রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ২০

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

(ক্রানমার চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। সেনাধ্যক্ষ ক্রানমারকে চলার পথে বাধা দেয়।)
ব্রাসিডাস: মান্যবর ক্রানমার, এ পথ দিয়ে নয়, আপনাকে যেতে হবে পেছনের পথ দিয়ে। আমার সৈন্যরা আপনাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।
ক্রানমার: ধন্যবাদ, সেনাধ্যক্ষ বাসিডাস।
ব্রাসিডাস: শুভরাত্রি।
ক্রানমার : শুভরাত্রি।

(ক্রানমারের প্রস্থান)
জেকোনেত্তা: সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস, আপনার জন্য আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক নয়। হলোফারনেসের ফিরবার সময় হয়ে গেল। আপনার এবার গা ঢাকা দেয়া দরকার।
সেনাধ্যক্ষ: হ্যাঁ আমি যাচ্ছি। তার মদের মধ্যে মিশিয়ে দেয়ার জন্য ঐ যে আফিম টেবিলের ওপরেই রাখা আছে। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর পাঠাবেন।
 
(মদে বিষ মেশায়)
জেকোনেত্তা: ঐ যে হলোফারনেসের আগমনের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। আপনি এবার যান।
(সেনাধ্যক্ষ বের হয়ে যায়। জেকোনেত্তা হলোফারনেসের জন্য অপেক্ষা করে এবং নিজেকে প্রস্তুত করে। প্রবেশ করে হলোফারনেস।)

হলোফার: জেকোনেত্তা, তোমারও আজ আমার সাথে দিউনাসাসের মন্দিরে যাওয়া দরকার ছিল। বহুদিন পর হোরেসের কাব্য পাঠ শুনলাম। চমৎকার! তোমারও ভালো লাগতো। আমি বুঝতে পারছি, কাব্য পাঠ শুনতে যাবার মতো মানসিক অবস্থা এখন তোমার নেই। জেকোনেত্তা, তোমার পুত্রের জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু শাসক হিসাবে ন্যায়বিচার করাই ছিল আমার ধর্ম।
জেকোনেত্তা: শাসক হিসাবে তুমি তোমার সঠিক কাজই করেছো। কিন্তু আমি তার মাতা।

হলোফার: জেকোনেত্তা, সব ভুলে যাও। এসো আমরা সুখি হই। হোরেস থেকে কাব্যপাঠ শুনতে শুনতে আমার মনে হলো, কখনোই কোনো মানুষকে ঘৃণা করা আমাদের উচিত নয়। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাই শুধু মানব জীবনে সুখ বয়ে আনতে পারে। সব ভুলে যাও জেকোনেত্তা। এসো, আমরা বন্ধু হই। জেকোনেত্তা, তুমি আমায় রাজ্য শাসনে সাহায্য করো। এসো দুজনে মিলে আমরা দেশের জন্য কিছু ভালো কাজ করি।
জেকোনেত্তা: হিস্টাফাসের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

হলোফার: স্বাভাবিক। সে তোমার পুত্র ছিল। তোমার স্নেহে সে বড় হয়েছে। স্বামী হিসাবে তোমার এ দুঃখ ভাগ করে নেয়া আমারও কর্তব্য। জেকোনেত্তা, কাব্যপাঠ্য সত্যিই মানুষকে বড় আনন্দ দেয়। হয়ত আমাদের পূর্বপুরুষদের রচিত কাব্যের সমস্ত বক্তব্যের সাথে তুমি একমত হতে পারবে না। কিন্তু কাব্যগুলো যে কোনো এক মহৎ উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে তাও তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। প্রতিটি কাব্যের পংক্তিতে জীবনের নানা সত্য তোমার চোখে ধরা পড়বে।
জেকোনেত্তা: তোমাকে খুব সতেজ লাগছে। মনে হচ্ছে নাটক দেখে খুবই উপভোগ করেছো। যদিও খ্রিস্টধর্মে নাটক নিষিদ্ধ, হঠাৎ মনে হলো নাটক নিষিদ্ধ কেন হবে? নাটক তো মানুষের জীবনেই ঘটছে প্রতিদিন।

হলোফার: ঠিক।
জেকোনেত্তা: নাও, আমার সঙ্গে বসে একটু পান করো।

হলোফার: নিশ্চয় জেকোনেত্তা। (হলোফারনেস জেকোনেত্তার মুখামেুখি বসে) জেকোনেত্তা, আজ তোমাকে আমি ইসকাইলাসের শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস থেকে পাঠ করে শোনাবো। ছেলেবেলায় প্রমিথিউস থেকে পাঠ ছিল আমার কাছে তীব্র নেশার মতো। তখন আমি স্বপ্ন দেখতাম, দরকার হলে আমিও একদিন আমার দেশের মানুষের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেব।
(জেকোনেত্তা মদ ঢেলে দেয় গ্লাসে। হলোফারনেস পান করে। স্বাদ নেয়।)

জেকোনেত্তা: মদটা কেমন?
হলোফার: চমৎকার। [তারপর তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে তাকায় জেকোনেত্তার দিকে] বহুদিন এমন মদ আমি পান করিনি। দাও গ্লাস ভরে দাও। (জেকোনেত্তা হলোফারনেসের গ্লাসে আরো মদ ঢালে। তখন হলোফারনেস জেকোনেত্তাকে নিজের গ্লাস এগিয়ে দেয়) নাও, তুমিও নাও। পান করো।
জেকোনেত্তা: না, আমার অনেক হয়ে গেছে।

হলোফার: সামান্য একটু। মাত্র এক চুমুক। দাও আমাার গ্লাস থেকে।
জেকোনেত্তা: না আর নয়। আমার গ্লাস দেখ শেষ।

হলোফার: জেকোনেত্তা, (খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় জেকোনেত্তার দিকে।) নিশ্চয় এ মদের মধ্যে কোনো বিষ মেশানো নেই?
জেকোনেত্তা: (চমকে ওঠে) না!

হলোফার: না! আমি ভেবেছিলাম সামান্য বিষ থাকতেও পারে।
জেকোনেত্তা: না! না!
(জেকোনেত্তা একটু বোকা হয়ে যায়। হলোফারনেস উঠে দাঁড়ায়)

হলোফার: মদটা সুস্বাদু সন্দেহ নেই। মহীয়সী জেকোনেত্তা, তুমি আমাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলে। বোকা রমণী, হলোফারনেস নিয়মিত আফিম খায়। বিষ খাইয়ে তাকে হত্যা করা যায় না।
(হলোফারনেস পেছন থেকে জেকোনেত্তার হাত মোচড়াতে থাকে।)
জেকানেত্তা: (যন্ত্রণায়) আঃ আঃ!

হলোফার: খুনী জেকোনেত্তা শোনো, এর আগে বহু বার বিশ খাইয়ে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেককে সিংহের সামনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর তোমাকে আরো কঠিনভাবে হত্যা করা হবে।
(হলোফারনেস জেকোনেত্তার হাত মোচড়াতে থাকে।)
জেকোনেত্তা: আঃ! আঃ!
হলোফার: নারী, তোমার লোভ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাও! জোকাস্তাকে হত্যা করে এক পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। এবার আমাকে হত্যা করে আর এক পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইছে। ভেবেছো আমি অন্ধ? কিছুই টের পাই না। দিউনাসাসের মন্দিরে হোরেসের কাব্য পাঠ শুনে আমার মন হঠাৎ পাল্টাতে শুরু করেছিল। একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে তোমায় সত্যি জয় করে নেবো। আর তুমি ভিতরে ভিতরে আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিলে।
জেকোনেত্তা: (যন্ত্রণায়) আঃ! আঃ! আঃ!

হলোফার: সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী রমণী, তোমার যে দেহ এতদিন আমি ভোগ করেছি, সেই দেহ এখন টুকরো টুকরো করে কেটে থিউসের পথে পথে ছড়িয়ে দেবো। হলোফারনেসের ভিন্ন এক চেহারা দেখবে তুমি।
(ব্রাসিডাস পেছন থেকে ঢুকে হলোফারনেসের পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়)

ব্রাসিডাস: সে সুযোগ আর পাবে না রাজা হলোফারনেস। চলবে