রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ১৪
প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
পঞ্চম দৃশ্য
(হলোফারনেসের প্রাসাদ। সময় রাত। ক্রানমার হলোফারনেসের জন্য অপেক্ষা করছিল। ক্রীতদাস মদ ও সুরাপাত্র রেখে চলে যায়। ক্রানমার পান করতে শুরু করে। প্রবেশ করে হলোফারনেস।)
হলোফার: ক্রানমার, বহুদিন পর তোমার পা পড়লো এখানে। তাও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে। নিশ্চয় কোথাও কোনো গোল বেঁধেছে।
ক্রানমার: হলোফারনেস, তোমার নতুন আইনের আমি তো মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। দ্রাক্ষার মদ এখন থেকে কেউ বিক্রয় করতে পারবে না, এ রকম আইন তুমি কেন করেছো?
হলোফার: দ্রাক্ষার মদ বিক্রয় বন্ধ করা হয়নি। বন্ধ করা হয়েছে মদের আমদানি।
ক্রানমার: কেন?
হলোফার: থিউসের গ্রামে গঞ্জে এখন প্রচুর দ্রাক্ষা জন্মাচ্ছে। এখানকার কৃষকরা সে দ্রাক্ষা থেকেই ভালো মদ উৎপাদন করছে। অতএব বিদেশ থেকে দ্রাক্ষার মদ আমদানি আমাদের আর দরকার পড়ছে না।
ক্রানমার: থিউসের কৃষকরা মদ উৎপাদন শুরু করেছে বলে দ্রাক্ষার মদ আমদানি তুমি বন্ধ করে দিতে চাও। ভেবে দেখেছো এতে করে আমার বছরে কত কোটি মুদ্রা লোকসান দিতে হবে।
হলোফার: ক্রানমার, বুঝতে পারছো না কেন, দ্রাক্ষার মদ বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে বলে, প্রতি বছর দেশে যে বিপুল পরিমাণ দ্রাক্ষা জন্মাচ্ছে, তার পুরোটাই পচে যাচ্ছে। এ সকল দ্রাক্ষা কৃষকের কোনই কাজে আসছে না।
ক্রানমার: দেশের দ্রাক্ষা যদি পচে গলে নষ্ট হয়ে যায় সেটা খুবই দুঃখজনক। সেজন্য থিউসে দ্রাক্ষার চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দাও। কিন্তু বাইরে থেকে দ্রাক্ষার মদ আমদানি বন্ধ করতে চাইছো কেন?
হলোফার: (হলোফারনেস ক্রানমারের দিকে পান পাত্র এগিয়ে দিয়ে) ক্রানমার, আমার সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করো। সমস্ত কৃষকরা রাজার ওপর ক্ষুব্ধ। কৃষকদের দাবি বাইরে থেকে মদ আমদানি বন্ধ করা হোক। তারা তাদের উৎপন্ন দ্রাক্ষা থেকেই দেশের জন্য মদ সরবরাহ করতে চায়। এ দাবি যৌক্তিক। সব চেয়ে বড় কথা হলো কৃষকদের দাবি না মানা হলে ওরা, যখন তখন বিদ্রোহ করে বসতে পারে।
ক্রানমার: বেশ ভালো কথা, দেশের মাটিতে দ্রাক্ষার মদ উৎপন্ন হবে। সে মদের বিলি ব্যবস্থা কে করবে?
হলোফার: সে বিলি ব্যবস্থার ভার ফ্রয়েনেলকে দেয়া হয়েছে। দেশের সমগ্র অঞ্চল থেকে দ্রাক্ষা সংগ্রহ এবং সে দ্রাক্ষা থেকে মদ উৎপাদন ও বিক্রয়ের সমস্ত রকম দেখাশুনা সেই করবে। মদ বিক্রয়ের লাভ থেকে সে রাষ্ট্রকে কর দেবে বছরে দশ লাখ সেস্টাস।
ক্রানমার: মাত্র দশ লক্ষ সেস্টাস। বোঝাই যাচ্ছে ফ্রয়েনেলকে কাজটি দেয়ার জন্য বেশ বড় অংকের ঘুষ বাগিয়ে নিয়েছো।
হলোফার: আমার স্ত্রী জেকোনেত্তার অনুরোধেই ফ্রয়েনেলকে কাজটি দেয়া হয়েছে। ফ্রয়েনেল জেকোনেত্তার পুরানো বন্ধু।
ক্রানমার: দেশের মাটিতে একজন বিদেশী ব্যবসায়ী। জেকোনেত্তার সাথে তোমার বিবাহে আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য লাভই হবে। কিন্তু এখন দেখছি ক্ষতিও কম নয়। যা হোক, আমার ব্যাপারে কি ভাবছো? দ্রাক্ষার মদ আমদানি বন্ধ হলে আমার যে কোটি কোটি সেস্টাস লোকসান হবে তার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছো কি ভাবে?
হলোফার: শুধু দ্রাক্ষার মদের ব্যবসা নিয়ে ভাবছো কেন? মিশর, এ্যাটিকা ও সিসিলিতে কাচের পণ্য সরবরাহ করে তুমি দ্রাক্ষার মদের চেয়ে বহুগুণ অর্থ আয় করছো।
ক্রানমার: ক্রানমার, আমার কাচের পণ্য বিক্রয়ের একটি বড় বাজার হচ্ছে এ্যাটিকা। ওদের সাথে আমার চুক্তি হয়েছে, এ্যাটিকা থেকে আমি মদ ক্রয় করবো, আর ওরা আমার কাছ থেকে ক্রয় করবে কাচের পণ্য। যদি এ্যাটিকা থেকে এখন তুমি আমার মদ আমদানি বন্ধ করে দাও, সেখানে আমার কাচ রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যাবে।
হলোফার: ব্যাপারটা অবশ্য ওভাবে আমি কখনো ভেবে দেখিনি। কিন্তু ক্রানমার, থিউসের কৃষকদের কোনোভাবেই ক্ষেপিয়ে তোলা যাবে না। রাজনীতির চক্রে এখন আমি আটকে গেছি। কৃষকদের এখন ক্ষেপিয়ে তোলা মানেই আমার এ সিংহাসন হারানো।
ক্রানমার: কৃষকদের বিদ্রোহের হাত থেকে বাঁচার জন্য যদি তুমি দ্রাক্ষার মদ আমদানি বন্ধ করে দিতে চাও, ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে আমি চাইবো ক্রীট থেকে আমাকে মৃৎপাত্র এবং সিল্কের বস্ত্র আমদানি করবার অনুমোদন দেয়া হোক।
হলোফার: সেটাও সম্ভব নয় ক্রানমার। যে দুটো পণ্যের কথা তুমি বললে সে দুটো পণ্যই প্রচুর পরিমাণে থিউসে উৎপন্ন হয়।
ক্রানমার: থিউসে যে সিল্ক তৈরি হয়, ক্রীটের সিল্ক তার চেয়ে বহুগুণ মূল্যবান। মৃৎপাত্রের ব্যাপারটা না হয় বাদ দেয়া গেল, কিন্তু সিল্ক আমদানি করার অনুমতি দিতে তোমার আপত্তি কোথায়?
হলোফার: দেশে বিলাসদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন চালু রয়েছে। এখন ক্রীট থেকে মূল্যবান সিল্ক আমদানি করা হলে যুবক সম্প্রদায় ক্ষেপে যাবে।
ক্রানমার: বোকার মতো কথা বলো না। যুবকরা এতে খুশিই হবে।
হলোফার: খুশি হবে মানে?
ক্রানমার: বর্তমানে শুধু ধনীর সন্তানরাই ক্রীটের মূল্যবান সিল্ক পরিধান করবার সুযোগ পাচ্ছে। তা দেখে সাধারণ যুবকরাও ঐ ধরনের পোষাক পরবার লোভ সামলাতে পারছে না। কারণ এ সব যুবকদের ধারণা, ক্রীটের বস্ত্র পরিধান করতে পারাই মানে আভিজাত্য অর্জন করা।
হলোফার: ধনীর সন্তানদের অনুকরণ করে সাধারণ যুবকরা ভুল পথে পরিচালিত হতে চাইলেও, আমি তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে পারি না। একজন রাজার সামান্য পরিমাণ হলেও দেশের মঙ্গল চিন্তা করা দরকার।
ক্রানমার: আমার কাছে সকলের চেয়ে বড় আমার ব্যবসার স্বার্থ দেখা। আমার কোনারকম বাণিজ্যিক ক্ষতি আমি মেনে নেব না। হলোফারনেস, তোমার প্রজাদের বিদ্রোহের চেয়েও আমার ক্রোধ তোমার জন্য বেশি বিপদজনক।
(হলোফারনেস মদের পাত্রে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো হঠাৎ থেমে ক্রুর হাসি হেসে)
হলোফার: ক্রানমার, তুমি কি আমায় ভয় দেখাচ্ছো। ভুলে যেও না, তুমি দাঁড়িয়ে আছো একজন রাজার সামনে। তোমার মুদ্রা তোমার পকেটেই থাক, কিন্তু তোমার ঘাড়ে মাথা থাকবে কি না সে সিদ্ধান্ত আমিই নেবো। অন্তত যতক্ষণ আমি রাজা।
ক্রানমার: বেশ গর্জন করতে শিখে গেছ। রাজা হলোফারনেস, ভুলে যাও কেন, তোমার মতো কত রাজাই ঐ সিংহাসনে বসেছে। আবার হারিয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ তোমার মতো গর্জন করতে করতেই একদিন...
হলোফার: ক্রানমার, তোমার সাথে বিরোধ তৈরি করা আমার কোনো লক্ষ্য নয়। কিন্তু তুমি যেভাবে আমাকে আক্রমণ করছে তাতে আমিও বাধ্য হয়েছি তোমার সাথে রূঢ় আচরণ করতে। ব্যাপরটা ভুলে যাও।
ক্রানমার: হলোফারনেস, তুমি কি ভুলে গেছো কার দয়ায় তুমি রাজা হয়েছে? একজন সাধারণ সৈনিক থেকে কেমন করে এখানে এসে পৌঁছেছো? পিছনের দিকে ফিরে তাকাও, কোথা থেকে তোমায় টেনে তুলেছিলাম। স্মরণ করো। চলবে