রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ১২
প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
সস্ত্রাতাস: সঠিক চিন্তা?
হলোফার: হ্যাঁ সস্ত্রাতাস। সক্রেটিস বহু বছর আগেই বলে গেছেন আমাদের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা। সস্ত্রাতাস, পড়ো এবং জ্ঞান অর্জন করো। না হলে মূর্খের মতো বিরোধিতা করে কোনো লাভ নেই। হয়তো একদিন আমার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তারপর আবার সেই পুরানো চক্রে আটকে যাবে। জনগণের জন্য কিছুই করতে পারবে না। শত ইচ্ছা থাকলেও নয়। যদি আমার বিরোধিতা করতে হয়, এমনভাবে সে বিরোধিতা করো, যাতে জনগণের সম্মুখে সত্য উদঘাটিত হয়। জনগণকে অন্ধভাবে ক্ষেপিয়ে দিও না। সস্ত্রাতাস, আমি জানি, যদি কেউ পেছন থেকে পিঠে ছুরি বসিয়ে দিয়ে আমাকে হত্যা করে, কোনো দেশপ্রেমিক সেই হত্যাকারী হবে না, সে হবে আমারই মতো আর একজন ক্ষমতালোভী।
জোকাস্তা: মহামান্য রাজা, সম্ভবত আপনার প্রাসাদে ফিরবার সময় হয়ে গেল। চলুন আপনাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসি।
হলোফার: হ্যাঁ তাই ভালো। সস্ত্রাতাস, তোমার সাথে আবার দেখা হবে। শুধু স্মরণ রেখো, সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানই এখন আমাদের একমাত্র মুক্তির পথ দেখাতে পারে।
(হলোফারনেস ও জোকাস্তা বের হয়ে যায়। প্রবেশ করে হিস্টাফাস।)
হিস্টাফাস: একটু আগে এখানে যে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা গেল সে কি ক্রোনাসের ভগ্নি জোকাস্তা?
সস্ত্রাতাস: হ্যাঁ।
হিস্টাফাস: জোকাস্তা সাহসী এবং সুন্দরী। কিন্তু সে এখানে দাঁড়িয়ে তোমার সাথে কথা বলছিল কেন? তোমার সাথে তার কী সম্পর্ক?
সস্ত্রাতাস: জোকাস্তা দীর্ঘদিনের সূত্রে আমার পরম বান্ধবী।
হিস্টাফাস: ভালো। আমি রানী জেকোনেত্তার কনিষ্ঠপুত্র হিস্টাফাস। জোকাস্তাকে যদি তুমি ভালোবেসে থাকো তাহলে তোমাকে এ পথ থেকে সরে দাঁড়াতে বলছি। কারণ জোকাস্তাকে আমি ভালোবাসি। জোকাস্তা যেহেতু থিউসের সবচেয়ে সুন্দরী সেহেতু সে শুধু একমাত্র আমারই প্রণয় লাভের যোগ্য।
সস্ত্রাতাস: জোকাস্তা কার প্রণয় লাভ করবে, সে সিদ্ধান্ত নেবার ভার জোকাস্তার ওপর ন্যস্ত।
হিস্টাফাস: যুবক তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ? সে ভুল কখনো করো না।
সস্ত্রাতাস: যুবরাজ, থিউসের নারীরা রোমের মতো পরাধীন নয়। এখানকার স্বাধীন রমণীরা যাকে যোগ্য মনে করবে তাকেই সে তার প্রেমিক হিসাবে বেছে নিতে পারে। আগে জেনে দেখো, জোকাস্তা তোমাকে তার যোগ্য মনে করে কি না।
হিস্টাফাস: হে সাহসী যুবক, আমি আমার তরবারির দ্বারা যোগ্যতার প্রমাণ দেবো। পৃথিবীতে ক্ষমতাই সব। তোমাকে পুনর্বার বলছি, জোকাস্তা আমার আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। অতএব তুমি অন্য নারীর সন্ধান করো।
সস্ত্রাতাস: তোমার তরবারির ক্ষমতা আমার জানা আছে। যারা পেছন থেকে আক্রমণ চালিয়ে নগরপাল ক্যাফিসকে হত্যা করে তাদের সাহসের পরিচয় আর দিতে হবে না।
হিস্টাফাস: দেখো তাহলে, কতটা ক্ষমতা আমি ধারণ করি। যদি সাহস থাকে মুখে বাগাড়ম্বর না করে অস্ত্র বের করো। তোমার ঘাড় থেকে শুধু মুণ্ডুটা নামিয়ে দেবো। তারপর জোকাস্তা হবে আমার।
সস্ত্রাতাস: মিছামিছি তরবারির আস্ফালন দেখানো আমি পছন্দ করি না। তবুও যখন তুমি নিতান্ত বাধ্য করছো। এসো, দেখো এর ধারটা তোমার পছন্দ হয় কি না।
(দুজনে তরবারি বের করে যুদ্ধ আরম্ভ করে। জোকাস্তা এসে হাজির হয়)
জোকাস্তা: এখানে কী হচ্ছে এসব। রাজা হলোফারনেস জানতে পারলে এর ফল কখনোই ভালো হবে না। রাজধানীতে ব্যক্তিগত অসিযুদ্ধ নিষিদ্ধ হয়েছে। প্রিয় সস্ত্রাতাস, এ যুদ্ধ বন্ধ করো।
(যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় হিস্টাফাস)
হিস্টাফাস: প্রিয়তমা, জোকাস্তা, তোমার হুকুমে আমি এ যুদ্ধ বন্ধ করলাম। এবার বলো তোমার জন্য আমার হৃদয়ে যে ভালোবাসা জেগেছে তা তুমি গ্রহণ করেছো কি না। সবাই বলছে থিউসে তোমার চেয়ে সুন্দরী কোনো নারী নেই।
সস্ত্রাতাস: হিস্টাফাস, তোমার কি নিজের চোখ নেই, যে অন্যের চোখ দিয়ে তুমি থিউসের সুন্দরীদের খুঁজে বেড়াও।
জোকাস্তা: প্রিয় সস্ত্রাতাস, হিস্টাফাসের সাথে বিরোধমূলক বক্তব্য বন্ধ করো। হিস্টাফাস, সস্ত্রাতাসের সাথে আমি প্রণয়ে আবদ্ধ। যে ফেরেস আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তার ভ্রাতার প্রেম গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। হতে পারে আমার প্রতি তোমার প্রেমে কোনো ত্রুটি নেই।
হিস্টাফাস: যা চেষ্টার দ্বারা লাভ করা সম্ভব নয়, জোর করেই তা ভোগ করতে হবে। সস্ত্রাতাস আসো, আবার আমরা যুদ্ধ করি। দেখা যাক জোকাস্তার প্রণয় কার ভাগ্যে জোটে।
জোকাস্তা: ভালোবাসা নিয়ে ভাগ্যের লড়াই চলে না হিস্টাফাস। জীবিত হিস্টাফাসের চেয়ে মৃত সস্ত্রাতাস আমার বেশি প্রিয়।
হিস্টাফাস: কি! আমাকে এতবড় অপমান! জোকাস্তা, সস্ত্রাতাস তোমার মন জয় করেছে। আমি লাভ করবো তোমার দেহ সম্পদ।
(রানী জেকোনেত্তার প্রবেশ।)
সস্ত্রাতাস: এই যে এসে গেছে, এই জারজ নোংরা সন্তানের মাতা। নারীর দেহ সম্পদ যদি তোমার এতই পছন্দ হয়, তাহলে তোমার মাতার দেহ সম্পদও খুব মন্দ নয়। সেখানেই যেতে চেষ্টা করছো না কেন?
জোকাস্তা: সস্ত্রাতাস, মাতাকে মাতার মতোই সম্মান করো। পুত্রের কুকর্মের জন্য মাতাকে দায়ী করো না। হিস্টাফাস আমার শরীর নিয়ে যে অশ্লীল মন্তব্য করেছে, তার জন্য তার মাতা দায়ী নয়।
সস্ত্রাতাস: পুত্র নোংরা চরিত্রের হলে অনেক ক্ষেত্রে মাতাকে তার দায় বহন করতে হয়। মাতার শিক্ষাই সন্তানের শিক্ষার ভিত গড়ে তোলে।
জেকোনেত্তা: মাথা নীচু করে আছে কেন হিস্টাফাস। তোমার লজ্জা করে না? যে যুবক তোমার মাতা সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করে সে এখনো জীবিত রইলো কি করে? মাতার সম্মান যদি রক্ষা করতে না পারো, তাহলে কোমরে ঐ তরবারী ঝুলিয়েছো কেন?
হিস্টাফাস: এই দেখো তবে তোমাকে অসম্মান করার শাস্তি (হিস্টাফাস সস্ত্রাতাসের পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়।) এবার আমি যে তোমার পুত্র তার প্রমাণ পেলে?
(সস্ত্রাতাস মুহূর্তের মধ্যে ভূমিতে গড়িয়ে পড়ে।) চলবে