ্ছে, যত আলোচনা হ‌চ্ছে তার চে‌য়ে আস‌লে সংবিধান সংস্কার অনেক সহজ ছিল য‌দি সবার আন্ত‌রিকতা থা‌কে। সংবিধান সংস্কার কর‌তে গে‌লে বহু কথা নতুন ক‌রে লিখ‌তে হ‌বে। ফ‌লে সং‌বিধান নতুন ক‌রে লিখ‌তে হ‌বে, এ কথাটার ম‌ধ্যেও দোষ নেই। কিন্তু কিছু কিছু ঘো‌ষিত বাক‌্য কা‌জের চে‌য়ে বক্তব্যে এত বে‌শি অতি‌বিপ্লবী হয়, তা‌ বহু মানু‌ষের ম‌নে বিরূপ প্রতি‌ক্রিয়া সৃ‌ষ্টি ক‌রে। য‌দি বাংলা‌দে‌শের ১৯৭২ এর সং‌বিধান নি‌য়ে আলোচনা করা যায়, তার সমস‌্যাটা কী? খুব ভা‌লো ভা‌লো কথা আছে সং‌বিধানে জনগ‌ণের মৌ‌লিক অধিকারের প‌ক্ষে। কিন্তু পুনরায় আবার অন‌্য বিধান দি‌য়ে সেইসব অধিকারকে সঙ্কু‌চিত করা হ‌য়ে‌ছে। ফ‌লে মৌ‌লিক অধিকারের স‌ঙ্গে সাংঘ‌র্ষিক বিষয়গু‌লো বা‌তিল কর‌লেই হ‌লো।

১৯৭২ এর সং‌বিধা‌নে সং‌শোধনী এনে য‌দি লি‌খে দেওয়া হয়, জনগ‌ণের মৌ‌লিক অ‌ধিকা‌রের স‌ঙ্গে যা কিছু সাংঘ‌র্ষিক তা স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে বা‌তিল হ‌য়ে যা‌বে, তাহ‌লে আর স্ব‌বি‌রো‌ধিতা থাক‌ছে না। স্পষ্ট ক‌রেই বল‌তে হ‌বে, নিজ‌ দে‌শের জনগ‌ণের ওপর কো‌নো কালাকানুন থাক‌বে না। সেই ক্ষে‌ত্রে সং‌বিধা‌নে রাষ্ট্রীয় অপরাধ বল‌তে কী কী বোঝা‌বে তার এক‌টি ধারা বা তা‌লিকা সু‌চি‌ন্তিতভা‌বে রচনা কর‌তে হ‌বে, যা‌তে সরকারগুলো সেইসব ধারার অপব‌্যবহার কর‌তে না পা‌রে। অপরাধীরা বা রাষ্ট্রবি‌রোধীরা শা‌স্তি পায়। গণতা‌ন্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখ‌তে সং‌বিধা‌নে নির্বাচন ব‌্যবস্থা এবং সাংসদ‌দের অ‌ধিকার, সংস‌দের গঠন এগু‌লো নি‌য়ে নতুন ক‌রে কিছু বিষয় লিখ‌তে হ‌বে, কিছু বা‌তিল কর‌তে হ‌বে কিংবা কিছু অন্তর্ভুক্ত কর‌তে হ‌বে।

নির্বাহী ব‌্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার কাঠা‌মো‌কে নতুন ক‌রে সং‌বিধা‌নে সাজা‌তে হ‌বে জনগ‌ণের মৌ‌লিক অধিকার সংরক্ষণ কর‌তে। সেখা‌নে স্পষ্ট ক‌রে বারবার বল‌তে হ‌বে কিছু‌তেই ঔপ‌নি‌বে‌শিক জনবি‌চ্ছিন্নতা এবং অধিকারের ক্ষে‌ত্রে নাগ‌রিক‌দের ম‌ধ্যে বৈষম‌্য রাখা যা‌বে না। পাশাপা‌শি বল‌তে চাই, মুসলমান‌দের ধর্ম‌নির‌পেক্ষ রাষ্ট্র শাস‌নের ইতিহাস আছে, ভিন্ন  ধর্মের স‌ঙ্গে সহবস্থান করার ইতিহাস আছে বহু‌দি‌নের। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় হিন্দু‌দের স‌ঙ্গেই সহ-অবস্থান কর‌তে পা‌রেন না। ফ‌লে হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুত্ব রক্ষার জন‌্য ধর্মীয় দেশ বানাবার ঘোষণা দি‌লে, মুসলমান‌দের তা দি‌তে হ‌বে কেন? বিদ‌্যাসাগ‌রের সংস্কার বর্ণ‌হিন্দু‌দের লে‌গে‌ছিল, মুসলমান‌দের লা‌গে‌নি। কারণ মুসলমানদের জীবন যাপন, বিবাহ, খাদ‌্য গ্রহণ অ‌নেক বে‌শি সহজ, ধর্মীয় ‌বিধান সেখা‌নে খুব ঝা‌মেলা সৃ‌ষ্টি ক‌রে না। ধর্মীয় রাষ্ট্রও তাই তার দরকার নেই।

যা কিছু বলা হ‌লো, তা‌তে বি‌শেষ কো‌নো ধ‌র্মের কর্তৃত্ব সং‌বিধা‌নে থাক‌বে না। স্পষ্ট ক‌রে বল‌লে সং‌বিধান‌কে ধর্মের চোখ দি‌য়ে দেখা যা‌বে না, দেখ‌তে হ‌বে নাগ‌রিকদের অধিকারের চোখ দি‌য়ে। সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠতার প্রশ্ন তু‌লে ধর্মের চোখ দি‌য়ে সং‌বিধান‌কে বিচার করা বাতুলতা মাত্র এবং মুসলসান‌দের নি‌জে‌দের জন‌্যই তা বিপজ্জনক। য‌দি বাংলা‌দেশ সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠতার দোহাই দি‌য়ে সং‌বিধানে ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতষ্ঠা কর‌তে চায়, তাহ‌লে সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠতার প্রশ্ন তু‌লে ভারতের বি‌শেষ ক‌য়েক‌টি দল যেটা কর‌তে চায় সেটাও স‌ঠিক ব‌লে মান‌তে হ‌বে। ‌ঠিক একইভা‌বে খ্রিস্টান সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠরা তা‌দের দে‌শে য‌দি বাইবে‌লের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ক‌রে মুসলমান‌দের ধর্মপালন‌কে নিয়ন্ত্রণ কর‌তে চায় সেটাও সকল‌কে মে‌নে নি‌তে হ‌বে।

সারা বিশ্বের জনসংখ‌্যার প‌রিসংখ‌্যা‌নে দেখা যায়, মুসলমান‌দের চে‌য়ে অবিশ্বাসী মানু‌ষের সংখ‌্যা এখন বে‌শি। না‌স্তিক‌দের সংখ‌্যা দেড়‌শো কো‌টির কাছাকা‌ছি। য‌দি তারা তা‌দের দে‌শে সকল ধর্ম পালন নি‌ষিদ্ধ ক‌রে দি‌য়ে সং‌বিধান রচনা ক‌রে তাহ‌লে কী দাঁড়া‌বে? চীন দে‌শে ধর্মহীন মানু‌ষের সংখ‌্যা অনেক বে‌শি। য‌দি তারা ব‌লে ইসলামসহ কো‌নো ধর্ম‌কে এখা‌নে টিক‌তে দে‌ব না, তাহ‌লে সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠতার প্রশ্ন তু‌লে কি তা‌দের স‌ঙ্গে আর ধর্মপাল‌নের কথা বলা যা‌বে? কথা বলবার সময় চার‌দিক, বাস্তব বি‌বেচনা কর‌তে হয়। ধর্মীয় কট্টরতা ও গোঁড়া‌মির জন‌্যই একদা ইহু‌দি‌দের প‌্যা‌লেস্টাইনসহ সব দেশ ছাড়‌তে হয়ে‌ছিল। ভিন্ন ধর্মের শাসকরা তখন ইহু‌দি‌দের তা‌দের ধর্ম পাল‌নে বাধা দেয়‌নি, কিন্তু তারা অন‌্য ধর্ম‌কে বা প‌্যাগান ধর্মকে সামান‌্য স্থান দি‌তে চাওয়ার গোঁড়া‌মির কার‌ণেই শাসক‌দের চক্ষুশূল হ‌য়ে‌ছিল। প‌্যালেস্টাইন ছাড়‌তে বাধ‌্য হয় বড় একটা অংশ।

বাংলা‌দে‌শের কিছু মানুষ য‌দি সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠতার কথা ব‌লে একইরকম‌ গোঁড়া‌মি কর‌তে চায়, তার ফল সারা‌বি‌শ্বের মুসলমান‌দের জন‌্য ভা‌লো হ‌বে না। বাংলা‌দে‌শে য‌দি মুসলমানরা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ কর‌তে চায়, কা‌লের বিচা‌রে বাংলা‌দে‌শের গু‌টিকয় মুসলমা‌নের কর্তৃত্ববাদীতার জন‌্য সারা বি‌শ্বের মুসলমানরা হেনস্থা হ‌বে। তা‌দের মর্যাদা ও সম্মান মারাত্মক ঝুঁকির ম‌ধ্যে পড়‌বে। বর্তমান বাংলা‌দে‌শের সকল মুসলমানরা সং‌বিধা‌নে ধর্মের কর্তৃত্ব মে‌নে নে‌বে না। সেটা করা হ‌লে বাংলা‌দে‌শেই মুসলমান‌দের ম‌ধ্যে গৃহযুদ্ধ হ‌বে, রক্তপাত ঘট‌বে। মুসলমানরা তখন দুর্বল হ‌য়ে পড়‌বে। সারা বি‌শ্বে তখন মুসলমান‌দের মর্যাদা কম‌বে। মুসলমান‌দের নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে গৃহযুদ্ধ নি‌য়ে মানুষ হাসাহা‌সি কর‌বে। ফ‌লে শখ ক‌রে এমন বিপদ ডে‌কে না এনে খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা দরকার বাংলা‌দে‌শের মূল সঙ্কট কোথায়।

প‌রিবর্তন আস‌লে কোথায় দরকার। দরকার দা‌রিদ্র দূর করা, সকল মানু‌ষের জন‌্য শিক্ষা, খাদ‌্য ও চি‌কিৎসার সেবা বাড়া‌নো। যতক্ষণ সেসব না বাড়া‌নো হ‌বে, বৈষম‌্য থে‌কেই যা‌বে। ফ‌লে বড় বড় প‌ণ্ডিত‌দের ইসলামি শাসনত‌ন্ত্রের কথা না ভে‌বে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্ন‌তির কথা ভাব‌তে হ‌বে। মুসলমানরা আজ যেসব মানুষ‌দের‌ নি‌য়ে গর্ব ক‌রে, যেমন ইব‌নে সিনা, আবু রুশদ, আল রাজী, ইব‌নে খালদুন এমন অজস্র মুসলমান প‌ণ্ডিত ছি‌লেন মধ‌্যযু‌গে। সক‌লেই তারা বিজ্ঞান প্রযু‌ক্তি, চি‌কিৎসা‌বিজ্ঞা‌নের বিরাট উন্নতি সাধন ক‌রে‌ছি‌লেন। ইসলাম ধ‌র্মের প্রথ‌মেই আছে জ্ঞান সাধনার কথা। সেই যু‌গে তারা ইসলা‌মের সেই বাণী অনুসরণ ক‌রে‌ছি‌লেন। পাশ্চাত‌্য বা খ্রিস্টান জগৎ যখন অন্ধকা‌রে ডু‌বে ছিল মুসলমানরা তখন সারা বি‌শ্বে আলো ছ‌ড়ি‌য়ে‌ছেন। বিশ্ব তখন তা‌দের দখ‌লে ছিল। মুসলমানরা যে‌দিন জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা থে‌কে স‌রে দাঁড়া‌লো, আরম্ভ হ‌লো তাদের পতন। বি‌শ্বের জ্ঞানভাণ্ডা‌রে আর তাদের আগের সেই সাফল‌্য রইল না। চ‌লে গেল তা খ্রিস্টানসহ অন‌্যান‌্য সম্প্রদা‌য়ের হা‌তে।

ইসলাম ধর্মের স‌ঙ্গে ধর্ম‌নির‌পেক্ষতার বি‌রোধ নেই, বরং আছে সম্পর্ক। ইসলাম অনেক ক্ষে‌ত্রেই বিশ্ব‌কে আলো‌কিত ক‌রে নতুন পথ দে‌খি‌য়ে‌ছিল। কথাটা ব‌লে‌ছি‌লেন মান‌বেন্দ্র নাথরায়। তি‌নি ভারতীয় ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টির প‌থিকৃত ছি‌লেন। জওহরলাল নেহরু একই কথা ব‌লে গে‌ছেন। প‌াশ্চা‌ত্যের ইতিহা‌সে ও বহু মনীষীর রচনায় এই কথাগু‌লো বারবার বলা আছে। ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় ছিল ব‌লেই মধ‌্যযু‌গে যেসব দেশ জয় ক‌রে‌ছিল, সেখা‌নে স্থানীয় ধর্মগু‌লো‌কে নি‌ষিদ্ধ ক‌রে‌নি। পাশ্চা‌ত্যে ইহু‌দি ও মুসলমান পণ্ডিতরা একস‌ঙ্গে বিজ্ঞান চর্চা ক‌রে‌ছে। সক‌লেই ছিল তারা আরব। প‌রে ইউরো‌পের খ্রিস্টানরা সেখা‌নে যুক্ত হয়। মুসলমান‌দের প্রভা‌বে তার ফ‌লেই ইইরো‌পে দেখা দেয় রে‌নেসাঁ। ইসলাম ধ‌র্মে স্পষ্ট ক‌রে বলা আছে, নি‌জে‌দের ধর্ম নি‌য়ে তোমরা বাড়াবা‌ড়ি ক‌রো না। ধর্ম নি‌য়ে ফ‌্যাসাদ ক‌রো না।

স‌ন্দেহ নেই, ইসলাম তার শুরু‌তে ধর্ম নি‌য়ে ফ‌্যাসাদ ক‌রে‌ছে যখন ইসলাম ছিল দুর্বল। ইসলাম প্রচা‌রের প্রথম দি‌কে যখন নবির ওপর আক্রমণ নে‌মে আসে, তিনি তখন তাঁর ধর্মমত‌কে শক্ত‌ভি‌ত্তির ওপর দাঁড় করাবার জন‌্য, টি‌কে থাকবার জন‌্য বহু যুদ্ধ ক‌রে‌ছেন ও জয়ী হ‌য়ে‌ছেন। কিন্তু যখন ইসলাম প্রতি‌ষ্ঠিত হ‌লো, তখন চেষ্টা ক‌রে‌ছেন সকল ধর্ম‌কে মান‌্যতা দি‌তে। তি‌নি ব‌লে‌ছেন, লা কুম দীনু কুম ওয়া‌লি‌ দীন। যার যার ধর্ম তার তার। এটাই ধর্মনির‌পেক্ষতার স্পষ্ট বাণী। মুসলমান শাসকরা মধ‌্যযু‌গে এ বাণীর মর্যাদা রক্ষা ক‌রে‌ছেন। নবির মৃত‌্যুর পর মুসলমানরা একটার পর একটা দেশ দখল ক‌রে‌ছে, নবির নি‌র্দেশ‌কে মান‌্যতা দি‌য়ে‌ছে। জোর ক‌রে ইসলাম কা‌রো ওপর চাপা‌নোর চেষ্টা ক‌রে‌নি, যারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ ক‌রে‌ছে ক‌রে‌ছে। ইউরোপ, মালয়, ভারত কোথাও ধর্ম চা‌পি‌য়ে দেয়‌নি মুসলমান শাসকরা। মালয় দে‌শের মানুষরা রাতারা‌তি ইসলাম গ্রহণ ক‌রে‌ছে ইউরোপীয় খ্রিস্টান সাম্রাজ‌্যবাদী‌দের প্রতি ঘৃণায়। যখন ষোল শত‌কে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা মালয়‌দের খ্রিস্টান হ‌তে চাপ দেয়, তারা খ্রিস্টান‌দের প্রতি ক্ষে‌পে গি‌য়ে ইসলাম গ্রহণ ক‌রে। কারণ তার আগে প্রায় এক হাজার বছর মুসলমানরা মালয় রাজ‌্যগু‌লো‌তে ব‌্যবসা বা‌ণিজ‌্য কর‌লেও, কখ‌নো মালয়‌দের ইসলাম গ্রহণ কর‌তে ব‌লে‌নি।

ইসলা‌মে স্পষ্ট বলা আছে, জি‌জিয়া ক‌রের কথা। বলা হয়‌ছে মুসলমানরা কো‌নো দেশ দখল কর‌লে সেখানকার মানুষ‌কে জোর ক‌রে ধর্মান্ত‌রিত করা যা‌বে না। বরং ভিন্ন ধ‌র্মের মানুষরা জি‌জিয়া কর দে‌বে, সেই অর্থ দি‌য়ে ভিন্ন ধর্মের মানুষ‌দের জানমা‌লের নিরাপত্তা দি‌তে বাধ‌্য থাক‌বে রাষ্ট্র। জি‌জিয়া করা সবার জন‌্য প্রযোজ‌্য ছিল না। ধর্মীয় উপাসনাল‌য়ের প‌রিচালক, নারী, শিশু, পঙ্গু বিকলাঙ্গরা এই কর দে‌বে না। যারা উপার্জন কর‌তে সক্ষম তারাই শুধু এ কর দে‌বে। ব‌্যাপারটা এমন নয় যে, বিধর্মীরা শুধু জানমা‌লের নিরাপত্তার কর দে‌বে, মুসলমান‌দের এ ধর‌নের নানারকম কর দি‌তে হ‌তো। ইসলাম জোর ক‌রে ধর্মান্ত‌রিত করার বিপ‌ক্ষে। সে কার‌ণেই ভার‌তে বিরাট সংখ‌্যক মানুষ নিজ ধর্মে থে‌কে গে‌ছে। মুসলমানরা ভারত শাসন ক‌রে‌ছে দু‌শো বছর ধরে। কিন্তু মুসলমান হ‌য়ে‌ছে মাত্র এক চতুর্থাংশ মানুষ।‌

ভার‌তের সকল ভূস্বামী, বড় বড় আমলারা হিন্দু থে‌কেও নি‌জে‌দের পদ ভোগ কর‌তেন। সেনাপ্রধান মান‌সিংহ জয়‌সিংহরা ছি‌লেন হিন্দু। বাংলার মুসলমান শাসক‌দের ভূ‌মিকার কথাও সবাই জা‌নে। বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে‌ছে তাদের হা‌তে। মুঘল শাসকরা যেমন, বাংলার মুস‌লিম শাসকরা ঠিক একইভা‌বে রামায়ণ মহাভারত, বেদ, উপ‌নিষদ অনুবাদ ক‌রতে বহু ব‌্যক্তি‌কে নি‌য়োগ দি‌য়ে‌ছিলেন। ফ‌লে ইসলাম ধর্মের স‌ঙ্গে ধর্ম‌নির‌পেক্ষ শাস‌নের বি‌রোধ নেই, বরং সেটাই ইসলা‌মের আদর্শ। মুঘলরা ভার‌তকে বল‌তেন তখন ‘হিন্দুস্তান’। সকল মুঘল সম্রাটরা, ঔরঙ্গ‌জেবসহ সকল ম‌ন্দির‌কে অনুদান দি‌তেন। এসব ব‌্যাপার  চমৎকার লেখা আছে ভার‌তে প্রথম রাষ্ট্রপ‌তি রা‌জেন্দ্রপ্রসা‌দের। বিএন পা‌ণ্ডেসহ অনেক মুসলমা‌নের। সেইসব লেখায় দেখা যায়, ঔরঙ্গ‌জেব ‌ছি‌লেন ক‌ট্টর ধার্মিক। কিন্তু রা‌ষ্ট্রের চ‌রিত্রকে ধর্ম‌নির‌পেক্ষ রে‌খে‌ছি‌লেন।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ